ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলাম বনাম সন্ত্রাস শীর্ষক আলোচনা সভা

ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করছে তাদের প্রতিরোধ করাও ধর্মীয় কাজ

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৩০ জুন ২০১৮

  ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করছে তাদের প্রতিরোধ করাও ধর্মীয় কাজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইসলাম ধর্মে সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই। রাজনীতিতে ধর্মের কোন স্থান নেই। কোরানে রাজনৈতিক ইসলামের উল্লেখ নেই। ফায়দা হাসিলের আশায় ধর্মের নামে যারা রাজনীতি করছে তাদের প্রতিরোধ করাও ধর্মীয়কাজ। দেশ স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু জিয়া ও এরশাদ ক্ষমতায় এসে তা বিনষ্ট করেছেন। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের কারণেই আজ ইসলামের নামে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। ইসলাম ধর্মের মূল বিষয় মানলে আজ দেশে ধর্মের নামে এতো বিদ্বেষ ছড়াত না বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। শুক্রবার শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরে ইসলাম বনাম সন্ত্রাস শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তারা এই মন্তব্য করেন। ইতিহাস সম্মিলনী পরিষদের পক্ষ থেকে জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে একক বক্তব্য উপস্থাপন করেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক বাহারউদ্দিন। বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক গবেষক ও চলচ্চিত্রকার শাহরিয়ার কবির। একক বক্তৃতায় বাহারউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাকে বাধ্য করেছে ইসলামের নামে সন্ত্রাস রুখতে। নবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) বিশ্বব্যাপী কল্যাণের আহ্বান করেছেন। যেভাবে রবীন্দ্রনাথ তার কবিতার মাধ্যমে সেই একই কল্যাণের আহ্বান করেছেন। তিনি বলেন, মক্কায় অবতীর্ণ হওয়া সূরার সঙ্গে মদীনায় অবতীর্ণ হওয়া সূরার কতগুলো পার্থক্য রয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ সূরায় যেখানে নরম ভাষায় কথা বলা হয়েছে মদীনায় অবতীর্ণ সূরার ভাষা তার চেয়ে অনেকটাই কঠোর। আজ জঙ্গী সন্ত্রাস এবং ওহাবীবাদীরা এটাকে তাদের নিজের ভাষায় ব্যবহার করে। এটাকে ব্যবহার করে মানুষের মাঝে তারা এক ধরনের অদ্ভুত ভাবাবেগের অবতারণা করে সন্ত্রাসের পথে চালিত করছে। তিনি বলেন, বর্তমানের রাজনৈতিক ইসলাম ইসলামের কোন ভিত্তি ছিল না। ধর্মে জিহাদ ও যুদ্ধ সম্পূর্ণ আলদা বিষয়। জিহাদ ব্যক্তি মানুষের আত্মাকে শুদ্ধ করার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আজ যারা মনে করছেন ইসলাম তরবারির জোরে রাজ্য বিস্তার করেছে তাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বরং রাজ্য জয়ের চেয়ে ওই সময়ে আরবদের বাণিজ্য বিস্তার বেশি ঘটেছে। আজকের ইউরোপে রাজনৈতিক ইসলামের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা ইসলামে ছিল না। এর সূত্রপাত হয়েছে ওয়াহাবী আন্দোলনের মাধ্যমে। উপমহাদেশে যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছিল জিন্নাহ যখন কোন সামাজিক ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না তখন মওদুদী সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামী গঠন করেন। তার চিন্তা ছিল যখন আমরা দুর্বল অবস্থায় থাকব ইসলামের দাওয়াত বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছাব। আবার যখন সাংগঠনিক অবস্থায় শক্তিশালী হব তখন যুদ্ধে নেমে পড়ব। তিনি বলেন, আজ ইসলামের নামে দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে লড়তে হলে ইসলামের প্রাথমিক সোর্স থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে ধর্মের চর্চা হওয়া দরকার। অর্থনেতিক বিকাশের সঙ্গে বুদ্ধির বিকাশ হয়েছিল বলেই আজ আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছেছি। ইসলাম ধর্মের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আজ তাই গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হলে আগে তুলনামূলক ইসলামের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, কোরানে যা বলা হয়েছে, ওয়াহাবীরা যেভাবে কোরানের ব্যাখ্যা দেন সূফীবাদী ব্যাখার সঙ্গে তার কোন মিল নেই। তরবারির জোরে যেখানে ইসলামের প্রচার ব্যর্থ হয়েছে সেখানে সূফীবাদীর মাধ্যমে আজ সারা বিশ্বে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে। সূফীবাদ যেখানে পৌঁছেছে সেখানেই তারা দেশীয় লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামের মিশ্রণ ঘটিয়েছে। এ কারণে ইন্দেনেশিয়া, ভারত এবং চীনের ধরন অনেকটাই আলাদা। তিনি বলেন, কোরানে সহনশীল অনেক উপাদান রয়েছে। বিশেষ করে মক্কায় অবতীর্ণ সূরা অনেকটা সহনশীল। নবী মদীনায় বার বার আক্রান্ত হচ্ছিলেন বলেই তাকে অনেক কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। কিন্তু মদীনা সনদে আবার সবার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এই সনদ অনুযায়ী মুসলমানরা আক্রান্ত হলে অমুসলিমদের সহায়তা করতে আবার অমুসলিমরা আক্রান্ত হলে মুসলমানদের সহায়তার কথা বলা হয়েছে। আজ যে রাজনৈতিক ইসলামের ব্যবহার তা কোরানে উল্লেখ নেই। যদি এর উল্লেখ থাকত তাহলে নবীর মৃত্যুর পর খলীফা নির্বাচনের বিষয়টি উল্লেখ থাকত। নবী মৃত্যুর আগে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার মনোনীত করেননি। পরবর্তীদের ওপর এর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার নিযুক্ত করে গেছেন। সেখান থেকেই আজকে সূফীবাদীর উৎপত্তি হয়েছে। তিনি বলেন, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশলে ধর্মকে সন্ত্রাসের জায়গায় নিয়ে আসবে। সূফীরা ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন। এ কারণে ওহাবীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন বারবার। ইসলামে তিন ধরনের জিহাদের কথা বলা হয়েছে। এক নম্বর হলো নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই, দ্বিতীয়ত অন্যকে ইসলামে শান্তিপূর্ণভাবে আমন্ত্রণ জানানো এবং তিন নম্বর হলো কোন অমুসলিম দেশে মুসলিমরা আক্রান্ত হলে জিহাদের কথা বলা হয়েছে। এটাকে তৃতীয় শ্রেণীর জিহাদ বলা হয়েছে। কিন্তু আজ ওয়াহাবীরা এটাকে এক নম্বর জিহাদে পরিণত করেছেন। এ কারণে মওদুদীরা জিহাদের ফতোয়া দিচ্ছেন। শাহরিয়ার কবির বলেন, আজ সব ধর্মেই ধর্মের সীমা অতিক্রম করা হচ্ছে। ভারতেও ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলার নীতির মধ্যে ধর্মের জায়গা করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজ ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস করছে তারা হলো মওদুদী এবং সালাফী। এটাকে মোকাবেলা করতে হলে ধর্মীয়ভাবে করতে হবে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ইসলামের দর্শন বঙ্গবন্ধু যেভাবে ধারণ করেছিলেন জিয়া ও এরশাদ তা বিনষ্ট করে দিয়েছেন। এরশাদ রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম সংবিধানে চাপিয়ে দিয়েছেন। জিয়া বিসমিল্লাহ চাপিয়ে দিয়েছেন। আজ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে মৌলবাদের উন্নয়ন ঘটে তাহলে দাঁড়াতে পারব না। ধর্মের মূল বিষয় মানলে আজ ইসলামের নামে এতো বিদ্বেষ হতো না। ইসলামীকরণ দেশে বাড়ছে। সব ধর্মই ধর্মীয় সীমা থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের জন্য এটা শুভ নয়। তিনি বলেন শেখ হাসিনাই আজ একমাত্র নেত্রী যিনি মৌলবাদীদের কঠোরভাবে দমন করছেন। কিন্তু শুধু রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে এটাকে দমন করলে হবে না। আদর্শিক শিক্ষার মাধ্যমে দমন করতে হবে।
×