ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটের মেয়র পদে বিএনপিকে ছাড় দেবে না জামায়াত

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩০ জুন ২০১৮

   সিলেটের মেয়র  পদে বিএনপিকে  ছাড় দেবে না  জামায়াত

শরীফুল ইসলাম ॥ পারস্পরিক রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে গত ক’বছর ধরেই বিএনপির সঙ্গে তাদের দীর্ঘকালের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের মনকষাকষি চলছে। তবুও বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থে কেউ কাউকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে না; বরং গোপন বৈঠকের মাধ্যমে পরস্পরের দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেয়র-কাউন্সিলর পদ নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় বিএনপির প্রতি ক্ষেপেছে ২০ দলের জোট সঙ্গী জামায়াত। আসন্ন তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত একটিতে মেয়র পদে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু বিএনপি জামায়াতের এই আগ্রহকে পাত্তা না দেয়ায় ক্ষেপে যায় জামায়াত। তারা সিদ্ধান্ত নেয় সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করার। এরই অংশ হিসেবে সিলেটে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে জামায়াতের মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সিলেটে জামায়াতের মেয়র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগে থেকেই তাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে বিএনপি। কিন্তু তারা বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণে সমঝোতায় রাজি হয়নি। এ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির কিছু সিনিয়র নেতা দফায় দফায় জামায়াত নেতাদের সঙ্গে কথা বলেও সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে সিলেটে জামায়াতের মেয়র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের চেষ্টা করছেন। তবে এখন পর্যন্ত তারেক রহমানও জামায়াতকে বাগে আনতে পারেননি বলে জানা গেছে। জানা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকালে প্রথমে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন করে বিএনপি ও জামায়াত উভয়েই ভাল ফল করলেও এক পর্যায়ে সেই সমঝোতায় চিড় ধরে। তবুও বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় জামায়াতের রাজপথের আন্দোলনে বিএনপির সক্রিয় সমর্থন না থাকা এবং ২০১৫ সালের টানা ৯২ দিনের আন্দোলনের পর থেকে বিএনপির রাজপথের কর্মসূচীতে জামায়াতের সক্রিয় সমর্থন না থাকায় দুই দলের মধ্যে সম্পর্কে কিছুৃটা চিড় ধরে। তবুও ভেতরে ভেতরে সমঝোতা করে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে দুই দল। খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ছাড় দিয়ে বিএনপির কাছে ৫টি করে ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদ চেয়েছিল জামায়াত। কিন্তু প্রথমে আশ্বাস দিয়েও শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে ছাড় দেয়নি বিএনপি। এ কারণে আগে যে কোন নির্বাচনের দিনে জামায়াতের নেতাকর্মীরা ভোট শুরুর দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেন্দ্রের আশপাশে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে সরব থাকলেও এবার সেভাবে মাঠে নামেনি। এর আগে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর এ সিটিতে নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলে মেয়র পদে জামায়াত তাদের দলের প্রার্থী ঘোষণা করে দলের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনকে। অবশ্য পরে বিএনপি নেতারা জামায়াত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলে জামায়াত বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দেয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। এর আগে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও মেয়র প্রার্থী নিয়ে বিএনপি জামায়াতের মধ্যে মনকষাকষি হয়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগেও সেখানে প্রথমে দলীয় মেয়র প্রার্থী দিয়েছিল জামায়াত। পরে বিএনপির অনুরোধে জামায়াত আর প্রার্থী দেয়নি। তবে সিলেটের বেলায় এমনটি হবে না বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে প্রধান বাধা জামায়াত। তবে দলটির রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কিছুতেই জামায়াত ছাড়তে পারছে না বিএনপি। এ কারণে সরকার ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বিএনপির ঐক্যের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তবে বাস্তবতার নিরিখে বিএনপির ডাকে ঐক্য হচ্ছে না এমনটি মাথায় রেখেই দলের বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি কাটিয়ে তুলতে এমন রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। গুলশানে জঙ্গী হামলার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় ঘরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। বিশেষ করে সরকারী দলের পক্ষ থেকে বিএনপি ও জামায়াতকে নিয়ে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়। সূত্র মতে, জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি মাঝে মধ্যে চাপের মুখে পড়লেও আপাতত এ দলটির সঙ্গ ত্যাগ নয়;বরং কৌশলে সাইড লাইনে রাখতে চায় তারা। সে ক্ষেত্রে ভেতরে ভেতরে সমঝোতা করে সব রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করলেও প্রকাশ্যে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে চায় বিএনপি। আর জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির আরেকটি কৌশলের মধ্যে রয়েছে দলের বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগিয়ে জামায়াতের নতুন প্রজন্মের নেতাদের দিয়ে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য ক্ষমা প্রকাশের মধ্য দিয়ে এ দলটিকে রাজনীতিতে টিকিয়ে রাখা। বিএনপির আরও একটি কৌশলের মধ্যে রয়েছে জামায়াতকে দিয়ে ২ দলের মধ্যে প্রকাশ্য দূরত্ব বজায় রেখে গোপনে সখ্যতা বজায় রাখা। কিন্তু জামায়াত বিএনপির এ কৌশলটি পছন্দ করছে না। আর এ কারণেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির প্রতি ক্ষেপেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর চারদলীয় জোটের শরিকদল বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার দাবি করে। বিশেষ করে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা দলের পরাজয়ের জন্য জামায়াতকে দায়ী করে চারদলীয় জোট থেকে এ দলকে বাদ দেয়ার জোর দাবি জানায়। কিন্তু ভোটব্যাংক ও মাঠের আন্দোলনের কথা চিন্তা করে জামায়াত ছাড়ার চিন্তাও করেনি বিএনপি হাইকমান্ড। প্রসঙ্গত ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০০০ সালের শেষ দিকে বিএনপির নেতত্বে চারদলীয় জোট গঠন করা হয়। এতে স্থান পায় জামায়াত, বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজোট। এরপর জোটের পরিধি বৃদ্ধি করে ১৮ দলীয় জোট গঠন করা হয়। পরে আরও ২টি দলকে নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট গঠন করা হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে বিএনপি। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মন্ত্রীত্ব দেয়া হয়। এ নিয়ে তখনই বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা নেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করলেও এক পর্যায়ে দলের স্বার্থে চুপ হয়ে যায় তারা। ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এর মধ্যে পূর্বনির্ধারিত দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপিকে ছাড় দেবে না ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াত। জামায়াতের সিলেট মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বিএনপিকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন। ২৭ জুন বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জোট থেকে জামায়াতের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার দাবি জানিয়ে বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই গুলশান কার্যালয় ত্যাগ করেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিম। জোটের বৈঠক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বের হয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিম সাংবাদিকদের বলেন, সিলেটে জামায়াতের মেয়র প্রার্থী দেয়ার দাবি বিএনপি মহাসচিবকে জানিয়েছি। আমরা সেখানে প্রার্থী দিয়েছি তাই বিএনপিকে ছাড় দেয়া যাবে না। আশা করি বিএনপি আমাদের সবখানে ছাড় দেবে। জামায়াতের দাবি সব সময় তারা বিএনপিকে ছাড় দিলেও বিএনপি তাদের ছাড় দেয় না। এ ছাড়া সিলেটে বিএনপির চেয়ে জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থা ভাল। তাই ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতের প্রার্থীকে সমর্থন দিলে জয়ের ব্যাপারে তারা আশাবাদী। দলটির নেতারা আরও বলছে, খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপিকে শুধু ছাড়ই দেয়নি জামায়াত। তারা বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ভোটও চেয়েছে। তাই আসন্ন ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে সিলেটে মেয়র পদটি তারা চায়। জানা যায়, ২২ জুলাই অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের বৈঠকেও এ দাবি জানিয়েছে জামায়াত। তাদের দাবির পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, আমরা জোটে আছি। সব সময় আমরা ছাড় দেব, বিএনপি আমাদের একটাও ছাড়বে না, এটাতো হতে পারে না। ওই বৈঠকে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় ২৭ জুনের বৈঠকটি ডাকা হয়। এ বৈঠকে জামায়াতের পক্ষ থেকে বিএনপিকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয় সিলেটে তাদের প্রার্থী নির্বাচন করবে। অন্য দুই সিটি রাজশাহী ও বরিশালে যদি তাদের সমর্থন পেতে হয়, তাহলে তাদের একটা ছেড়ে দিতে হবে। এদিকে সিলেটে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে আবারও মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তাই সিলেটে মেয়র পদে কোন অবস্থাতেই জামায়াতকে ছাড় দেবে না বিএনপি। তবে সিলেট সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বর্তমানে যে দূরত্ব তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে না পারলে দুই দলের সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জামায়াত ২০ দলীয় জোটের শরিক দল। জোটের পক্ষ থেকে সিলেটে মেয়র পদে আরিফুল হক চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তাই জামায়াত এ সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন বলে আমরা আশাবাদী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, সিলেট সিটি কর্পোরেশনে জামায়াত মেয়র পদে প্রার্থী দিলেও আমরা আশা করছি তারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করবেন। এখনও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় আছে তাই এটি কোন সমস্যা হবে না।
×