ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গণপূর্তের জমি ভরাট করে ‘মাইলস্টোন মিমি হোমস’ সাইনবোর্ড

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩০ জুন ২০১৮

   গণপূর্তের জমি ভরাট করে ‘মাইলস্টোন মিমি হোমস’ সাইনবোর্ড

ফিরোজ মান্না ॥ জমি গণপূর্ত অধিদফতরের। ভরাট করছে ঢাকা বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানির সিস্টেম অপারেশন ও স্কাডার (ডিপিডিসি) সাবেক প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে একটি প্রভাবশালী গ্রুপ। জমি উদ্ধারে গণপূর্ত অধিদফতর আইনের আশ্রয় নিয়েছে। গণপূর্ত অধিদফতর থানায় মামলা করেছে। কিন্তু মামলা করেও কোন লাভ হয়নি। প্রভাবশালী ওই মহল রাতের আঁধারে মাটি ভরাটের কাজ চালিয়েই যাচ্ছে। পুলিশ বলছে, দিনে জায়গাটিতে মাটি ভরাটের কাজ বন্ধ রয়েছে। রাতে কি হয় না হয় তা তারা জানে না। জানা গেছে, রাজধানীর খিলগাঁও মৌজার ২৫৪, ২৫৫, ২৫৬, ২৫৭ ও ২৫৮ সি এস দাগ নম্বারে গণপূর্ত অধিদফতরের দুই একর রয়েছে। জমিটি নিচু এলাকা বলে কোন স্থাপনা নেই এখানে। হঠাৎ করে এ জায়গা ভরাট শুরু করা হয়। বিষয়টি স্থানীয়রা গণপূর্ত অধিদফতরকে জানায়। ঝিল ভরাট বন্ধে এলাকার ২৯ জন বাড়ির মালিক স্বনামে স্বাক্ষর করে একটি চিঠি দেন গণপূর্ত অধিদফতর সার্কেল-৪। ওই চিঠিতে বলা হয়, তারা খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকায় বরাদ্দকৃত প্লটের মালিক। ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে তারা সেখানে আছেন। বর্ষাকালে এই এলাকার পানি ঝিল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রামপুরা এলাকা দিয়ে সরে যায়। এই ঝিল ভরাট হলে বর্ষায় পানি জমে এলাকায় মারাত্মক জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে জনদুর্ভোগ বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে ঝিল ভরাট শুরু করায় আশপাশের বাড়ির নিচতলায় ঝিলের পানি ঢুকে পড়েছে। কয়েকটি বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়ারা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। এলাকাবাসীর কাছ থেকে চিঠি পেয়ে গণপূর্ত বিভাগ-৪ সরেজমিনে পরিদর্শন করে। এরপর অভিযোগের সত্যতা পেয়ে রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে। গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, খিলগাঁও এলাকার নিচু জায়গাটি গণপূর্ত বিভাগের মালিকানাধীন। খিলগাঁও মাটির মসজিদ সংলগ্ন ওয়াসার ৭ নম্বর পানির পাম্পের পাশের এই নিচু জমি একটি প্রভাবশালী পক্ষ ভরাট করা শুরু করে ‘মাইলস্টোন মিমি হোমস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে। ‘মাইলস্টোন মিম টাওয়ারে’র ওই সাইনবোর্ডে ৭২ জন সম্ভাব্য ফ্ল্যাট মালিকের নামের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় সম্ভাব্য ফ্ল্যাট মালিক হিসেবে প্রথম নাম উল্লেখ করা হয় আবু জাফর মোঃ সালেহ, মোঃ মসিয়ার রহমান, এস এম আল হেলাল, মোঃ অলিউল্লাহ, রায়হানা বিনতে জহির, মোঃ দেলোয়ার হোসেন, মোসাঃ মৌসুমীসহ ৭২ জনের। যাদের কারও বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। ঢাকা বিদ্যুত বিতরণ কর্তৃপক্ষের অধীনে সিস্টেম অপারেশন এবং স্কাডা (ডিপিডিসি)-এর সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার আলী মনসুর আহমেদের নেতৃত্বে চলছে ভরাট কাজ। ঝিলের আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাটি ভরাটের আগে ঝিলের ওপর বাঁশ ও টিনের ঘর করে ভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন আতিক, বাবু, জয় ও মিজান (মৃত) নামের পাঁচজন। এ্যাপার্টমেন্ট তৈরির জন্য মাটি ফেলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এসব বাড়িতে ভাড়া থাকা মানুষদের সরিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয়দের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়ে অবৈধ ভরাটকারীদের সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে জানতে পারে গণপূর্ত বিভাগ। পরে তারা রামপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। জিডিতে বলা হয়, ঢাকাস্থ খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকার প্লট নং বি/২১৮, বি/২১৯, বি/২২০, বি/২২১, বি/২২২ এর পেছনে, শহর খিলগাঁও মৌজার সি এস দাগ নম্বর ২৫৪, ২৫৫, ২৫৬, ২৫৭ ও ২৫৮ এর প্রায় দুই একর সরকারী ঝিলের জমিতে জনৈক আবু জাফর মোঃ সালেহ গংসহ ৭২ জন ‘নির্মাণাধীন ফ্ল্যাট মালিকগণের নাম’ শিরোনামে একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। জনৈক আবু জাফর মোঃ সালেহ গং সরকারী জমিতে বিনা অনুমতিতে অবৈধভাবে মাটি ভরাট করছেন। গণপূর্ত অধিদফতরের উপসহকারী প্রকৌশলী সরেজমিনে গিয়ে ঝিল ভরাট করতে নিষেধ করে এসেছেন। এরপরও ঝিল ভরাট চলছে। গণপূর্ত বিভাগের সাধারণ ডায়েরির অনুলিপি, জায়গার নকশা এবং সাইনবোর্ডের ছবিসহ ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল ২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বরাবর চিঠি দেয়া হযেছে। এরপরও প্রভাবশালীদের মাটি ভরাট কাজ চলছেই। রাতের বেলায় মাটির ট্রাক, বুলডোজার চালিয়ে মাটি ভরাট করে যাচ্ছে। খিলগাঁও এলাকার ক্যাবল ব্যবসায়ী মোঃ আসাদুজ্জামান মানিক বলেন, ইঞ্জিনিয়ার আলী মনসুর আহমেদ খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকার জমির ভুয়া কাগজপত্র এবং ভুয়া দলিল দাতা সাজিয়ে আমার কাছ থেকে ৬৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার আলী মনসুর আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন কার্ডধারী ব্যক্তি। তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। অভিযোগ উঠেছে, প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ তিনি দ্রুততর সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সরকারী চাকরি থেকে এলপিআরে চলে যাওয়ায় আলী মনসুরও যে কোন সময় বিদেশ পালিয়ে যেতে পারেন। এ বিষয়ে জানতে ইঞ্জিনিয়ার আলী মনসুর আহমেদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি তার মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়েও কোন সাড়া মেলেনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রামপুরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হুমায়ুন কবির বলেন, শুরু থেকে মামলাটির তদন্ত করেছেন এসআই কামরুল ইসলাম। জিডির তদন্তও তিনি করেছেন। সম্প্রতি তার বদলিজনিত কারণে মামলাটির তদন্তও আমাকে দেয়া হয়েছে। এখনও সঠিকভাবে মামলার ডকেট পর্যালোচনা করতে পারিনি। তবে এটুকু নিশ্চিত হয়েছি, ওই জমি সরকারের। প্রভাবশালী একটি গ্রুপ ওই জমি দখলের চেষ্টা করছে। মামলা হওয়ার পর পুলিশ এক আসামিকে গ্রেফতার করেছে। এরই মধ্যে ওই আসামি জামিনে বেরিয়েও এসেছে। তবে পুলিশের তৎপরতার কারণে বর্তমানে ওই জমিতে মাটি ভরাট বন্ধ আছে। গণপূর্ত অধিদফতরের সার্কেল ৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর বলেন, দখলদারদের হাত থেকে জমিটি পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
×