ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গল্প ॥ বাবাটা -নাসরীন মুস্তাফা

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ৩০ জুন ২০১৮

গল্প ॥ বাবাটা -নাসরীন মুস্তাফা

বাবাটার নাম বাবুটা এখনও জানে না। বাবাটার আর কোন নাম আছে কি নেই, থাকার দরকার আছে কি নেই, তাও জানে না বাবুটা। বাবাটা কেবলি বাবাটা। বাবুটা মন চাইলেই হাঁক ছাড়ে, বাবাটা! আত! এর অর্থ হচ্ছে, ওহে বাবাটা, এস আমার কাছে। বাবাটা শার্ট পরতে দেখলেই বাবুটা হাঁক ছাড়ে, বাবাটা! ঘুম থেকে জেগে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে, পা ঝুলিয়ে যখন মেঝের তল পায় না, তখনও হাঁক ছাড়ে, বাবাটা! ঘোড়া ঘোড়া খেলা খেলতে মন চাইলেও হাঁক ছাড়ে, বাবাটা! বাড়িতে বাবুটার দাদাটা বসে থাকেন হুইলচেয়ারে। একা একা হাঁটাচলা করতে পারেন না। বাবুটা স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে নিতে পারে একাই, দাদাটা তা-ও পারে না। বসে বসে কেবলি বাবুটার খেলা দেখে। কথা যা বলার বাবুটা একাই বলে। কাজ যা করার বাবুটা একাই করে। এই তো সেদিন, দাদুর সামনে রাখা টেবিলে দাবার বোর্ড বিছিয়ে বাবুটা বলে, আমাল সঙ্গে খেলবে? দাদাটা কিছু বলে না। বাবুটা একাই কিসব খেলল। একাই বলল, সে জিতে গেছে। দাদাটা হেরে গেছে। দাবার বোর্ড আবার সাজাতে সাজাতে বাবুটার মনে পড়ে বাবাটার কথা। ভর দুপুরে বাবাটা অফিসে। মাটা কাজ করছে ওঘরে। বাবুটা হাঁক ছাড়ে, বাবাটা! এই হাঁক শুনে মা হাসে। দাদাও যেন হাসে। ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি ঝুলছে যেন। বাবুটা সেই হাসি দেখে ডাঁট দেখায়। বলে, বাবাটা আমাল। তোমাল বাবা নেই। দাদাটা মনে হলো মাথা নাড়িয়ে না বলল। এর অর্থ, তুমি যা বলছ, তা ঠিক নয়। আমার বাবা আছে। বাবুটা খুব অবাক হয়। তার মতো দাদারও বাবা আছে? কোথায় সে বাবা? সে কি দাদাকে কোলে নেয়? সে কি দাদাকে মাথা আঁচড়ে দেয়? সে কি দাদার শার্টের বোতাম আটকে দেয়? সে কি দাদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে? সে কি দাদাকে ঘুম পাড়ায়? সে কি দাদাকে খাইয়ে দেয়? খেতে গিয়ে মুখে লেগে গেলে সে কি দাদার মুখ মুছিয়ে দেয়? সে কি মাঝ রাত্তিরে দাদাকে হিসু করতে সাহায্য করে? সে কি দাদা যা চায় তা-ই এনে দেয়? সে কি দাদাকে ভালবাসে? সে কি দাদাকে আদর করে? সে কি দাদাকে চুমু দেয়? সে কি.... সে কি....সে কি? বাবুটার চোখে ভেসে ওঠে ছবির মতোন নানা ছবি। রোজ সকালে ওকে যেমন করে ঘুম থেকে ওঠার পর সাজিয়ে দেয় বাবাটা, দাদাকেও তো সাজিয়ে দেয় ওর বাবাটাই। পায়ে স্যান্ডেল পরিয়ে দেয়, টয়লেটে নিয়ে যায়, দাঁত ব্রাশ করিয়ে দেয়, গলায়-বুকে পাউডার লাগিয়ে দেয়, শার্ট পরিয়ে দেয়, শার্টের উপর রুমাল বেঁধে নাস্তা খাইয়ে দেয়, অফিস যাওয়ার সময় কপালে চুমু খেয়ে আদরও দেয়, অফিস থেকে ফিরে গুজুর গুজুর গপ্প করে, খবরের কাগজ থেকে পড়ে শোনায়, হাহা হিহি করে, টিভি দেখতে দেখতে হেঁড়ে গলায় গান গেয়ে দাদাকে হাসাতে চায়, টেনিস বল এনে দাদার হাতের ভেতর গুঁজে দিয়ে বলে, খেলো বাবা! দাদাটা সেই বল হাতের মুঠোয় নিয়ে চিপতে চায়, ছেড়ে দেয়, পড়ে যায়, গড়িয়ে যাওয়া বল কুড়িয়ে এনে বাবা বার বার বলতে থাকে, লক্ষ্মী বাবাটা আমার! তুমি পারবে। তুমি আবার হাতে জোর পাবে, পায়ে জোর পাবে। তুমি হাঁটবে। আমার সঙ্গে হাঁটবে না বাবা? বাবাটা ওর সঙ্গে যা, দাদার সঙ্গেও তা! বাবাটা ওর বাবাটা, দাদারও কি বাবাটা? দাদা যদি কথা বলতে পারত, তবে কি ওর মতো হাঁক ছেড়ে ডাক দিত, বাবাটা! ওরে সর্বনাশ! কী জট-ই না পাকিয়ে গেল বাবুটার মাথায়? সেদিন দুপুরে খেয়ে দেয়ে মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়বে বলে শুয়েছিল, এতসব ভাবনায় ঘুমটা সহজে এলো না। মাটা কেবলি পিঠে চাপড় মেরে গান গাইছে, আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা! বাবুটার ঘুম যখন ভাঙ্গল, তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। চোখ খুলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না বলে তখনও চুপ করে শুয়ে ছিল সে। হঠাৎ কানে এল খিলখিল হাসি। বাবাটার হাসি! চট্ করে বিছানায় উঠে বসে বাবুটা দেখতে চায় বাবাটাকে। তখন দেখে, হুইলচেয়ারে বসে থাকা দাদাকে জড়িয়ে ধরে বাবাটা খুব আদর করছে। কপালে চুমু খেল একবার। হাতে ধরা কাপড়ের প্যাকেট থেকে নতুন শার্ট বের করে বাবাটা দাদাকে পরিয়ে দিল। আরেকটা বাক্স থেকে নতুন স্যান্ডেল জুতা বের করে বাবাটা নিজের হাতে দাদার পায়ে গলিয়ে দিল। দাদার চোখে চশমা পরিয়ে দিয়ে বলল, আজ বাবা দিবস, বাবা! তোমার জন্য তাই তো এগুলো এনেছি। তুমি খুশি হয়েছ তো বাবা? আগের মতো তুমি যদি আমার হাত ধরে হাঁটতে পারতে, তাহলে আমিও যে কী খুশি হতাম! বাবুটার বাবাটা কাঁদছিল। তাই দেখে বাবুটারও কান্না পায়। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বাবাটাকে। বলে, অনেক কথাই বলে, সব শব্দ শিখে ওঠেনি বলে বলা হয় না, তবুও বাবাটা বুঝতে পারে ও কি বলতে চাইছে। বাবুটা বাবাটাকে নিয়ে হাঁটতে যাবে। বাবুটা বাবাটার হাত ধরে থাকবে। দাদাটা পচা। বাবুটা ভাল। আরেকটা প্যাকেট থেকে নতুন শার্ট আর নতুন জুতা বের হয় বাবুটার জন্য। বাবাটা বলে কি না, বাবুটা তার আরেকটা বাবা। দাদাটা এক বাবা। বাবুটা নতুন বাবা। নতুন জামা-জুতা পরে নতুন বাবা বাবাটার হাত ধরে তাড়া দেয়। হাঁটতে যেতে হবে তো! তখন না খুব আজব একটা ঘটনা ঘটে। হুইলচেয়ারটা নড়ে ওঠে। দাদাটার দুই হাত খুব শক্তি দিয়ে হুইলচেয়ারে ভর দেয়। দাদাটার দুই পা হুইলচেয়ার থেকে বের করে মাটিতে জায়গা করতে চায়। দাদাটা কোমর উঁচু করে কিছু একটা করতে চাইছে। এ কী নতুন খেলা? বাবুটা বুঝতে পারে না। মাটা ছুটে এলো। বাবাটা ছুটে এলো। দুই পাশ দিয়ে ধরে দাদাটা যা করতে চাইছে তা-ই করতে দিল। দাদাটা দাঁড়াতে চাইছে কি? তা-ই তো মনে হচ্ছে। দাদাটা দাঁড়াবে। এরপর পা ফেলে সামনে এগুতে চাইবে। দাদাটা তার বাবাটার সঙ্গে হাঁটতে যাবে? বাবুটা সুযোগ বুঝে বাবাটার এক হাত ধরে ফেলে। কিছুতেই আর ছাড়বে না। বাকি হাতটা দাদা দখলে নেবে, নিক্। বাবাটার এই হাত বাবুটা কিছুতেই ছাড়বে না। কিছুতেই না। অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×