ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৩০ জুন ২০১৮

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার

রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হামলার নেতৃত্ব দেয়ায় মিয়ানমার সেনাপ্রধান ও শীর্ষস্থানীয় অন্য কর্মকর্তারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এ অভিযোগ এনে তাদের বিচারের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান। রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর নির্যাতন ও সহিংসতার কারণে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘ এ ঘটনাকে ভয়াবহ ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এ্যামনেস্টির প্রতিবেদনটি মিয়ানমার ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৪০০ জনের নেয়া সাক্ষাতকার ও স্যাটেলাইট ইমেজের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কিছু কিছু সেনা আইন ভেঙ্গে এমনটা করতে পারে বলে সামরিক বাহিনী এত দিন ধরে যে দাবি করে আসছিল, তা এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। শাক দিয়ে হয়ত মাছ ঢাকা যেতেও পারে, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ খুন করে পার পাওয়া যায় না। সাম্প্রতিক ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার ঘটনাকে বরাবরই অস্বীকার করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে মিয়ানমার সরকার। কিন্তু একপর্যায়ে রাখাইনে পাঁচটি গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় নতুন করে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে দেশটি। এটাই নিয়তি এবং পরিণতি। পাপ করে শেষ পর্যন্ত রেহাই মেলে না। রাখাইনে এই গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও ওঠে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যা, ধর্ষণ, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে মিয়ানমার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করেছে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণআদালত। গত বছর ১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা, কাচিনসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকার পরিচালিত গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, বিশেষজ্ঞ সাক্ষ্য, বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে ইতালির রোমভিত্তিক সংস্থা পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) গত ২২ সেপ্টেম্বর ওই রায় ঘোষণা করে বলেছিল, মিয়ানমার সরকারের ওপর জরুরী ভিত্তিতে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। ওই রায় ঘোষণার ফলে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক চাপেও পড়েছিল। যদিও এখনও পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার সুকৌশলে সব দায় এড়িয়ে চলেছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে যা ঘটেছে, তা গণহত্যা বৈ অন্য কিছু নয়। এই নৃশংসতা-বর্বরতা হিটলারের নাৎসি-গেস্টাপো বাহিনী, মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী আর একাত্তরে বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগুন থেকে বাঁচতে যখন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই প্রাণভয়ে ছুটেছে, তখন যুবকদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে, কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে। এত কিছুর পর তাদের সামনে দেশত্যাগ ছাড়া কোন পথ খোলা ছিল না। তারা নাফ নদী পেরিয়ে, পাহাড় বেয়ে বাংলাদেশে ছুটে এসেছে; আগতদের অনেকে অমানবিক ধর্ষণ ও নির্যাতনের স্বাক্ষর বহন করছে। একাত্তরে বাংলাদেশে হামলার হোতা ছিল সামরিক জান্তা। এর আগেও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা হয়েছিল। তখন ক্ষমতা ছিল সামরিক জান্তার হাতে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন, আহ্বান ও বিচারের দাবিকে বিবেচনায় নিয়ে অচিরেই আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হবে। জাতিগত নিধনকারীর উচিত শাস্তি নিশ্চিত না করতে পারলে আমরা নিজেদের সভ্য মানব বলে দাবি করব কীভাবে?
×