ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাইভেটের দখলে ৭৬ ভাগ সড়ক ॥ যানজট নিরসনে গণপরিবহন সহজলভ্য করার পরামর্শ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩০ জুন ২০১৮

 প্রাইভেটের দখলে ৭৬ ভাগ সড়ক ॥ যানজট নিরসনে গণপরিবহন সহজলভ্য  করার  পরামর্শ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সুবিধা ভোগ করেন মাত্র ছয় শতাংশ মানুষ অথচ ৭৬ শতাংশ সড়কই প্রাইভেটকারের দখলে থাকার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে যানজট বাড়ছে। একের পর এক উড়াল সড়ক ও ওভারপাস নির্মাণের পরও নগরীর যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না বরং দিন দিন এর মাত্রা বাড়ছে। এমন বাস্তবতায় সড়ক গতিশীল ও যানজটমুক্ত করতে গণপরিবহন সহজলভ্য করে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গণপরিবহনের সংখ্যা দিন দিন কমছে। যাও আছে সেগুলোর সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুলও। এ কারণে সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। সঙ্কট সমাধানে গণপরিবহন বাড়ানোর বিকল্প কিছু দেখছেন না তারা। পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরাও বলছেন একই কথা। গত ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচলকারী ছয় শতাংশ মানুষ ঢাকার ৭৬ ভাগ সড়ক দখল করে আছে। মোট সড়কের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ থাকে ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে। গণপরিবহনের দখলে থাকে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। সড়কের বাকি অংশ বিভিন্নভাবে অবৈধ দখল ও অবৈধ পার্কিংয়ের দখলে থাকে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, পরিবহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। যাত্রীবাহী পরিবহনে ট্রিপের সংখ্যা কমছে ব্যাপকভাবে। যদিও সম্প্রতি বেশকিছু নতুন বাস কোম্পানি রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু লোকসানের মুখে আছেন অনেক মালিক। কিছু পরিবহন অব্যাহত লোকসানের মুখে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। আমাদের দেশে গণপরিবহন ও যানজট নিরসনে অনেক পরিকল্পনা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন কম। ফলে সঙ্কট তিমিরেই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরওয়ার জাহান বলেন, এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ সড়ক দখল করে রাখে ব্যক্তিগত গাড়ি আর গণপরিবহন দখল করে মাত্র ৭ শতাংশ রাস্তা। বাকি অংশ দখল করে আছে অন্যান্য গাড়ি, অবৈধ দখল ও অবৈধ পার্কিং। ব্যক্তিগত গাড়ি সড়কের অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল করে রাখে বলে জানিয়েছেন বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিচার্জ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোঃ সাইফুন নেওয়াজ। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত গাড়িতে প্রতি ১০ স্কয়ার ফুট জায়গাতে মাত্র দু’জন মানুষ চড়তে পারেন। অন্যদিকে গণপরিবহনে একই পরিমাণ জায়গায় বসে ও দাঁড়িয়ে ১৫/১৬ জন যাত্রী চলাচল করতে পারেন। সেই হিসেবে যে পরিমাণ ব্যক্তিগত গাড়ি, তা ঢাকার রাস্তার অর্ধেকের বেশি দখল করে। বাকি অংশ থাকে গণপরিবহন ও অবৈধ দখলে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের লিডার ফেলোশিপ প্রোগ্রামের নবম ব্যাচের ফেলো শাহিনুর নার্গিস তাদের গবেষণায় বলেন, রাজধানী শহরে কত পরিমাণ যানবাহন চলতে পারে এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই অথচ একের পর এক যানবাহনের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশেই এ রকম কোন ব্যবস্থা নেই। পরিকল্পিত সব শহরের কত পরিমাণ রাস্তা আছে এর হিসাব কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। সে অনুযায়ী পরিবহন নামানো হয়। ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ তুলে ধরা হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। এর মধ্যে রয়েছেÑ মানসম্মত গণপরিবহন বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পৃথক লেন নির্ধারণ, আধুনিক রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা, জলপথ ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, উপকূলবর্তী এলাকায় রফতানিমুখী শিল্পকারখানা স্থানান্তর, মিশ্র নগর ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের বিকাশ ইত্যাদি। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যা ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৭৪টি। এর মধ্যে মাইক্রোর সংখ্যা ৭২ হাজার ৪১১টি। প্রাইভেট কারের সংখ্যা দুই লাখ ৫৮ হাজার ২৬০টি। প্রতিদিন ঢাকার বাইরে থেকে আরও অন্তত ১০ হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি যুক্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে মোট রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের তিন ভাগের এক ভাগই হলো ব্যক্তিগত। রাজধানীর যানজট নিরসনে বেশ কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ গণপরিবহন সহজলভ্য করে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন, ফুটওভার ব্রিজ, ফুটপাত দখলমুক্ত ও চলাচলের উপযোগী করা এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী চার জেলায় মানসম্মত ডেমু ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এক পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলা হয়, রাজধানীতে ৯১টি ট্রেনের জন্য ছয়টি স্টেশন ও ৪২টি রেলক্রসিং পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি রেলক্রসিং সরকারী ব্যবস্থাপনায় থাকলেও ১৩টি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের সঙ্গে যুক্ত ২০টি রেলক্রসিংয়ে স্বাভাবিক যান চলাচল করতে পারে না। তাই রেলক্রসিংয়ের ওপর ছোট ছোট ফ্লাইওভার নির্মাণ করে পরিবহন চলাচলের সুবিধা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি রাজধানীর চারপাশে চারটি নদী ও ভেতরে ৫২টি খালসহ মোট ১১০ কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। যানজট নিরসনে এগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করে হাতিরঝিলের আদলে তৈরি করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি যানজট নিসরসনে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে অথচ কোন কিছুই কাজে আসছে না। যানজট থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলোÑ কেন যানজট কমছে না? এর নেপথ্যে রয়েছে, রাজধানীমুখী মানুষের স্রোত কোনভাবেই কমছে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থাও জোরালো নয়। তাই গ্রামের মানুষের আয়ের দিক বিবেচনায় প্রধান আগ্রহের জায়গা হলো রাজধানী অথচ পরিকল্পিত চিন্তা করলেই সমস্যা অনেকাংশে নিরসন করা সম্ভব। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির পক্ষ থেকে রাজধানীতে আর্টিকুলেটেড বাস নামানো হয়েছে। কিন্তু বড় বড় এসব বাস চলাচলের উপযোগী আমাদের শহরের রাস্তা নয়। এসব বাস ইউটার্ন করা বা ঘোরানো অনেক কঠিন। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দ্বিতল বাসা বাড়ানোরও প্রস্তাব করেন অনেকে। এছাড়া উত্তরা থেকে মতিঝিল আসলে ভাল কোন যানবাহন নেই। দিন দিন রিক্সায় ছেয়ে যাচ্ছে গোটা শহর। এই প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত গাড়ি অর্থাৎ প্রাইভেটকারের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যাও। যদিও এসব বিষয় সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া উচিত। যানজট ও দূষণমুক্ত নগরায়ণের জন্য গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। সম্প্রতি এক সেমিনারে তিনি বলেন, যানজট ও দূষণমুক্ত নগরায়ণের জন্য সকলকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করতে হবে। এ জন্য আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। আমাদের দেশে এমন এক সময় ছিল যখন কোন সংগঠন বিশ্ব গাড়ি মুক্ত দিবস পালন করতে সাহস পেত না। কারণ যে সংগঠন তা পালন করবে সরকারীভাবে তাদের বয়কট করা হতো। আবু নাসের খান বলেন, সরকারের মধ্যে কিছু ভূতপ্রেত রয়েছে; যাদের কারণে বিশ্ব গাড়ি মুক্ত দিবসের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের নিজেদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, সঠিক নগরায়ণের জন্য অফিস এবং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আমরা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করব না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সহ-সম্পাদক ও পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মাদ খান বলেন, আমাদের দেশে আইন তৈরি হয় কিন্তু বাস্তবায়ন খুবই কম লক্ষ্য করা যায়। অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নীতিমালা রয়েছে। জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোসহ সেটাকে আরও উন্নত করা দরকার। নগর বিশেষজ্ঞ সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ি মুক্ত দিবসের উদ্দেশ্য এই নয় যে, গাড়ি নিষিদ্ধ করা হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে গণপরিবহনের উন্নতি সাধন করে তাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে ব্যক্তিগত কাজ সম্পন্ন করা যায় তা বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিন আহসান বলেন, নগরায়ণের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নাগরিক তৈরি করা। দুর্ঘটনা ও যানজট রোধে শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন করার কথা জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, পরিবারপ্রতি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আমরা আরোপ করব দুর্ঘটনা, যানজট এড়ানোর জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও প্রাইভেট কারের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করা কঠিন হবে।
×