ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সময়গুলো ঘুমন্ত সিংহের

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২৯ জুন ২০১৮

সময়গুলো ঘুমন্ত সিংহের

‘সময়গুলো ঘুমন্ত সিংহের’ প্রথম কবিতার নাম ‘মহুয়ার মুখ’ও শেষ কবিতার নাম ‘প্ররোচনা’। ‘মহুয়ার মুখ’-ই কি তাহলে নদের চাঁদকে ‘প্ররোচনা’ দিয়েছিল? হয়তবা। আমার দর্পণে ‘মহুয়ার মুখ’ এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। মহুয়াকে ‘পাঠ’ করলে কবির মন ‘ধানের শিষের ন্যায় নুয়ে পড়ে।’ মহুয়ার বুক ‘তালপাখার বাতাসের মতো ঠাণ্ডা।’ তার গায়ের রং রসাল আপেলের মতো বর্ণিল, মসৃণ। তার ‘ঠোঁট গমের রুটির মতো সুস্বাদু’Ñ এই রকম একজন চিরন্তন সৌন্দর্যের অধিকারিণী নারী কবির পৌরুষডালে ভুঁইচাপার মতো ফুটে আছে! শুধু কি তাই? ‘মাতৃভূমি যেমন পৃথিবীর অন্য কোন ভূমির চেয়ে স্বমহিমায় উজ্জ্বল’, ঠিক তেমনি মহুয়াও রং-বেরঙয়ের নারীদের মাঝে উজ্জ্বলতর তন্বী রমণী। তাই কবি সেই অপরূপ সৌন্দর্যের আঁধার মহুয়াকে হাতছাড়া করতে চান না। তার রূপের পানসিতে উঠে যৌবনের হাল টানতে চান কবি। আলোচ্য কবিতায় ‘মহুয়া’ রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়িনী’র মতো কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নন, এ মহুয়া কবির কাছে কামনারও প্রতীক। তাই মহুয়ার ব্লাউজে, তার ঠোঁটে, কবি খুঁজে পান ক্লান্তি মোচনের এক অব্যর্থ সূত্র। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘উপমাই কবিত্ব’। মহুয়াকে বর্ণনা করতে কবি এখানে উপমা ব্যবহারে যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা সত্যি মনোমুগ্ধকর। ‘কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে’, তবুও কবিতায় কবিকে পাওয়া যায়। কবি পলিয়ার ওয়াহিদের ‘সময়গুলো ঘুমন্ত সিংহের’ কাব্যগ্রন্থে কবি তার চলে যাওয়া দিনগুলোকে স্মরণ করেছেন। এই কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কবির আত্মপরিচয় পাওয়া যাবে নাম কবিতার মধ্যে। আত্মনগ্নায়ন করার জন্য কবি এই কবিতায় উপমার যে ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন তা সত্যি বিস্ময়ের বটে। কাব্য রচনাই যে এই কবির আগামী জীবনের ভবিতব্য তার ইঙ্গিত পাই তার প্রত্যয়পূর্ণ বিশ্বাসে- ‘মুত্যুর মতো নিশ্চিত জানতাম- আমি কবি।’ কবি কামনায় যেমন হয়ে পড়েন ক্ষুধার্ত বাজপাখির মতো ক্ষিপ্র, হিং¯্র্র, তেমনি বিলাসী প্রেমিকার কাছে তিনি হয়ে যান কবরের মতো শান্ত, স্থির, নীরব, নিশ্চুপ। কবি অতীতে কী ছিলেন, তাকে কী হতে বলা হয়েছিল? এসবই নাম কবিতার প্রথম থেকে বর্ণিত আছে। কিন্তু কবিতার শেষ দুটো পঙ্ক্তিতে আছে কবির জীবনের অতীতের সঙ্গে বর্তমান জীবনের মেলবন্ধন : ‘আমি চিরকাল খরগোশের মতোন দ্রুত আর বাতাস এবং পাখির মতো স্বাধীন।’ (সময়গুলো ঘুমন্ত সিংহের) ‘গৃহবিষয়ক’ কবিতায় আমরা পাই এক সাহসী উচ্চারণ। তিনি বলেন ‘দেশপ্রেম হলো- জোর করে চাপানো দায়িত্বের ঝোলা!’ বিশ্বের সর্বত্রই (বিশেষত সংখ্যালঘুদের) আজ দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে হচ্ছে। কবির মনে না পাওয়া, না দেখার বেদনা আছে। সেই ব্যথাগুলো স্রোতহীন পুকুরের শ্যাওলার মতো কবির হৃদয়ে অনবরত একটা গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি করে। কবি জানতে চেয়েছেন স্বাধীনতা মানে কি শুধুই একটা পাতাকা? কবি দেশে স্বাধীনতা দেখতে পান না। চারদিকে পরিবার তন্ত্রের দাপটে আজ গণতন্ত্র বিপন্ন, বিপর্যস্ত। ইতিহাস বলে দেশ স্বাধীন কিন্তু কবির মন তাতে সায় দেয় না। কবি এই পতাকা সর্বস্ব স্বাধীনতা চাননি, কবি চান অনাহারের জন্য দুটো ভাত। যেন এই একই কণ্ঠ আমরা শুনেছিলাম বিদ্রোহী কবির কলমে। ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত... একটু নুন।’ (কাজী নজরুল ইসলাম) ‘অবৈধ সময়ে আমার জন্ম’, ‘আমরা সবাই সময়ের অবৈধ সন্তান!’ এখানে কি আমাদের জীবনানন্দের কথা মনে পড়ে না? ‘চারদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’ কিন্তু সে জীবনের মাঝে কোন মানবিকতা নেই। আসলে মুখ এবং মুখোশের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘অবৈধ সময়’ কবিতার মধ্যে। এই কবিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির প্রসঙ্গ। কটাক্ষ করা হয়েছে চে গুয়েভারার গেঞ্জি পরে গাঁজা টানতে ব্যস্ত নব্য যুবক-যুবতীদের। উঠে এসেছে হেফাজতে ইসলামের কথা। তুলে ধরা হয়েছে এক সেøাগান : ‘সুন্দরবন মানেই বাংলাদেশ।’ একটা ছোট কবিতা। ছয় পঙ্ক্তির কবিতা ‘কাঠবাদাম’। কি অসাধারণ ব্যঞ্জনায় ভরপুর এ কবিতা। কবি এখানে ছয় লাইনে যা বলেছেন তা যেন ছয় শ’ লাইনের সংক্ষিপ্তসার। প্রেমিকা অথবা মাতৃভূমি সব সময় কবির ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। চাওয়ার সঙ্গে না পাওয়ার যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব তা ফুটে উঠেছে এখানে : ‘কাঠবাদামের পাতা তোমার চ্যাপটা বুক- আমাকে প্রশ্রয় দেয়। অথচ নদী ভরাটের মতোন তুমি চিরকাল বেদখল- দুর্বৃত্তের হাতে!’ এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে কবি অজিত দত্তের ‘নোঙর’ কবিতার কথা : ‘পাড়ি দিতে দূর সিন্ধু পারে নোঙর গিয়েছে পড়ে তটের কিনারে সারা রাত মিছে দাঁড় টানি মিছে দাঁড় টানি।’ জ্ঞান-বিজ্ঞান এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, পাচ্ছে। পরোক্ষে হলেও অনেক সাহিত্য ও সাহিত্যকারেরা নাস্তিকতার পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছেন। কিন্তু ধর্ম ছাড়া নৈতিকতা সাধারণত জন্মায় না। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে যারা মুখে নাস্তিক বলে নিজেদের প্রমাণ করেন তারা মনেপ্রাণে অতটা নাস্তিক নন। তাই- ‘বৃষ্টিরাতে কবিতার মিষ্টি ঠোঁটে পাঠ করি; প্রার্থনার দোয়া ও দরুদ!’ (অনুভূতিধুলো) কবিতার নাম ‘সেফটিপিন’। কিসের সেফটিপিন? ধর্ম কি মানুষের সেফটিপিন? এই কবিতার মধ্যে কবি ইসলাম, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম ও ধর্মস্থানের প্রসঙ্গ এনেছেন। কবির বক্তব্য, আগে মানুষকে মানুষ হতে হবে, তার পর যে যার ধর্মে স্বতন্ত্র থাকুক। তা না হলে প্রকৃত মানুষ হওয়া যাবে না। তবে কবিতার শেষ চরণ- ‘পৃথিবীতে আল্লাহও সহায় সম্বলহীন!’ কবিকে বিতর্কে জড়াবে সন্দেহ নেই। ‘প্রযুক্তি পুরুষ’ কবিতায় সমসাময়িক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। তবে ‘নুনু’ শব্দে এসে অনেকের খটকা লাগা স্বাভাবিক। ‘রোহিঙ্গা’ শিরোনামে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি কবিতা আছে। কবি নিজের নামে একটি কবিতা লিখেছেন ‘পলিয়ার ওয়াহিদ’। ‘কণ্ঠপূর্ণ গান’ ও ‘ইশকুল’ কবিতাদ্বয় দেখে গদ্য বলে ভ্রম হতে পারে। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কবিতাদ্বয়ের মধ্যে কাব্যিকতা আছে। ‘আমি পাঠ্যবই’ কবিতায় বাংলা ভাষা সম্পর্কে কবির একটি অসাধারণ চরণ- ‘এই ভাষা নদীর তরঙ্গের মতো মিষ্টি।’ সত্যিই মিষ্টি। ‘সংখ্যালঘু’ শব্দের ওপর কবির আপত্তি আছে। তবুও কবি কেন যে কবিতার নামকরণ করেছেন ‘সংখ্যালঘু’ তা বোধগম্য নয়। এই কবিতায় কবি ‘সংখ্যালঘু’ বিষয়টিকে নস্যাত করেছেন। কিন্তু কবিতাটি নিয়ে বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সংখ্যালঘুরা দেশে-দেশে অবদমিত। কিন্তু কবি সেই অবদমনের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। ‘সংখ্যালঘু’ শুধু ধর্মে নয় ভাষায়, চিন্তায়-চেতনায়ও মানুষ সংখ্যালঘু হয়। ‘সংখ্যালঘু’ কবিতার বিষয় নিয়ে কবি তাঁর মতামত স্পষ্ট করবেন এই আশা করি।কবিতা সম্পর্কে আমার এই মতামতের কথা শুনে কবি হয়ত জীবনানন্দের ভাষাতেই বলবেন- ‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা’ (সমারূঢ়)। কবি কবিতা লেখেন তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনার স্তর থেকে। আবার কবির মন কখনও হয়ে ওঠে জনগণের প্রতিভূ। কবিতার লেখক ও কবিতার পাঠক- এই দুইয়ের সুনিপুণ মেলবন্ধন হলেই কবিতা হয়ে ওঠে সার্থক- ‘কবিতা সৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য’ (জীবনানন্দ দাশ)। এ তারতম্য ছিল, আছে এবং থাকবেও। এভাবেই বেঁচে থাকবে বাংলা কবিতার জগত। সব মিলিয়ে পলিয়ার ওয়াহিদের নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘সময়গুলো ঘুমন্ত সিংহের’ একুশ শতকের কাব্য জগতের এক নবতম সংযোজন-এ কথা বলতেই পারি। পলিয়ার ওয়াহিদের কাব্যগ্রন্থ ‘সময়গুলো ঘুমন্ত সিংহের’ (২০১৮) কাব্যগ্রন্থটিতে সর্বমোট ৬৪টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে দেশ-বিদেশের সর্বমোট ৫৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে।
×