ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বনাঞ্চল উজাড়

ঝুঁকিতে সাগরপারের মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৯ জুন ২০১৮

ঝুঁকিতে সাগরপারের মানুষ

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ২৮ জুন ॥ সিডরের মতো বুলডোজারখ্যাত সুপার সাইক্লোন থেকে সাগরপারের পটুয়াখালীর কলাপাড়ার গোটা উপকূলের মানুষের জীবন-সম্পদহানির ৯০ ভাগ রক্ষা পেয়েছিল বেড়িবাঁধের বাইরের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল থাকার কারণে। প্রাচীন এই গাছগুলো যেন বুক আগলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা থেকে মানুষ ও তাদের সম্পদ রক্ষা করেছে। সিডরকালীন পরিসংখ্যান মতে যেসব স্পটে বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের বাইরে বনাঞ্চল ছিল ওই বাঁধ বিধ্বস্ত হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সূত্রমতে, সিডরের তা-বে কলাপাড়ায় ১১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়। এছাড়া ২০৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ক্ষতির শিকার হয়। মোট ৪০৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে এ পরিমাণ বাঁধ ক্ষতির কারণ ছিল এইসব বাঁধের রিভার সাইটে বনাঞ্চল ছিল না। অথচ সিডর পরবর্তী ১১ বছরে বেড়িবাঁধের বাইরের অন্তত আরও দেড় শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বাইরের প্রাচীন ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে। কেউ এসব গাছ কেটে ইটভাঁটিতে বিক্রি করেছে। কেউ জ¦ালানি কাঠ হিসেবে বিক্রি করেছে। কেউ পেশাগতভাবে বনদস্যুতা করেছে। এছাড়া এসব বনাঞ্চল কেটে বাড়িঘর, ইটভাঁটি, মাছের ঘের করা হয়েছে শত শত। আবার কলাপাড়া ভূমি অফিসের সার্ভেয়াররা বনাঞ্চলকে চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়ায় গাছ কেটে সেখানে ঘরবাড়ি-পুকুর করা হয়েছে। এককথায় সবুজ দেয়ালখ্যাত প্রাচীন ম্যানগ্রোভ প্রজাতির এই বাগান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আর মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিনাশী এই অরাজকতা এখন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকালীন দুর্যোগ চরম ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছে সাগরপারের মানুষকে। সরেজমিনে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে কী পরিমাণ ম্যানগ্রোভ প্রজাতির প্রাচীন বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে। আন্ধার মানিক নদীর সঙ্গে সংযোগ সোনাতলা নদী সেখান থেকে সাপুড়িয়ার খালখ্যাত শাখা নদীটিকে বলা হয় মধুখালীর লেক। এই লেকটি অন্তত ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ। লেকটির অবস্থান মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নে। লেকের দুপাড়ে দশ বছর আগেও বেড়িবাঁধঘেঁষা হাজার হাজার প্রাচীন ম্যানগ্রোভ প্রজাতির ছইলা-কেওড়া-বাইনসহ গুল্মজাতীয় গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল। সন্ধ্যার পরে বেড়িবাঁধে মানুষ একা চলত না। কারণ বন্যপ্রাণী ছিল তার আক্রমণের ভয়ে। কিন্তু এখন এই লেকটির দুই পাড়ের অন্তত আট কি.মি এলাকা বিরানভূমি হয়ে গেছে। গাছপালা কেটে বিলীন করে দেয়া হয়েছে। মধুখালী সেতুর দুই দিকে এখনও যা অবশিষ্ট রয়েছে তাও নিত্যদিন কাটা হচ্ছে। দীর্ঘ এ লেকটি এখনও কোনমতে স্বকীয়তা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু লেকটির দুইদিকে এখন আবার বন্দোবস্ত কেসের দাবিদাররা গাছপালা কেটে বাড়িঘর, মাছের ঘের করছে। সম্প্রতি শতাধিক প্রাচীন গাছ কেটে দখলে নামে একটি চক্র। স্থানীয়রা নিজের দায়বোধ থেকে বাধা দেয়। কিন্তু বনবিভাগের ভূমিকা খুবই রহস্যজনক। কারণ গেল পঞ্চাশ বছর এই গাছপালা তারা দেখাশোনা করত। গাছ কাটলে বাধা দিত। বহু মানুষের নামে মামলা দিয়েছে। অথচ এখন বলছে এই বাগান তাদের নয়। মানুষ এতে হতবাক। কতটা দায়হীনভাবে এ কাজটি করল বনবিভাগ। যেন বন দখলদারদের উৎসাহ দেয়ার সুযোগ করে দিল বনবিভাগ। পূর্ব-মধুখালী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল জব্বার জানান, এই বাগান না থাকলে তাদের ঘরবাড়িসহ সম্পদ সব জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যেত। কারণ বেড়িবাঁধ রক্ষা করছে বনাঞ্চলটি। এখন যে যার মতো গাছ উজাড় করছে। কুয়াকাটা পর্যটন এলাকা ঘেরা ৪৮ নম্বর পোল্ডারের বেড়িবাঁধ ৩৯ কিলোমিটার। যার বেড়িবাঁধের বাইরে ছিল সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বাঁধের ঢালে ছিল হাজার পাহাড়ী নিমসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন গাছ। এর একদিকে সাগরঘেঁষা কুয়াকাটা সৈকতের প্রায় ১৭ কিলোমিটার সংরক্ষিত বনাঞ্চল সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে বিলীন হয়ে গেছে অর্ধেকটা। এছাড়া বনদস্যুদের তা-ব তো আছেই। এর মধ্যে ৩৩ কানি পয়েন্টের প্রায় দুই শ’ প্রাচীন গাছ দুই বছর আগে কেটে বিশাল এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত করেছে। এছাড়া ধুলাসার, কাউয়ারচর, গঙ্গামতিসহ চাপলী বাজার হয়ে খাজুরা পর্যন্ত এলাকার বেড়িবাঁধের বাইরের বনাঞ্চল না থাকায় এই বেড়িবাঁধ এখন জলোচ্ছ্বাস ঝুঁকিতে রয়েছে। এ বাঁধটি আধুনিকভাবে পুনরেকত্রিকরণের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সবুজ দেয়ালখ্যাত ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল না থাকায় বাঁধটি জলোচ্ছ্বাস ঝুঁকির কবলে পড়ার শঙ্কা থেকেই যাবে। এমনকি এই বাঁধের আলীপুর বন্দর সংলগ্ন স্লুইস নির্মাণ কাজে ফাতরাসহ সংরক্ষিত বনের সুন্দরি গেওয়া প্রজাতির শত শত গাছ কেটে পাইলিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পোল্ডারের চারদিক ঘুরে দেখা গেছে, সহ¯্রাধিক বাড়ি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল কেটে করা হয়েছে শত শত পুকুর, মাছের ঘের। বাদ যায়নি ইটভাঁটি করা থেকে। যেন প্রাচীন ম্যানগ্রোভ প্রজাতির সবুজ দেয়ালখ্যাত গাছগুলো নিধনযজ্ঞ চলছে। ধুলাসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল আকন জানান, গত দশ বছর আগে তার ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের বাইরে সংরক্ষিত এবং ম্যানগ্রোভ প্রজাতির যে পরিমাণ বনাঞ্চল ছিল তার অর্ধেক নেই। ফলে দুর্যোগকালীন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি বাড়ছে জলোচ্ছ্বাসের। সাগরের অব্যাহত ভাঙ্গন ছাড়াও বনদস্যুদের ছোবলে এসব বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। টিয়াখালীর চেয়ারম্যান মশিউর রহমান শিমু জানান, তার ইউনিয়নে টিয়াখালী পায়রা বন্দর প্রকল্প এলাকার উত্তরদিকে এমএম বিল্ডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেড়িবাঁধের বাইরের বনাঞ্চল স্লুইস সংযুক্ত সরকারী খাল দখল করে বালুতে ভরাট করে নিয়েছে। বনবিভাগ কিংবা সরকারী প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এখন কৃষক চাষাবাদে জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। আর উজাড় হয়ে গেছে। এভাবে উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভার কোন বেড়িবাঁধের বাইরের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চলের প্রাচীন গাছ থাকছে না। কলাপাড়া ও মহিপুর বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তাসহ বনরক্ষী এখন এই জনপদে থাকা না থাকা সমান হয়ে গেছে। গাছ কেটে অবৈধ স-মিলে দেদার চেরাই হচ্ছে। বেচা-কেনা চলছে। এরা এই উপজেলায় বৈধ-অবৈধ স-মিলের সংখ্যা কত তা জানাতে পারেনি এক বছরে। এক কথায় কলাপাড়ার গোটা উপকূলের সবুজ দেয়ালখ্যাত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এখন অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে সরকার সিডর-পরবর্তী সময়ে শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র করেছে। যেখানে মানুষ আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পাবে। কিন্তু তাদের সম্পদসহ গবাদিপশু রক্ষায় জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবুল খায়ের জানান, আসলে বাঁধসহ ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল রক্ষায় প্রয়োজন সমন্বিত ব্যবস্থাপনা। কলাপাড়া উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সভাপতি ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ তানভীর রহমান জানান, ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল নিধনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
×