ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী

ব্যাংক পরিচালকদের যোগসাজশের ‘ঋণ’ বন্ধে সংস্কার আসছে

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৩০ জুন ২০১৮

  ব্যাংক পরিচালকদের যোগসাজশের ‘ঋণ’ বন্ধে সংস্কার আসছে

রহিম শেখ ॥ যিনি যে ব্যাংকের পরিচালক, তার সেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ খুব সামান্য। নিজেরা পরিচালক এমন ২৯টি ব্যাংক থেকে তিন হাজার ৮২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তারা। আর নিজে পরিচালক নন এমন ৫৩টি ব্যাংক থেকে তারা নিয়েছেন এক লাখ ৪৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে অন্য ব্যাংক থেকে নেয়া চার হাজার কোটি টাকার পুরোটাই খেলাপী। মূলত পরিচালক হওয়ার সুবাদে তারা তুলনামূলক কম সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন। কোন ঝামেলা ছাড়াই ঋণ অনুমোদন করিয়ে দেন। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে পরিশোধের সক্ষমতার তুলনায় বেশি ঋণ পেয়ে যান অনেক পরিচালক। এই অবস্থায় যোগসাজশের মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালকদের নেয়া ঋণ বন্ধে আগামী মাসে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার আনার কথা জানিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রী। জানা গেছে, ব্যাংকের পরিচালকরা যাতে জোরজবরদস্তি করে নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পারেন সে জন্য নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের ঋণ নেয়ার পরিমাণ সীমিত করে একটি নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, নিজে যে ব্যাংকের পর্ষদে রয়েছেন ওই ব্যাংক থেকে ধারণ করা শেয়ারের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারেন একজন পরিচালক। এ রকম ঋণ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বিএসইসিকে জানাতে হয়। পরিচালকের নেয়া ঋণ শেষ পর্যন্ত খেলাপী হয়ে গেলে তার শেয়ার বাজেয়াফত করে ঋণের টাকা সমন্বয় করার বিধান রয়েছে। এ সব কারণে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে তেমন আগ্রহ দেখান না পরিচালকরা। এ কারণে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালক ধরে সেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। আবার নিজের ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালককেও ঋণ পাইয়ে দিচ্ছেন। এভাবে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিলেও এর বিপরীতে তেমন কোন জামানত রাখছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর পরিচালকের সংখ্যা এখন প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে সমঝোতাভিত্তিক বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন শতাধিক পরিচালক। যাদের অধিকাংশই বড় বড় ব্যবসায়ী। তাদের ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক হওয়ায় অনায়াসে এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে পারছেন তারা। তা ছাড়া সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তারা অন্যান্য সাধারণ ঋণগ্রহীতার চেয়ে সস্তায় ঋণ পাচ্ছেন। এত সুবিধা পাওয়ার পরও অনেক পরিচালক ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছেন না। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী একটি ব্যাংকের পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরিচালকদের ঋণ নেয়ার যে নীতিমালা রয়েছে, সেই নীতিমালা মেনেই সবাই ঋণ নেন। এছাড়া, পরিচালকদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী। ফলে যে কেউ নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে যেকোন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন। এতে দোষের কিছু নেই। তবে সমঝোতা করে একজন আরেকজনের ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। জানা গেছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এক পরিচালকের প্রাইম ব্যাংক থেকে নেয়া ৭৩ কোটি টাকার ঋণ সম্প্রতি খেলাপী হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় টাকা আদায় করতে না পেরে সম্প্রতি প্রাইম ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবিরের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে এ বিষয়ে কী করণীয় জানতে চেয়ে। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক পরিচালকরা পারস্পরিক যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। পরিচালক হওয়ার সুবাদে তারা তুলনামূলক কম সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন। কোন ঝামেলা ছাড়াই ঋণ অনুমোদন করিয়ে দেন। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে পরিশোধের সক্ষমতার তুলনায় বেশি ঋণ পেয়ে যান অনেক পরিচালক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যিনি যে ব্যাংকের পরিচালক, তার সেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ খুব সামান্য। নিজেরা পরিচালক এমন ২৯ ব্যাংক থেকে তিন হাজার ৮২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তারা। আর নিজে পরিচালক নন এমন ৫৩ ব্যাংক থেকে তারা নিয়েছেন এক লাখ ৪৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। খেলাপী হয়ে যাওয়া চার হাজার টাকার সবই অন্য ব্যাংকে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, খেলাপী ব্যক্তি কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে বা থাকতে পারবেন না এমন নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু অসাধু এসব পরিচালক ঋণখেলাপী হওয়ার পরও পদ ধরে রাখতে আদালতের দ্বারস্ত হচ্ছেন। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে অনেক পরিচালক পদে বহাল আছেন। এ নিয়ে পাওনাদার ব্যাংকগুলোকে শেষমেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চেয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। কেননা ব্যাংক পরিচালকদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্যদিকে পরিচালকদের বেনামি ঋণও রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারী একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, বিশেষ সুবিধা বা যোগসাজশের মাধ্যমে পরিচালকরা ঋণ নেয়ার বিষয়ে এমডিরা অবহিত। তবে মালিক পক্ষের চাপে অনেক সময় তাদের এ রকম অনৈতিক কাজ করতে হয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যবসার জন্য পরিচালকরা ঋণ নিতেই পারেন। এসব ঋণ যথাযথভাবে হচ্ছে কি-না তা তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ একটি সেল গঠন করা যেতে পারে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জানান, এ সময় সমঝোতার মাধ্যমে অনৈতিক ঋণ দেয়া-নেয়ার অভিযোগে ৩৪ ব্যাংক পরিচালককে অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সে ধরনের উদ্যোগ আর দেখা যায়নি। এই অবস্থায় যোগসাজশের মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালকদের নেয়া ঋণের লাগাম টানতে চাইছে খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার ব্যাংকিং খাতে এমন সংস্কার আনার কথা জানিয়েছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, ব্যাংক খাত নিয়ে সমালোচনার জবাব যথা সময়ে দেব। এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছি। জুলাইয়ে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসব। ব্যাংকের লুটপাটের বিষয়ে তিনি বলেন, লুটপাট মানে ব্যাংকের সম্পদ পরিচালকরা নিয়ে নিচ্ছেন। এমনটি হচ্ছে না। তবে এ ক্ষেত্রে একটা খারাপ দিক রয়েছে। সেটি হচ্ছে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে সমঝোতা করে ঋণ নিয়ে নিচ্ছেন। ‘আমি এক ব্যাংকের পরিচালক হয়ে অন্য ব্যাংক থেকে কিছু কনফ্লিক্ট ইস্যু থাকা সত্ত্বেও ঋণ নিয়ে নিচ্ছি। এসব বিষয়ে জুলাইয়ের মধ্যে কিছু একটা করব। এ বিষয়ে আমারা মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছি।
×