ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোতাহার হোসেন প্রিন্স

ঢাবি উপাচার্যের বাসায় হামলার নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ৩০ জুন ২০১৮

ঢাবি উপাচার্যের বাসায় হামলার নেপথ্যে

কি ঘটেছিল সেদিন রাতে? ঘটনার নেপথ্যে কারা জড়িত ছিল? সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন কিভাবে সহিংস আন্দোলনে রূপ নিল? ৮ এপ্রিল কালো রাতের সেই ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা ও কয়েকটি পাল্টা প্রশ্ন দিয়ে লেখাটি সাজানো। ৮ এপ্রিল রাত প্রায় ১১টা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কয়েকজন ছাত্র সাধারণ শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক মারা গেছে বলে উত্তেজিত করার চেষ্টা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠীর মৃত্যু হয়েছে এমন খবর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং টিভি মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে যে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এক ছাত্র নিহত হয়েছে। এছাড়া ফেসবুকে বিভিন্ন ফেক আইডি ও ফেজ থেকে বিভিন্ন উস্কানিমূলক স্ট্যাটাস ছড়িয়ে দেয়া হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে দেখেছি, ক্যাম্পাসের এক পাশ থেকে আরেক পাশ আবু বকরের মৃত্যুর খবর ফলাও করে প্রচার করছে। তাদের কয়েকজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, আবু বকর কোন্ হলের ছাত্র? বর্তমানে তার লাশ কোন্ মেডিক্যালে আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি... কেউ কোন উত্তর দিতে পারল না। এই শিক্ষার্থীদের দেখে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনে হলো না। এদিকে শাহবাগ, রাজু ভাস্কর্যসহ ক্যাম্পাসের বেশকিছু জায়গায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ভাইয়ের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ল মেয়েদের আবাসিক হলগুলোতে। মেয়েরাও জানতে পারল তাদের এক সহপাঠী মারা গেছে। বোন হিসেবে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর কে সহ্য করতে পারে? তাও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশেই পুলিশের টিয়ারশেলে নিহত হলো তাদের ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর ওপর এমন হত্যাকা- নিকট অতীতে খুব কমই হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা কোনভাবেই এই হত্যাকা- মেনে নিতে পারছে না। ঢাবির সুফিয়া কামাল হল, বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব হল, কুয়েত মৈত্রী হল, শামসুন্নাহার হল ও রোকেয়া হলের ছাত্রীরা যার যার হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসতে শুরু করে। যখন সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীরা রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত এসে পৌঁছায় এবং বঙ্গমাতা ও মৈত্রী হলের মেয়েরা এফ রহমান হলো পর্যন্ত এসে পৌঁছায়, বোনদের এমন উপস্থিতি টের পেয়ে নতুন করে ছেলেদের একটি মিছিল হাজির হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসার সামনে। বোনদের উপস্থিতি ভাইদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করল যেন। ভাই-বোন একসঙ্গে মিলে অভিভাবকতুল্য ভিসি স্যার মহোদয়ের কাছে সহপাঠী হত্যার বিচার চাইবে। এমন সময় (আনুমানিক রাত ১২-৩০ মিনিট) ভাই হত্যার বিচার দাবিতে, কিছু শিক্ষার্থী মাননীয় উপাচার্যের বাসার গেটের ওপর অত্যন্ত সুকৌশলে উঠে যায় এবং গেটের ওপর কাঁটাতারগুলো সরিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়। তারপর ভেতর থেকে গেটের তালা ভেঙ্গে অন্যদেরও প্রবেশের ব্যবস্থা করে। এভাবে সুকৌশলে কাঁটাতারের বেড়া সরানো এবং কেটে ফেলা ও ফটকের তালা ভাঙতে ঢাবির কোন ছাত্রকে দেখা যায়নি। ধ্বংসযজ্ঞের শুরুতেই তারা বাসার ফটকের ওপর রাখা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাটি ভেঙ্গে ফেলে। যেন ভাই হত্যার বিচার যে ভাইয়েরা চাইবে, সেটা যেন ভবিষ্যতে প্রচার না হয়। তারপর একে একে অনেকেই উপাচার্য মহোদয়ের বাসায় প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশকারী অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বয়স ৩০ উর্ধ। সঙ্গে কিছু তরুণ শিক্ষার্থীকেও দেখা যায়। সাধারণত ৩০ উর্ধ কেউ ঢাবির নিয়মিত ছাত্র হওয়ার কথা নয়। তার পরও সেদিন তাদের দেখা গিয়েছিল। ভাই হারানোর কষ্ট সইতে না পেরে, দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে শিক্ষার্থীরা পিতৃতুল্য উপাচার্যের বাসার ফুলের টব থেকে শুরু করে জানালার গ্লাস, চেয়ার-টেবিল, টিভি, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, বেসিন, বৈদ্যুতিক বাতি এবং বাথরুমের কমোড পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলে। ভাই হত্যার অসহ্য যন্ত্রণার কাছে এসব ভাঙচুর তাদের কাছে গৌণই মনে হয়। দেখতে দেখতে ছাত্ররা নিচ তলা ল-ভ- করে দিয়ে তারা দ্বিতীয় তলায় ভাঙচুর শুরু করে। প্রত্যকেটি জিনিসপত্র ও আসবাবপত্র তারা ভাঙচুর করল। সেই সময় উপাচার্যের পরিবার দু’জন সহকারী প্রক্টরসহ উপাচার্য স্যার দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করছিলেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা উপাচার্য স্যারের পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের গায়ে আঘাত করে। যেন এটা প্রতিশোধের আঘাত। হামলাকারীরা উপাচার্যের বেড রুমের দিকে যখন ভাঙচুরের উদ্দেশে যাচ্ছিল, স্যার তাদের অনুরোধ করে বললেন ভেতরে আমার বউ ও মেয়ে রয়েছে। তোমরা ভেতরে যেও না। তারপরও ভাই হত্যার প্রতিশোধে মত্ত ভাইয়েরা বেডরুমের দরজায় বার বার আঘাত করতে লাগল। অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ উপাচার্যের বাসার সামনে থাকা তার ব্যবহৃত গাড়িটিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনের তাপদাহ আশপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে ভাই হত্যায় অপর ভাইয়ের অভিমানের আগুন, অন্যদিকে উপাচার্যের ব্যবহৃত গাড়িটির দাউ দাউ করা আগুনের তাপমাত্রা এক হয়ে গেল। শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলন নতুন রূপ ফেল।ভাই হত্যার বিচার চাইতে, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে টেনেহিঁচঢ়ে দোতলা থেকে নিচ তলায় নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। তিনি নিরুপায় হয়ে তাদের সঙ্গেই দোতলা থেকে নিচ তলায় নামেন। এই মারাত্মক সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে ঢাবির কিছু তরুণ সাংবাদিক উপাচার্য স্যারের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তখন বিক্ষোভকারীরা মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার ভয়ে ভিসির সম্মানহানি থেকে বিরত থাকে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, উপাচার্যের বাসায় শিক্ষার্থীরা যখন প্রবেশ করল তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করা হলো যে, বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক মারা যায়নি। বিভিন্ন টিভি মাধ্যম আবু বকরের একটি লাইভ ভিডিও প্রচার করে। যেখানে আবু বকরকে বলতে দেখা যায় যে, রাতে টিউশনি থেকে ফেরার পথে শাহবাগে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধলে পুলিশের টিয়ারশেলে আমি কিছুটা আহত হই। আমার বাম চোখের ওপর টিয়ারশেলের সামান্য আঘাত লাগে। আমার মৃত্যুর যে গুজবটি ছড়িয়েছে সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি সুস্থ সুন্দর আছি। আমার হত্যাকা- নিয়ে মিথ্যা গুজব প্রচার করে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফেসবুকে প্রচারিত আবু বকরের এমন একটি ভিডিওর মাধ্যমে কয়েক মিনিটের মধ্যে আবু বকর হত্যার মিথ্যা প্রচারণার সংবাদ হাজার হাজার ছাত্রের কাছে পৌঁছে গেল। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, যারা আবু বকর হত্যার গুজব সর্বত্র ছড়িয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ত গরম করল, তাদের কারও মাঝেই আবু বকর বেঁচে আছে এমন সংবাদে স্বস্তির চিহ্ন দেখা গেল না। বরং তারা আগের মতোই প্রচার করতে লাগল যে, আবু বকর বেঁচে থাকার সংবাদটি অপপ্রচার। সেদিন যারা ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হত্যাকা-ের মিথ্যা গুজব ছড়িয়েছিল, তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল? বার বার তারা কেন প্রচার করতে লাগল আবু বকর মারা গেছে? উপাচার্য মহোদয়ের বাসায় যে সব ব্যক্তিরা জঙ্গী কায়দায় প্রবেশ করল, তারা সবাই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল? যারা উপাচার্যের বাসার ভেতর প্রবেশ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এই বর্বরতম অধ্যায়ের সূচনা করল, তাদের উদ্দেশ্য এবং এই আন্দোলনে যে সব শিক্ষার্থী তাদের দাবির একটা সুষ্ঠু সমাধান চেয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য কি এক ছিল? সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় আগুন ও তাকে হত্যা চেষ্টার কথা শুনে, আমিও তাকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম। সেখানে হামলাকারীদের মধ্যে আমি দু’-তিন জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকেও দেখতে পেয়েছিলাম। যারা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বিভিন্ন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। তখন আমরা ব্যস্ত ছিলাম উপাচার্যকে নিয়ে। তিনি কেমন আছেন? কোথায় আছেন, তার কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা? সেদিন উপাচার্য মহোদয় এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন যে, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এমন কাজ করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমি নিজেই ঢাবির দুজন ছাত্রকে দেখেছি, যা আমাকে আজও কষ্ট দেয়। যারা রাতের আঁধারে, মিথ্যা অপপ্রচার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন বর্বরতম ইতিহাসের সূচনা করেছে তাদের বিচার প্রক্রিয়া থেমে থাকা কোনভাবেই কাম্য নয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের তদন্ত ও অন্যান্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা তদন্তকে আরও গতিশীল দেখতে চাই। সেদিন যারা মিথ্যা অপপ্রচার করে জঘন্যতম এই কাল রাতের সূচনা করেছে, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তাদেরও শাস্তি চাই। আমি বিশ্বাস করি, সেদিন আবু বকর হত্যার গুজব ও মিথ্যা জানার পরও যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তা-বলীলা চালিয়েছে, হত্যার বিষয়টি ফলাওভাবে প্রচার করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বিভ্রান্ত করেছে। হোক তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা বহিরাগত, তারা সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ধোঁকা দিয়েছে এবং তারা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। জাতির শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টি করে কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী তাদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর এমন কোন প্রতারণামূলক উদ্দেশ্য ছিল না। এসব দুষ্কৃতকারীর শাস্তির আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে তৎপরতা চালাচ্ছে, সেখানে যারা বাধা সৃষ্টি করছে, নিরপরাধ শিক্ষার্থীরা হেনস্তার শিকার হবে বলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে এবং সব ধরনের বিচার প্রক্রিয়াকেই বাধাগ্রস্ত করারই চেষ্টা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে তারাই দুষ্কৃতকারীদের শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে সহযোগিতা করছে। আমার মতো ঢাবির প্রত্যেকটি সাধারণ শিক্ষার্থী সেদিনের সেই কাল রাতের সুষ্ঠু ও যথাযথ বিচার দেখতে চায়। দুষ্কৃতকারী যেই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পবিত্র অঙ্গনকে যারা কলঙ্কিত করেছে তাদের শাস্তি হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমনিভাবে যুগে যুগে ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে, মিথ্যাকে কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা মেনে নেয়নি, তেমনিভাবে আবু বকর হত্যার মিথ্যাচারের মাধ্যমে এই কাল রাতের কুশীলবদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনও মেনে নেবে না। তাদের পরাজয় অনিবার্য। শতবর্ষের পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমার বিশ্বাস এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপশক্তির পতন হবেই হবে। লেখক : ছাত্র নেতা
×