ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে...

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৩০ জুন ২০১৮

যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে...

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর এত যে আবেগ, কোথা থেকে আসে? না, এই প্রশ্নের এককথায় উত্তর হয় না। তবে বর্ষার নবধারা জল আবেগ ভালবাসাকে উস্কে দেয়, উস্কে যে দেয়, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। রিমঝিম বৃষ্টি হৃদয়ের গভীর গোপন সেতারটি বাজিয়ে দিয়ে যায়। শীতল জল গায়ে মাখতেই কেমন যেন পুলক অনুভূত হয়। বর্ষার নবধারা জলে স্নান করে প্রকৃতিও। সারাবছর গাছের সবুজ পাতায় যত ধুলোবালি জমে, বৃষ্টির জলে তা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। হাঁটার অমসৃণ পথগুলোও ঘরের মেঝের মতো ঝকঝকে তকতকে মনে হয়। সঙ্গত কারণেই বর্ষা খুবই প্রিয়। বছর ঘুরে আবারও এসেছে আষাঢ়। শুরু হয়েছে বর্ষাকাল। তবে এ বছর প্রথম দিন বর্ষা বরণের তেমন কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। ঈদের কারণে উৎসব অনুষ্ঠানের তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর তার পর শুক্রবার চারুকলার বকুল তলায় হলো বর্ষা বন্দনা। সকালে এখানে বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন করে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। প্রতি বছরের মতোই সঙ্গীত নৃত্য কবিতার ভাষায় বরণ করে নেয়া হয় প্রিয় ঋতুকে। সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। উন্মুক্ত মঞ্চে তখন শিল্পী শেখর মন্ডল। কণ্ঠে তার বর্ষার রাগ। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল রাগের পরিবেশনা। এ সময় তবলায় ছিলেন বাদল চৌধুরী। দুজনে মিলে সকালটা মোটামুটি ভরিয়ে দেন। ততক্ষণে প্রস্তুত হতে থাকেন অন্য শিল্পীরাও। বাঙালীর দুই প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বর্ষায় বুঁদ হয়ে ছিলেন। প্রিয় ঋতু নিয়ে কত না গান কবিতা তারা লিখে গেছেন। সেই সব গানে বর্ষা বন্দনা করেন পরবর্তী শিল্পীরা। রবীন্দ্রনাথের বর্ষা পর্যায়ের গান থেকে গেয়ে শোনান ফাহিম হোসেন চৌধুরী। তার কণ্ঠে ছিলÑ ‘পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ মরি মরি...।’ সরাসরি বর্ষাকে পাওয়া হয় অনিমা রায়ের কণ্ঠে। কবিগুরু থেকে তিনি গেয়ে শোনান, ‘বহু যুগের ও পার হতে আষাঢ় এল আমার মনে/কোন্ সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষনে...। নজরুলের গানের শিল্পী লীনা তাপসী খানকে এই মঞ্চে খুব সম্ভবত প্রথমবার পাওয়া। তিনি বর্ষায় নজরুলের মনের বেদনখানী তুলে ধরেন। গেয়ে শোনান ‘যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে/আমার বিরহ-লিপি লেখা কেয়া পাতে...। সুমন মজুমদার গেয়ে শোনান নজরুলের অত্যন্ত জনপ্রিয় গান ‘শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এলো না।’ আরিফ রহমান, আবিদা রহমান সেতু, আঁখি বৈদ্য, রত্মা সরকারও একক কণ্ঠে বর্ষা বন্দনা করেন। দলীয় সঙ্গীতেও বর্ষার রং রূপ তুলে ধরা হয়। স্বভূমি লেখকশিল্পী কেন্দ্র পরিবেশন করে জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত। ‘কলকল ছলছল নদী করে টলমল’ শুনে মন কেমন যেন নেচে ওঠে। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথ থেকে গেয়ে শোনায় ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা’ গানটি। নিজেদের পছন্দের গানে বর্ষা বন্দনা করেন বহ্নিশিখা ও পঞ্চভাস্বরের শিল্পীরা। উৎসব যেহেতু, নাচ না হলেই নয়। বেশ কয়েকটি দল অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বর্ষা সঙ্গীত। আর মঞ্চে কোরিওগ্রাফি। ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে’ গানের সঙ্গে সুন্দর নাচ উপহার দেয় নৃত্যজনের শিল্পীরা। নটরাজের শিল্পাীরা হয়েছিলেন মেঘের সঙ্গী। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানের সঙ্গে নাচেন তারা। নজরুলের ‘এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া’ গানের সঙ্গে নাচ করেন বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইনআর্টস্ বাফার শিল্পীরা। বর্ষাকে দারুণভাবে প্রস্ফুটিত করেছে কবিতা। বাংলার কবিরা হৃদয়ের আবেগ দিয়ে বর্ষাকে সাজিয়েছেন। বর্ণনা করেছেন। উৎসবে তাই যথারীতি ছিল আবৃত্তি। একক আবৃত্তি পরিবেশন করবেন জনপ্রিয় কণ্ঠ মাশকুর-এ-সাত্তার কল্লোল। বর্ষাকে বর্ণনা করতে তিনি বেছে নেন নির্মলেন্দু গুণের কবিতা। নায়লা তারাননুম চৌধুরী কাকলি মঞ্চে আসেন জয়গোস্বামীকে নিয়ে। এই মঞ্চে বহুবার শোনা ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা’ আবারও আবৃত্তি করেন তিনি। এ সবেরই এক ফাঁকে ছিল ছোট্ট আলোচনা। অবশ্য আলোচনাটিকে আয়োজকরা ‘বর্ষাকথন’ নাম দিয়েছেন। এ পর্বে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান ও সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। আয়োজক সংগঠনের সহ-সভাপতি নিগার চৌধুরীর সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট। গাছের চারা বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসব। নাগরিক জীবনে এমন উৎসব আরও হোক। প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখুক শহুরে প্রজন্ম। বর্ষার বৃষ্টিকে অনুভব করুক তারা। বর্ষা উৎসবের মধ্য দিয়ে এই যেন বলতে চাইলেন আয়োজকরা।
×