ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

নকল করে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করা যায় না

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৩০ জুন ২০১৮

নকল করে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করা যায় না

একটি বাস্তবতা হলো পরীক্ষায় নকল করে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করা যায় না। বড়জোর থার্ড ডিভিশনে উৎরে যাওয়া যায়। তাও সব সময় সর্বক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। জলপানিসহ ফার্স্ট ডিভিশন পেতে হলে নিজস্বতা মৌলিকতা লাগে। বিষয়টি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটি নির্বাচনে সে জাতীয় হোক আর স্থানীয় সরকার হোক পার্টি যখন নমিনেশন দেয় তখন অনেক জিনিস বিবেচনা করে- তার মধ্যে সর্ব প্রথম হলো প্রার্থীর আদর্শিক দিক গুরুত্ব দেয়া, তারপর দেখা হয় তার যোগ্যতা, এটিও ব্যাপক অর্থে অর্থাৎ তার জনপ্রিয়তা আছে কি-না, আর্থিক সঙ্গতি কতখানি, তার এলাকার দল ও কর্মীদের মধ্যে তার বিশ্বস্ততা কতখানি এবং সব সময় এলাকায় যাতায়াত বা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কতখানি ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। একজনের চেহারা ভাল, টাকা আছে এই অঙ্কে নমিনেশন দিলে যা হওয়ার তাই-ই হবে। কিংবা হোল্ডা-গু-া-ম-া শুধু এই বিবেচনার ভিত্তিতে নমিনেশন দেয়া হলে দেখা যাবে গু-াবাহিনী ঘুরে বেড়াবে, ভোটার চোখে পড়বে না। সাম্প্রতিককালে দুটি সিটি কর্পোরেশন- খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচন হয়ে গেল। কিছু অনিয়ম হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও ওভারঅল নির্বাচন যে সুষ্ঠু এবং স্বাভাবিক হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবুুও একশ্রেণীর সমালোচক আছেন যাদের ভাগে তাল গাছ না পড়া পর্যন্ত ভাগ সুষ্ঠু হয়েছে স্বীকার করবে না। এখানে থেমে থাকলেও কথা ছিল না। কিন্তু এটা নিয়ে তারা টক-শোতে বসে হাছা-মিছা যা খুশি বলতে থাকবে। এটি বিএনপির চরিত্র যা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের মূল আদর্শ। পবিত্র ধর্মের কথা বলে সঙ্গে সঙ্গে ডাহা মিথ্যা বলবে। বিএনপি খালেদা জিয়াকে ‘ম্যাডাম’ ‘চেয়ারপার্সন’ নাম দিয়ে একটা মিথ্যা ভাবমূর্তি বানাবে, তাতে তাদের এতটুকু চক্ষুলজ্জা নেই। হুইসপার ক্যাম্পেন করে মানুষকে বোঝাবে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান কোন দুর্নীতি করেনি, ওসব আওয়ামী লীগের প্রচারণা? দুর্নীতি করলে কি গায়ে কালি পড়ত না, চেহারা এত সুন্দর থাকত কি? সর্বশেষ নির্বাচনটি হলো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাকে নমিনেশন দিয়েছে সেই জাহাঙ্গীর আলম দলীয় আদর্শের দিক থেকে নিখাদ, তরুণ। এবং তরুণ বলেই বিশাল এক কর্মী বাহিনী গড়ে তোলেন অনেক আগে থেকেই। মানুষের বিপদে আপদে সব সময় পাশে থাকার চেষ্টা করছেন প্রথম থেকেই। একজন রাজনৈতিক কর্মী এভাবে প্রি-ইলেকশন প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে বিএনপি এক ভদ্রলোককে নমিনেশন দিয়েছেন যিনি ভোট দিতে গেছেন দু’জনের কাঁধে ভর করে। তারপরও বলব বয়স বড় কথা নয়, তার তো আদর্শিক জায়গাটা প্রথম থেকেই নড়বড়ে। তিনি পাকিস্তান আমলে কোন্ দিকে ছিলেন বা মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা কি, সে প্রশ্ন তো আছেই, সঙ্গে সঙ্গে তিনি কখনও বিএনপি কখনও জাতীয় পার্টি আবার বিএনপি। এরপর কোথায় যাবেন সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতো পকেটগুলোতে একেকটি দলের একেকটি জ্যাক নিয়ে ঘোরেন। যে দিকে সুবিধা বেশি সেদিকের বোর্ডে জ্যাকটা লাগিয়ে দিয়ে আবার দিব্যি পেছনের দলের সমালোচনামুখর হবেন। হিন্দু থেকে মুসলমান হলে সবচেয়ে বেশি খায় গো-মাংস আর মুসলমান থেকে হিন্দু হলে (অবশ্য হিন্দু ধর্মে তা নেই) গো-গোবর- এভাবে বিশ্বস্ততা প্রমাণ করবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আমি প্রথমেই বলেছি পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেতে হলে নিজস্ব মৌলিকতা বা স্বকীয়তা থাকতে হয়। গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সেসব বিবেচনা করে জাহাঙ্গীর আলমকে নমিনেশন দেয়, নৌকা প্রতীক দেয় জাহাঙ্গীর তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগের নৌকা ও বিএনপির ধানের শীষের প্রতীকে। একটা ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না এই নৌকা ১৯৫৪ সালের নৌকা, এই নৌকা ১৯৭০ সালের নৌকা, এ নৌকা স্বাধীনতার নৌকা, এই নৌকার কা-ারি ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতির রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর আজ কা-ারি বঙ্গবন্ধুরই কন্যা দেশরতœ স্টার অব দ্য ইস্ট শেখ হাসিনা। এই নৌকা যেমন রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, তেমনি আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, ঊনসত্তরের ছাত্রগণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে, একাত্তরের মার্চ মাসব্যাপী দুনিয়া কাঁপানো অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, সর্বোপরি বাঙালী জাতির হাজার বছরের স্বপ্নসাধ আপন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছে। এমনি এমনি এই স্বাধীনতা আসেনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং কিভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে (মুক্তিযুদ্ধ) স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করতে হবে, শত্রুমুক্ত করতে হবে, তার রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও সামরিক দিক নির্দেশনা দেন। এভাবে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও ৫ লক্ষাধিক মা-বোনের ওপর নির্যাতনের বিনিময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। আবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নৌকার হাল ধরেন তারই কন্যা আজকের বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনেতা শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে এই নৌকা ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় এনেছে, তারপর ২০০৮ আবার ক্ষমতায় আনে। আজও নৌকা রাষ্ট্রক্ষমতায়। পক্ষান্তরে জাহাঙ্গীরের প্রতিদ্বন্দ্বী হাসানউদ্দিন সরকারের প্রতীক এবার ধানের শীষ, অতীতে ছিল লাঙ্গল- এখানেই তো ভোটার জনগণ বিভ্রান্ত হয়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটার জনগণ সেই বিভ্রান্তি মোকাবেলা করে একচেটিয়া নৌকায় ভোট দিয়েছে। জাহাঙ্গীর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে জয়লাভ করেছে। সর্বশেষ হিসেবে অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম পেয়েছেন ৪ লাখের বেশি ভোট, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হাসান সরকার পেয়েছে দুই লাখেরও কম। অর্থাৎ ভোটের ব্যবধান দুই লাখেরও বেশি, হাসান সরকারের ডাবল। ওখানে ভোট পড়ে ৫৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক দেশের সর্ববৃহৎ প্রচারিত বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো’ ফলাফল প্রকাশের সংবাদের প্রথমে বলেছে- ‘খুলনার অভিজ্ঞতা থেকে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী কৌশলে পরিবর্তন আনলেও সেটা মোকাবেলা করার মতো পাল্টা কৌশল বিএনপি নিতে পারেনি।’ অর্থাৎ পাল্টা কৌশল নেয়ার মতো কর্মী বাহিনীই তাদের নেই। অবশ্য পত্রিকাটি বিএনপি কর্মীদের ‘মাঠ ছাড়া’ করার অভিযোগও তুলেছে। কিন্তু পত্রিকাটি জানে না কর্মী বাহিনীকে মাঠ ছাড়া করতে হয় না। তারা যখন দেখে দল দুর্বল প্রার্থী দিয়েছে তখন তারা এমনি এমনি মাঠ ছেড়ে দেয়। পুলিশের এ্যাকশনের কথা বলেছে, আবার পত্রপত্রিকাই লিখেছে নাশকতা করার লক্ষ্য নিয়ে এক মেজর (অব.) মিজানুর রহমান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে ধরা পড়েছে। কাজেই বাকিরাও ধরা খাওয়ার ভয়ে পালিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে এটা ২০০১ নয়, ভুয়া ভোটও নেই, বিএনপিপন্থী তত্ত্বাবধায়কও নেই। ২০০১-এ একদিকে এক কোটি ২৪ লাখ ভুয়া ভোটের ব্যাপার, ব্যালট ভর্তি অতিরিক্ত বাক্স কেন্দ্রে সরবরাহ ও গণনা করে রেজাল্ট ডিকলায়ার এবং ভোট গণনায় শুরু থেকে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ ও হিন্দু সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন- এসব এবার চলবে না তাই বিএনপি কর্মীরা মাঠ ছেড়েছে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরে ধানের শীষে ভোট দেয়ার পরিকল্পনার মতো বালখিল্যতা এ যুগে চলে না। একটি কেন্দ্রের ভোটাররা একজন আরেকজনকে চেনেন-জানেন, এ তথ্যটা বিএনপিওয়ালারা বোঝেন না। তারা সব মানুষকে বোকা ভাবেন। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার ভুললে চলবে না মেয়র ইলেকশনের সঙ্গে সঙ্গে কমিশনার প্রার্থীরাও রয়েছেন। তাদের চোখকেও ধুলা দেয়া সম্ভব নয়। খালেদা জিয়া বা তদীয় পুত্রের (দু’জনই দুর্নীতির মামলায় সাজা ভোগ করছেন, তাদের তো লন্ডন পলাতক) মতো অশিক্ষিত লোক এসব কথা না জানলেও মওদুদ-মোশাররফ-এমাজ উদ্দীনরা ভাল করেই জানেন। তাদের বিএনপিতে এখন চলছে নেতৃত্বের শূন্যতা কে পূরণ করবে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা? মওদুদ না মোশাররফ এটিও মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন? মির্জা ফখরুল এবং রুহুল কবির রিজভীর খালেদা-তারেকের চাকরি করেন, অতএব তাদের হাছা-মিছা বলতেই হবে। তাছাড়া বিএনপির নেতৃত্বে কর্মী লেভেলে কোন সংযুক্তি সাম্প্রতিককালে হয়নি। প্রবীণ-নবীনের সমন্বিত শক্তি একটি দলের গতিময়তা ও অগ্রযাত্রার যোগান দেয়, বিএনপির তা নেই। তারা আগের মতো হাওয়া ভবন খোয়ার ভবনের স্বপ্ন নিয়ে ব্যস্ত। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনা যেমন দেশকে ডিজিটাইজড করেছেন, মহাসমুদ্রের তলদেশ থেকে মহাকাশের কক্ষপথে অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন এবং উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে এ অঞ্চলের সব ক’টি দেশকে কোন্টাকে সম্পূর্ণরূপে কোন্টাকে আংশিকভাবে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছেন, তেমনি দলের আধুনিকায়ন, তারুণ্যের সমাহার, কর্মী বাহিনী সৃষ্টি এবং প্রবীণ-নবীনের সমন্বিত শক্তির মহাসমাবেশ ঘটিয়েছেন দলে এবং এগিয়ে চলেছেন- সামনে ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এসব তো আছেই, সর্বোপরি সামনে জাতীয় নির্বাচন- এসব মাথায় রেখে দলকে সাজিয়েছেন। বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মা সেতু নির্মাণ বা মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ এবং দ্বিতীয়টির কাজ শুরু, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা বা মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু বৃদ্ধির সাফল্য শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, আওয়ামী লীগ এবং নৌকার পক্ষে যোগ হয়েছে। জিয়া থেকে খালেদা-হাসান সরকার এমন একটি উদাহরণও সৃষ্টি করতে পারেনি যা দেখে তরুণ সমাজ আকৃষ্ট হবে। বরং খালেদা-তাদের (সহোদর ভাই) কর্মশক্তি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর হয় গর্তে ঢুকেছে নয়ত পালিয়েছে। বিএনপি কর্মী পাবে কোথায়? যদিও ব্যারিস্টার মওদুদ ক’দিন আগে হুমকি দিয়েছেন ‘এবার আন্দোলন অহিংস হবে না।’ তার কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা সন্ত্রাসী কার্যক্রমকেই উস্কে দেয়। অবশ্য তার একটা টার্গেটও আছে। যদি আরেকবার প্রধানমন্ত্রী বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়া যায়। কিন্তু তার পেছনটা যে ফাঁকা সেদিকে খেয়াল নেই। আওয়ামী লীগ শুধু যে কেবল সিটি কর্পোরেশন বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে দলকে বিজ্ঞান মনস্ক ও আধুনিক করে তুলে এগিয়ে চলেছে, একই সঙ্গে পরবর্তী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনকে টার্গেট করে এগিয়ে চলেছে এবং লক্ষ্য ভিশন ২০২১ এবং ২০৪১। শেখ হাসিনা সেই অগ্রযাত্রার সিপাহসালার আর জাহাঙ্গীর আলমরা তার এক একজন সৈনিক। ঢাকা : ২৯ জুন, ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ই-মেইল: [email protected]
×