ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশব্যাপী আলোচিত নাম ‘ঘাসফড়িং’

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৩০ জুন ২০১৮

 দেশব্যাপী আলোচিত  নাম ‘ঘাসফড়িং’

কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করলাম, জুই ক্লাসে আসে না। এমন তো কখনও হয় না। স্যারও অবাক! নিয়মিত মেধাবী ছাত্রী ক্লাস বন্ধ করা। এরপর এক ভয়ঙ্কর খবর জানতে পারলাম। জুঁইকে তাঁর বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আমার বয়সী একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে? তার সব স্বপ্ন এখানেই শেষ হয়ে যাবে? বার বার মনে হচ্ছিল এটা তো অন্যায়। জুইদের বাসা থেকে ফিরে আসার সময় মনের মধ্যে খুব অস্থির লাগছিল। আমি কি তাহলে জুইয়ের জন্য কিছুই করতে পারব না? ভেবে দেখলাম আমি তো শুধু একা না। অন্যায়ের প্রতিবাদে আমার বন্ধুরাও সমান সাহসী। ক্লাসে পড়েছিলাম ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’। আমার সাহসী বন্ধুরা একে একে সবাই এগিয়ে এলো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। আমরা চিন্তা করতে লাগলাম কিভাবে রুখে দিব জুইয়ের প্রতি এই অন্যায়। এবার দল বেধে গেলাম জুইদের বাড়িতে। নানা রকম যুক্তি দিয়ে অভিভাবকদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে। কিন্তু তারা কোন কিছুতেই বুঝতে রাজি নয়। খুব মন খারাপ করে যখন ফিরে আসছিলাম তখন মনে হচ্ছিল জুঁইয়ের স্বপ্নটা হেরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেরে যাচ্ছে দেশটাও। সাহস করে বেছে নিলাম নতুন পথ। সে দিন ছিল ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল। উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাফিজুর রহমান আমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। এই অন্যায়কে রুখতে আমাদের সঙ্গে পাঠালেন পুলিশফোর্স। সে দিনের জুইয়ের মুখের হাসিটা আমাদের শক্তি জুগিয়েছিল। অন্যায়ের প্রতিবাদে দেখেছিলাম নতুন আলোর পথ। এর পর সবাই মিলে এক হয়ে তৈরি করলাম সংগঠন ‘ঘাসফড়িং’। যেখানেই শিশু বিবাহ, বাল্যবিবাহ সেখানেই প্রতিরোধ করি আমরা, রুখে দেই যৌন হয়রানি। এখন পর্যন্ত প্রতিহত করেছি ৪০টিরও বেশি বাল্যবিবাহ। ‘ঘাসফড়িং’ সংগঠনের শুরু হওয়ার গল্প বলছিল ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ও ঘাসফড়িংয়ের সদস্য তুলি দেবনাথ। এর পর থেকে এই উপজেলায় ‘ঘাসফড়িং’ একটি প্রতীকী নাম। ‘ঘাসফড়িং’য়ের মতো দুরন্ত কিশোরীরা লড়ছে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে। যেখানে প্রশাসন, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন সংগঠনের কাজ করার কথা সেখানে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার তারা। লড়ছে নিজেদের সবটুকু দিয়ে। ময়মনসিংহের নান্দাইলে বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে আলোচিত এক নাম ‘ঘাসফড়িং’। এখন বাল্যবিয়ে আয়োজনকারীদের কাছে যমদূত ‘ঘাসফড়িং’। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের পাশে নান্দাইল উপজেলা পরিষদ। ঠিক তার উল্টো দিকে নান্দাইল পাইলট বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের সাত ছাত্রীই ‘ঘাসফড়িং’য়ের কিশোরী মেয়েরা। বাল্যবিয়ে নামক এই সামাজিক ব্যাধির কবল থেকে স্কুল পড়ুয়া কিশোরী মেয়েদের রক্ষা করতে হঠাৎ আলোহাতে আবির্ভাব হলো এই ‘ঘাসফড়িং’। ‘ঘাসফড়িং’য়ের এই সাত কিশোরী তুলি দেবনাথ, সানজিদা ইসলাম ছোঁয়া, স্নেহা বর্মণ, লিজুয়ানা তাবাসসুম, জান্নাতুল ইসলাম প্রান্তি, জীবননেসা খানম শ্যামা ও জান্নাতুল আক্তার। তারা সবাই এই বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। নিজেদের সহপাঠীর বাল্যবিয়ে ভেঙে দিয়ে আলোচনায় এসেছে এই কিশোরীর দলটি। ‘ঘাসফড়িয়ের সাত কিশোরী দৈনিক জনকণ্ঠকে জানিয়েছে তাদের অনুভূতির কথা : ‘ঘাসফড়িং’য়ের দলনেতা তুলি দেবনাথ জানায়, প্রথমে নিজের সহপাঠীর বাল্যবিয়ে বন্ধ করার পর মনে অনেক সাহস বেড়ে যায়। তার পর গত বছরের ১০ এপ্রিল খবর আসে পৌরসভার দশালিয়া এলাকায় দশম শ্রেণীর ছাত্রী পান্না আক্তারের বিয়ের আয়োজন চলছে। সেদিন গিয়ে পরিবারের লোকজনকে তারা সাতজন অনেক বুঝিয়েও বিয়ে বন্ধ করতে পারেনি। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানিয়ে পরদিন ১১ এপ্রিল বিয়ের আসরে পুলিশ নিয়ে গিয়ে বিয়েটি ভেঙ্গে দেয়। বাল্যবিয়েটি ভেঙ্গে দেওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান তাদের সাত কিশোরীর নাম দিয়েছে ‘ঘাসফড়িং’। ‘ঘাসফড়িং’ এর সদস্য জীবন নিসা খানম শ্যামা জানায়, আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ওয়ার্ল্ডভিশন নান্দাইল শাখার উদ্যোগে কিশোরীদের নিয়ে ‘ঘাসফুল’ নামের একটি সংগঠন করা হয়। সে সংগঠনে ২০১৫ সালে সদস্য হয় সে। ১৫ জন ‘ঘাসফুলের’ মধ্যে সেও একটি ‘ফুল’। সংগঠনটির মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সামাজিক নানা অনাচার ও প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে ধারণা দেয়া হতো। এই সংগঠন থেকে সাতজন মিলে ‘ঘাসফড়িং’ তৈরি করেছে। ‘ঘাসফড়িং’য়ের সদস্য জান্নাতুল ফেরদৌস প্রান্তি বলেন, গত বছর ১৩ এপ্রিল নবম শ্রেণীর ছাত্রী শাহিদা আক্তারের বিয়ের আয়োজন করে তার পরিবার। এর পর খামারগাঁও গ্রামের মেয়েটির পরিবারের লোকজনকে বুঝানোর পর বিয়ে বন্ধ হয় শাহিদার। এর পর ১৬ এপ্রিল নান্দাইলের আচারগাঁও ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের আবদুস সালামের মেয়ে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী মনোয়ারা বেগমের বিয়ের আয়োজন করা হয়। মনোয়ারা নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। সেখানে গিয়ে পড়তে হয় অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে। তাদের অনেক গালমন্দ করা হয়। তবুও দমে যায়নি তারা। পুলিশ নিয়ে বিয়ের আসরে গিয়ে বিয়েটি ভেঙ্গে দেয় তারা। ‘ঘাসফড়িং’য়ের সদস্য ¯েœহা বর্মণ বলেন, বাল্যবিয়ে ভেঙ্গে আমরা একটি সেøাগান তৈরি করি। ‘দুর্নীতি রোধ করবো, সুন্দর সমাজ গড়ে তুলবো, শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করবো।’ এই স্লোগানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ‘ঘাসফড়িং’য়ের সদস্য সানজিদা ইসলাম ছোঁয়া জানায়, সহপাঠীরা বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করার পরিকল্পনা করছে। বিষয়টি মাকে জানাতে গেলে প্রথমে সম্মতি দিতে রাজি হননি। অনেক ভয় দেখানো হয় তাকে। ক্ষতি হবে, শত্রু তৈরি হতে পারে। কিন্তু এখন তার পরিবার তাকে সহযোগিতা করে। ‘ঘাসফড়িং’য়ের সদস্য লিজুয়ানা তাবাসসুম বলেন, আমরা গ-ির মধ্যে সীমাবন্ধ থাকব না। প্রশাসন ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাড়ায়-মহল্লায় ‘ঘাসফড়িং’ সংগঠন ছড়িয়ে দিতে চাই। এভাবেই তারা সুন্দর নান্দাইল গড়তে চায়। ২০১৮ সালের মধ্যে নান্দাইল উপজেলাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছে। ‘ঘাসফড়িং’য়ের সদস্য জান্নাতুল আক্তার জানায়, ‘ঘাসফড়িং’কে এখন উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রশাসন, পুলিশ, সামাজিক সংগঠনের ব্যক্তি, সাংবাদিক, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কাউন্সিলররা। এক সকালে তার এলাকার চেয়ারম্যান বাড়িতে হাজির হন। যে কোন সমস্যায় পাশে থাকার আশ^াস দেন। কথা হয় বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পাওয়া স্কুল ছাত্রী রুমার সঙ্গে। সে রসুলপুর গ্রামের খোরশেদুল ইসলামের মেয়ে। ‘ঘাসফড়িং’ টিম রুমার বাল্যবিয়ে ভেঙ্গে দেয়। রুমা জানায়, বিয়ে বন্ধের পর সে নতুন উদ্যমে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে থাকে। আগামীতে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ভাল একটা কলেজে ভর্তি হবে সে। ‘ঘাসফড়িং’য়ের সব সদস্যই কৃতজ্ঞ হাফিজুর রহমানের প্রতি। হাফিজুর রহমান নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার। গত মাসের ১৫ তারিখ তিনি পদোন্নতি পেয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। বাল্যবিয়ে ঠেকানোর পেছনে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা তার। তারা আরও বলেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সহযোগিতা কম ছিল না। তিনি ক্লাসের ফাঁকে ছুটি দিয়ে বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সহযোগিতা করেছেন। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেকেরও অনেক গর্ব সাত ‘ঘাসফড়িং’ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘বড়রা যা পারে না ওরা তা পেরে দেখিয়ে দিচ্ছে। এখন আমার বিদ্যালয়ের কোন ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয় না বললেই চলে।’ ‘ঘাসফড়িং’য়ের এই দলটি সমাজে আলো ছড়াচ্ছে। কিশোরীদের এমন উদ্যমতা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে। এই বয়সের শিক্ষার্থীরা বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক একটি অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়ছে তাতে সকলের সম্মতি জানানো উচিত। ‘ঘাসফড়িংদের’ হাত ধরেই বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্তিপাবে দেশ এমনটিই প্রত্যাশা আব্দুল খালেকের। নান্দাইল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মালেক চৌধুরী স্বপন বলেন, সাত ‘ঘাসফড়িং’ বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে নান্দাইলসহ সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই কাজে তাদের সহায়তা করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আশা করছি তাদের সঙ্গে নিয়ে খুব শীঘ্রই আমার উপজেলাকে শতভাগ বাল্যবিয়েমুক্ত করতে পারব। -মজিবুর রহমান ফয়সাল নান্দাইল, ময়মনসিংহ থেকে
×