ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বাস্তবতায় মার্কেটিং

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১ জুলাই ২০১৮

নতুন বাস্তবতায় মার্কেটিং

গণমাধ্যম, ইন্টারনেট ও বহিরাঙ্গন ডিসপ্লে দ্বারা সৃষ্ট বাস্তবতা দেখে এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, সারাক্ষণ সবাই কিছু একটা বিক্রি করতে চাচ্ছে। অনেকেই এই বিক্রয় চেষ্টা বা বিক্রয় প্রসার কার্যক্রমকে মার্কেটিংয়ের সমার্থক ভেবে ভুল করছে। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে বিক্রয় চেষ্টার বাড়াবাড়ি দেখে মনে হয় বিক্রেতার হাত থেকে কোনভাবে রেহাই পাওয়া যাবে না, অনেকটা মৃত্যুর মতো। প্রকৃতপক্ষে বিক্রয় হচ্ছে মার্কেটিং বা বাজারজাকরণ হিমশৈলের উপরিভাগ মাত্র। সমুদ্রে ভাসমান তুষার স্তূপের যেমন সামান্য অংশ দেখা যায়, বিক্রয় হচ্ছে মার্কেটিংয়ের সেই দৃশ্যমান অংশটুকু। বাজারজাতকরণের অনেক কাজের একটি হচ্ছে বিক্রি, যেটা সব সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজও নয়। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে অসংখ্য কর্মকা-ে ব্যাপৃত, যার বেশিরভাগকেই মার্কেটিং হিসেবে অবহিত করা যায়। বিনিময়ভিত্তিক যাবতীয় সম্পর্ক স্থাপন ও সে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সকল চেষ্টাকেই আজকাল মার্কেটিং বলা হয়। সেটা ব্যবসায় বা মুনাফার জন্য না হলেও চলবে। মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করার সকল চেষ্টাকে আজকাল মার্কেটিং কার্যক্রম হিসেবে পর্যায়ভুক্ত করা হয়। ডিজিটাল বিপ্লব এবং ব্যবসায় পরিবেশের অনবরত দ্রুতলয়ে বদলে যাওয়ার কারণে মার্কেটিং আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ের অন্য কার্যাবলী যেমন- ফাইন্যান্স, উৎপাদন, হিসাব, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সবই অর্থহীন হয়ে যায় যদি কোন প্রতিষ্ঠান তার দ্রব্য, সেবা, অভিজ্ঞতা, ইভেন্ট, ব্যক্তি, স্থান, সম্পত্তি, সংগঠন, তথ্য ও ধারণার জন্য যথাযথ চাহিদা সৃষ্টি এবং/অথবা ব্যবস্থাপনা করতে না পারে, যা থেকে মুনাফা বা ভ্যালু আসবে; যা সব সময় লভ্যাংশ আকারে বণ্টনযোগ্য না হলেও চলবে। যার কারণে অন্যান্য ‘সি’-লেভেলের নির্বাহী যেমন- ঈঋঙ, ঈওঙ অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে কোম্পানির প্রধান মার্কেটিং নির্বাহী ঈগঙ। মার্কেটিং-এ ভুল করার সুযোগ একেবারেই নেই। ভুল করলে পতন অনিবার্য। কিছু দিন আগেও যে সকল কোম্পানি নেতৃত্বে ছিল তাদের কেউ কেউ এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। পরিবর্তনের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে চলা, বাজার বাস্তবতাকে অফুরন্ত ধারণক্ষমতা দিয়ে গ্রহণ করা এবং নতুন উদ্ভাবন- এই তিন বিষয়ে যারা মনোযোগী হবে তারাই টিকে থাকবে, অন্যথায় বিদায় নিতে হবে। আজ থেকে অর্ধশতাধিক বছর আগে পিটার ড্রাকার বলেছিলেন কোম্পানির প্রথম কাজ হচ্ছে ‘ক্রেতা সৃষ্টি করা’। ক্রেতাই প্রথম। ক্রেতা ও কোম্পানির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং সে সম্পর্ক স্থায়ী ও সুদৃঢ় করাই মার্কেটিং-এর কাজ। বিশ^ায়ন ও প্রযুক্তির প্রভাবে বদলে যাচ্ছে সবকিছু, বদলে যাচ্ছে ক্রেতা ও প্রতিযোগিতা, বদলে যাচ্ছে মার্কেটিংয়ের ল্যান্ডস্কেপ। একবিংশ শতাব্দীর প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ যেমন-প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন, বিশ^ায়ন, সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা, পরিবেশবাদ ও ভোক্তাবাদের বাড়তি দাবি মোকাবেলা করেই অধিকতর গ্রিন মার্কেটিংয়ের দিকে এগোতে হবে মার্কেটারদের। শতবর্ষ পূর্বে ফরাসী বিপ্লব প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে ঈযধৎষবং উরপশবহং তাঁর ‘অ ঞধষব ড়ভ ঞড়ি ঈরঃরবং’ উপন্যাসে লিখেছিলেন ‘ওঃ ধিং ঃযব নবংঃ ড়ভ ঃরসবং; রঃ ধিং ঃযব ড়িৎংঃ ড়ভ ঃরসবং’ পরিবেশের প্রত্যেকটি পরিবর্তনই একটি সঙ্কট। ম্যান্ডারিন ভাষায় সঙ্কটের জন্য কোন একক প্রতীক নেই। সঙ্কট বুঝাতে তারা দুটি প্রতীক ব্যবহার করে অনেকটাই যুক্তাক্ষরের মতো। এর একটি ‘হুমকি’, অপরটি ‘সুযোগ’। পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত। আজ গতকালের মতো নয়, আগামীকালও আজকের মতো হবে না। বলা হয় যেখানে আছ সেখানে থাকতে চাইলেও দ্রুত দৌড়াও। আজকের কৌশল নিয়ে আগামীকাল চলা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন দিনের কৌশলও হতে হবে নতুন। ভবিষ্যতে আরও নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে, এটা কোন সম্ভাবনা নয়, নিশ্চিত করেই বলা যায়। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের আয়, আয়ু, ভোগ, জ্ঞান ও যোগাযোগ বাড়বে। প্রায় সকলেই মেনে নিয়েছে বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমেই অর্থনীতির মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে, যদিও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে এ ব্যবস্থার সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়। বাজার ব্যবস্থায় যারা আস্থাশীল তাদের মতে ওই বাজারই সবচেয়ে ভাল যেখানে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী বাজারে পণ্য বা সেবা পাবে, আর কোম্পানিও তার ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী পণ্য-সেবা সরবরাহ করে সন্তুষ্টি দানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা বা লক্ষ্য অর্জন করবে। ‘বিগ ডাটার’ ব্যবহারের মতো সাম্প্রতিক সময়ের পরিবর্তনগুলো নিয়ে এসেছে অফুরন্ত সুযোগ। এগুলোকে সমস্যা হিসেবে প্রত্যক্ষ করলেও ক্ষতি নেই। কারণ প্রত্যেকটি সমস্যার পেছনেই লুকিয়ে থাকে একটি সুযোগ। সুযোগ খুঁজতে প্রয়োজন সৃজনশীলতা। অনেক সফল ব্যবসায়ীর নাম করা যাবে যারা কোনদিন মার্কেটিং শাস্ত্রটি পড়েনি। চযরষরঢ় কড়ঃষবৎ-এর নাম পর্যন্ত শুনেনি। ব্যয়বহুল গবেষণা, গণবিজ্ঞাপন, বৃহৎ বিক্রয় বাহিনীর কোনটাই ব্যবহার করেনি, অথচ তারা সফল মার্কেটার। সীমিত সম্পদ নিয়ে ক্রেতার খুব কাছে অবস্থান করে, তাদের প্রয়োজনের সবচেয়ে সন্তোষজনক সমাধান দিচ্ছে অনেক কোম্পানি। অনেক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত সনাতন মার্কেটিংয়ের সব প্রথা ভেঙ্গে সফল হচ্ছে। বই-পুস্তকে সুপারিশকৃত পথ (দঝঞচ’, ৪চং, ব্র্যান্ডিং) না মাড়িয়ে সৃজনশীল পথে সফলতা এনেছে। অনেক সফল কোম্পানি আছে যারা ব্যয়বহুল গবেষণা ও বিজ্ঞাপনে একেবারেই সময় এবং অর্থ বিনিয়োগ না করে ক্রেতা ক্লাব প্রতিষ্ঠা, সৃজনশীল গণসংযোগ, ক্রেতাবান্ধব ভ্যালু ডেলিভারি পদ্ধতি এবং দীর্ঘ ক্রেতা আনুগত্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়েছে। সফল হতে হলে সবাইকে ‘চ্এ’ বা টহরষবাবৎ-কে অনুসরণ না করলেও চলবে। যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে অন্তঃউদ্যোগী বাজারজাতকরণ (ওহঃৎবঢ়ৎবহবঁৎরধষ গধৎশবঃরহম)। অন্তঃউদ্যোগী বাজারজাতকরণ হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের ফর্মুলার সঙ্গে (ঋড়ৎসঁষধঃবফ গধৎশবঃরহম) সৃজনশীলতার কার্যকর মিশ্রণ। সৃজনশীল ব্যক্তিরা মেধার ওপর নির্ভর করেই বাঁচে। তারা সুযোগের পূর্বানুমান করতে পারে এবং নিজেকে তার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে। সৃজনশীলতা একটি নিরন্তর প্রচেষ্টা। কেবল মার্কেটিং বই পড়ে সেটা অর্জন সম্ভব নয়। জ্ঞানের রাজ্যে উদ্দেশ্যহীন অক্লান্ত ভ্রমণকারীরাই বেশি সৃজনশীল হয়। নতুন বাস্তবতায় সূত্রবদ্ধ মার্কেটিং (ঋড়ৎসঁষধঃবফ গধৎশবঃরহম) ব্যবহার করে এখনও হয়ত কেউ কেউ টিকে আছে, তবে আশঙ্কা তারা সহসাই পথ হারাবে। অধিকতর সৃজনশীলতার অনুশীলনের মাধ্যমে উদ্ভাবনই হচ্ছে আগামী দিনের মার্কেটিং (গধৎশবঃরহম ঘবীঃ). লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়
×