ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারত থেকে গরু আমদানির দিন শেষ

মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ, রফতানিও হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩০ জুন ২০১৮

 মাংস উৎপাদন বেড়েছে  দ্বিগুণ, রফতানিও  হচ্ছে

ওয়াজেদ হীরা ॥ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। আর তাই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মাংসের বাজার বড় পরিসরে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যদিও কিছু কিছু দেশে এখনও মাংস রফতানি হচ্ছে তবে বৃহৎ পরিসরে হলে রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি দেশের তরুণরা আরও বেশি এই খাতে আগ্রহী হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক পোল্ট্রি উৎপাদন করে একদিকে যেমন বেকারত্ব কমেছে তেমনি বেড়েছে উৎপাদনও। আর তারই ধারাবাহিকতায় দেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে। আর এখন দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বড় পরিসরে বিশ্ববাজার ধরতে চায় বাংলাদেশ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে বিগত ১০ বছরে মাংসের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। মাংস উৎপাদনের এই দৃশ্যমান অগ্রগতিতে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ উদ্যোগ ও বেসরকারী খাতে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক পোল্ট্রি উৎপাদন বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। দেশে ব্যাপক হারে পশু পালন করায় কোরবানির ঈদে ভারতীয় গরু আমদানির প্রয়োজনীয়তাও ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আর বর্তমানে দেশে মুরগির মাংসের উৎপাদন দৈনিক প্রায় দুই হাজার টন। তাছাড়া ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃত। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে বিশে^র চার দেশে মাংস ও মাংসজাত পণ্য রফতানি হচ্ছে। দেশগুলো হচ্ছে মালদ্বীপ, দুবাই, কুয়েত ও কোরিয়া। এর মধ্যে মালদ্বীপে বেশি পরিমাণে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে। সর্বশেষ চলমান তথ্যে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে (মে ২০১৮ পর্যন্ত) ৬২ হাজার ৪২৫ কেজি মাংস রফতানি হয়েছে। যেখান থেকে আয় হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি হওয়া মাংস থেকে আয় হয়েছে এক কোটি ৮৭ লাখ ৯৩ হাজার ৮৪০ টাকা। এর আগে ২০১৫-১৬ সালে প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো রফতানি আয় আসে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী, বতর্মানে বাংলাদেশ থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান মাংস ও মাংসজাত পণ্য রফতানি করছে। এদের মধ্যে বেঙ্গল মিট প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নাফিজা এন্টারপ্রাইজ এবং ম্যাজিস্টিক এন্টারপ্রাইজ। তবে কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করে বলেছেন, যদি আরও কেউ রফতানিতে আগ্রহ দেখায় সে ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে অধিদফতরও। প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে দেশ যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে তেমন দেশের মানুষ স্বাবলম্বী হচ্ছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত যদি মাংস রফতানি করতে পারে আমরাও কেন নয়? এ জন্য অধিদফতরকে মার্কেট তৈরি করতে হবে সেই পলিসি নিয়ে এগোতে হবে। ভবিষ্যতে এটি আরও বড় হবে। নানা মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিনি আরও বলেন, অল্প পরিসরে হচ্ছে এটি খুশির খবর। তবে বড় পরিসরে যেতে হলে প্রচার এবং পণ্যের গুণগত মানের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বিশ^বাজারে অধিক পরিমাণে রফতানি হলে দেশের বেকারত্ব কমে আসবে। ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, তরুণদের পাশাপাশি নারীরাও স্বাবলম্বী হতে পারে। গ্রামে গ্রামে আরও খামার গড়ে উঠতে পারে। সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার কথাও বলেন তিনি। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের খামার বিভাগের তথ্য মতে, দেশে নিবন্ধিত গবাদি পশুর খামার আছে ৬৬ হাজার দুটি। তার মধ্যে গাভীর খামার ৫৮ হাজার ৪৪৯টি। বাকি ৩ হাজার ৯২১টি ছাগল ও ৩ হাজার ৬৩২টি ভেড়ার খামার। আর দেশে নিবন্ধিত হাঁস-মুরগির খামারের সংখ্যা প্রায় ৮১ হাজার। এর মধ্যে মাংস উৎপাদনকারী (ব্রয়লার খামার) সংখ্যা ৫৩ হাজার ৯৮৮টি। ডিম উৎপাদনকারী (লেয়ার খামার) সংখ্যা ১৮ হাজার ৭১০টি। দেশে হাঁসের খামারের সংখ্যা ৭ হাজার ৭০৬টি, প্যারেট স্টক ২০৭টি, গ্রান্ড প্যারেট স্টক ১৬টি। তবে রেজিস্ট্রেশনের বাইরে থেকে আরও ৫০ থেকে ৬০ হাজার খামারি রয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী জনপ্রতি প্রতিদিন ১২০ গ্রাম মাংসের প্রয়োজন। আর এ চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট মাংস উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৭১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। যার বিপরীতে বর্তমানে মোট মাংস উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৭২ লাখ মেট্রিক টন। ওই হিসাবে দেশে দৈনিক মাথাপিছু মাংসের প্রাপ্যতা ১২১ দশমিক ৭৪ গ্রাম, যা চাহিদার তুলনায় বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও এই ধারাবাহিকতা থাকবে আশা কর্মকর্তাদের। জনপ্রতি চাহিদা অনুযায়ী মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় সরকার মাংস রফতানির পরিকল্পনা নিয়েছে। কারণ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৬০ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩.৩২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ খাতে জিডিপির আকার ছিল ৩৫ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, যা বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা বেশি। বর্তমানে জিডিপিতে পোল্ট্রিশিল্পের অবদান প্রায় ২.৪ শতাংশ। আর প্রাণিজ আমিষের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পোল্ট্রিশিল্প থেকে আসে। বর্তমানে দেশে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। ওই খাতে বর্তমানে বিনিয়োগ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ২০২১ সালে চাহিদা পূরণে বিনিয়োগ বাড়িয়ে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। ওই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, বিগত ২০১৪ সালে দেশে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন ছিল প্রায় এক হাজার ৫১০ মেট্রিক টন। কিন্তু ২০১৭ সালে উৎপাদন বেড়ে তা পৌঁছায় ১ হাজার ৮৫১ মেট্রিক টনে। ২০২১ সালে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন ৩ হাজার ৩০০ মেট্রিক টনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সময় মাথাপিছু বার্ষিক ব্যবহার হবে প্রায় সাত কেজি। ২০১৪ সালে মাথাপিছু বার্ষিক ব্যবহার ছিল প্রায় সাড়ে ৩ কেজি। বর্তমানে দেশে প্রায় এক কোটি ৫৫ লাখ এক দিনের ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পোল্ট্রি খামার স্থাপিত হয়েছে। তাতে জনপ্রতি মাংসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়েছে। দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গবাদি পশু ও হঁাঁস-মুরগি উৎপাদনে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে এ সফলতা অর্জিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বাংলাদেশ এখন মাছ ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এমন তথ্য জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ। গত ৬ জুন সংসদে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ মাংসের উৎপাদন নিয়ে বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৭১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৭১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। যা অনেক বেশি। একই সময়ে মাছের উৎপাদনও বেড়েছে বলেও জানান মন্ত্রী। মন্ত্রী বলেন, মৎস্য জাত উৎস থেকে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও রফতানি আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের সফলতা ধরে রাখার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমেরিকা থেকে শতভাগ ব্রাহামা জাতের হিমায়িত সিমের আমদানি করে দেশী জাতের গাভীর সঙ্গে প্রজনন করে মাংসল জাতের গরুর উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রয়েছে উল্লেখ করেন। মন্ত্রী আরও জানান, মাত্র দুই বছরে এই জাতের শংকর গরু ৬ শ’ থেকে ১ হাজার কেজি ওজন লাভ করতে সক্ষম। এই প্রকল্পের আওতায় শুরু থেকে এই পর্যন্ত ২ হাজার ৬৩৫টি বকনা এবং ২ হাজার ৭০৫টি ষাঁড় বাছুরসহ মোট ৫ হাজার ৩৪০টি সংকর জাতের বাছুরের জন্ম হয়েছে। মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে গরু মোটাতাজাকরণ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একটি নিয়মিত কার্যক্রম বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) তথ্যানুযায়ী সাভার ও রাজশাহীতে কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাগার এবং জেলা কেন্দ্রে রক্ষিত উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ সংগ্রহ করে তরল ও হিমায়িত উপায়ে সমগ্র দেশে ৩ হাজার ৭২৫টি কৃত্রিম প্রজনন উপকেন্দ্র ও পয়েন্টের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১১ লাখ ৮৫ হাজার ১০৯টি সংকর জাতের বাছুর উৎপাদিত হয়েছে। তাছাড়া দেশে মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে ‘বিফ ক্যাটেল উন্নয়ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাংসল জাতের গরু উৎপাদন ও দুধের উৎপাদন বাড়াতে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও ভ্রুণ স্থানান্তর প্রযুক্তি বাস্তবায়ন (তৃতীয় পর্যায়) এবং মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে। তাছাড়া মাংসের উৎপাদন আরও বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর গোখাদ্য উদ্ভাবন করা হয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক প্রাপ্ত বিভিন্ন ফর্ডার ব্যবহার করে পূর্ণাঙ্গ রেশন উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা ব্যবহারের মাধ্যমে খামারিরা লাভজনক উপায়ে গোখাদ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে। বর্তমানে গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে খামারি পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। তাছাড়া মাঠপর্যায়ে মুরগির উৎপাদন সক্ষমতা সংক্রান্ত মূল্যায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এদিকে এ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ মোঃ আইনুল হক জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, প্রাণি নিয়ে কাজ করাই এই অধিদফতরের কাজ। সরকারের ভিশন তথা জনগণের আমিষ চাহিদা পূরণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা। তাছাড়া ভবিষ্যতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মাংসের বাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও রয়েছে। ইতোমধ্যেই কিছু কিছু দেশে মাংস রফতানি হচ্ছে। বিশ^বাজার নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে আরও উদ্যোগ নেব। নানা সেক্টরে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মাছ মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বিশে^র বাজারে অল্প পরিসরে হলেও রফতানি একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বড় পরিসরে এই কার্যক্রম এগিয়ে গেলে মাংস ও মাংসজাত পণ্যেও আলাদা পরিচিতি পাবে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে রফতানি আয়ের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মানুষের মধ্যেও প্রাণিসম্পদে আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×