ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অংশুমান ভৌমিক

নাট্যলোক সিরাজগঞ্জ প্রযোজনা ‘রূপসুন্দরী’ মিলিজুলি নাট্যভাষে গ্রামীণ বিনোদনের সাতকাহন

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ৩০ জুন ২০১৮

 নাট্যলোক সিরাজগঞ্জ প্রযোজনা ‘রূপসুন্দরী’ মিলিজুলি নাট্যভাষে গ্রামীণ বিনোদনের সাতকাহন

কলকাতার বুকে ঢাকার একটি নাটকের দল যত সহজে আসতে পারে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, সিলেট বা বরিশালের কোন দলের পক্ষে ব্যাপারটা ততই কঠিন। আর সিরাজগঞ্জ যে কোন ঠাঁই তার হদিস খোদ ঢাকার নাটক মহল্লা সব সময় করতে পারে না তো কলকাতা কোন ছার! তাই সিরাজগঞ্জের মাটিতে গড়েপিটে ওঠা একটি দলকে কলকাতায় দেখতে পেয়ে কৌতূহল জেগেছিল খুব। নাট্যলোক নামের এই দলটি গেল শীতে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল সেলিম আল দীনের ‘গ্রন্থিকগণ কহে’-র একটি প্রযোজনা নিয়ে। কলকাতায় সেবার পা পড়েনি। প্রাচ্যের উদ্যোগে ‘পূবের নাট্যগাথা’ শিরোনামে যে নাট্য উৎসব (২২-২৮ জুন) সাবেক পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাটককে কাছে টেনে টেনে নেয়ার আয়োজন করেছে তার চতুর্থ সন্ধ্যায় দলটি মঞ্চস্থ করল ‘রূপসুন্দরী’। অচেনা অজানার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারাদিনমানের বৃষ্টিতে ভিজে কয়েকশো নাট্যমোদি হাজির হলেন পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে। মাহবুব আলমের লেখা এই নাটক শুরু হলো মহাস্থানগড়ের বৌদ্ধ বিহারের খেই ধরিয়ে। হাজার বছর আগেকার পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের এই খাস তালুক ক’বছর ধরেই সংবাদ শিরোনামে। সার্কের হেরিটেজ তকমা গায়ে ওঠার পর থেকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে আরও জোরালো হয়ে উঠেছে মহাস্থানগড়। বগুড়ার কাছে হলেও সিরাজগঞ্জের নাটকের দলও এই গৌরব উদ্যাপনের হকদার। পূর্বশ্রীর প্রশস্ত মঞ্চকে কতক স্তূপের আদল দিয়ে প্রসেনিয়াম আর অডিয়েন্সের মাঝখানে চওড়া জায়গাটাকে প্রদক্ষিণের জন্য কাজে লাগিয়ে, কুশীলবদের হাতে হাতে দীপাধার তুলে দিয়ে এমন বর্ণনাত্মক মেজাজে নাটক শুরু হলো যে মনে হচ্ছিল নির্দেশক অনীক কুমার সাহা বুঝি কোনও প্রতœনাট্যের উপস্থাপনা করতে যাচ্ছেন। খানিক বাদে ভুল ভাঙল। মহাস্থানগড়ের নামমাহাত্ম্যের সঙ্গে মিলেমিশে আছে করতোয়া নদীর ধারে শীলাদেবীর ঘাট। সেই ঘাটের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিংবদন্তিকে একবারটি ছুঁয়েই নাটক চলে এলো শতখানেক বছর আগেকার বাস্তবতায়। সেখানে গ্রামের জোয়ান চাষী সলিম আর চুড়িওয়ালি সুন্দরীর প্রেমের পথে কিভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াল এক আঁটকুড়ো তালুকদারের লম্পট প্রবৃত্তি আর কিংবদন্তির রানি শীলাদেবীর দেখানো পথে ‘ইজ্জত’ বাঁচাতে কিভাবে করতোয়ার বুকে প্রাণ সঁপে দিল সদ্যবিবাহিতা এক নারী-তারই কিসসা শোনাল ‘রূপসুন্দরী’। বলছি বটে কিসসা তবে কিসসা বা পালা গাইবার যে সাবেক রেওয়াজ তাতে ভর করে এ প্রযোজনার বিন্যাস করেননি অনীক। প্রযোজনাকে চেলেছেন মিলিজুলি নাট্যভাষে। মাহবুব আলমের লেখায় সামন্ততান্ত্রিক বাংলার একটি বাহারি ছবি আঁকা ছিল। তাতে গ্রামীণ মেলার রং ছিল। মুরুব্বি-মাতব্বরদের তাঁবে থাকা গ্রামবাংলার ঢং ছিল। বাঁদর নাচের দেদার মজা, নিশুতি রাতে একলা নৌকা বাইবার শিহরণ, শাদি কবুল হতে না হতেই হিজরে কুলের হুজ্জোত, নায়িকার হৃদয় খুঁড়ে আনা বাইজিবাড়ির হাহাকার, তালুকদারের লেঠেলদের সঙ্গে কোণঠাসা নায়কের রোমহর্ষক টক্কর, বিরহাতুর নায়িকার কাতর আর্তি-গ্রামীণ বিনোদনের এমন রকমারি উপকরণকে সাজিয়ে গুছিয়ে পেশ করতে শিশির রহমানের সঙ্গীত পরিকল্পনা, ঠান্ডু রায়হানের আলোক বিন্যাস কাজে এসেছে সন্দেহ নেই। নাট্যলোকের নানা বয়সের নাটুয়া চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। উত্তেজনার খোরাক জুটেছে। হেসে কুটিপাটি হওয়া গেছে। ১০০ মিনিট ধরে সবাই কমবেশি মনোযোগ দিয়ে এর রস নিয়েছেন। উঠে যাননি। তবে তা বাংলাদেশের আধুনিক নাট্যপ্রয়োগের উঁচু দরের সঙ্গে সব সময় সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে এমনটি বলা যাচ্ছে না। নারীর ‘সতীত্ব’ নিয়ে ভেবে আকুল হয়ে, আত্মরক্ষার বদলে নারীর আত্মহননকে মাথায় তুলে ‘রূপসুন্দরী’র নাট্যকার যে বার্তা দিতে চেয়েছেন তা সিরাজগঞ্জের পড়শি ময়মনসিংহের কবেকার গীতিকাতেও এত রগরগে হয়ে আসেনি। আর নাটকের ল্যাজার সঙ্গে মুড়োর সম্বন্ধ আলগা হওয়ায় গোটা ব্যাপারটিকে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া মনে হয়েছে। তবু এমন অভিজ্ঞতার জন্য মুখিয়ে থাকা সার্থক। নাগরিক নাট্যের ছকের বাইরে ঢাকা থেকে বেশ খানিক দূরে থেকে কিভাবে আধুনিক নাট্যভাষার তালাশ করছে সিরাজগঞ্জের মতো মফস্বল তার কিঞ্চিত হদিস পাওয়া গেল। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সাহেবি কাঠামো থেকে বেরোনোর পথে কোন কোন বাধার সামনে পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক নাট্যপ্রয়োগের রেওয়াজ করে আসা নয়া আন্দাজের ওস্তাদের দল-তাও মালুম হলো। এ পাওয়া খুব কম পাওয়া নয়।
×