ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী ১০ দিনের মধ্যে চার্জশীট ॥ ডিএমপি কমিশনার

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার দুই বছর পূর্তি রবিবার

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৯ জুন ২০১৮

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার দুই বছর পূর্তি রবিবার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকার অভিজাত এলাকা ও কূটনীতিকপাড়া হিসেবে পরিচিত গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁয় হামলা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধীরা জড়িত। হামলার পর বাংলাদেশে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামী স্টেট বা আইএস ঘাঁটি গেড়েছে বলে বার বার নানাভাবে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে, যা ছিল পুরোই পরিকল্পিত। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে বহির্বিশ্বে পুরোপুরি বেকায়দায় ফেলতেই এমন প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল। যাতে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। এখনও দুই জঙ্গী পলাতক রয়েছে। আগামী দশ দিনের মধ্যেই আলোচিত এ হামলা মামলার চার্জশীট দাখিল করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। চার্জশীটে পুরো ঘটনা তথ্য প্রমাণসহ তুলে ধরা হবে। আগামী ১ জুলাই দুনিয়া কাঁপানো হলি আর্টিজান হামলার দুই বছর পূর্তি। বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এমনটাই জানালেন। তিনি বলছেন, হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধ, হত্যাকা- ও তথ্য গোপনের অভিযোগে মোট তিনটি মামলা হয়। মামলার তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তদন্তে জানা গেছে, মূলত দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করা, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই হামলাটি করা হয়েছিল। যার নেপথ্যে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। কেন, কিভাবে, কাদের অর্থায়নে, কাদের অস্ত্র গোলাবারুদের যোগানের প্রেক্ষিতে হামলাটি হয়েছিল তার বিস্তারিত ফিরিস্তি থাকছে চার্জশীটে। হামলার দুই বছর হতে চলছে ॥ ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় গুলশান লেক লাগোয়া হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁয় জঙ্গীদের প্রথম হামলায় বনানী মডেল থানার ওসি সালাহ উদ্দিন আহমেদ খান ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম নিহত হন। এরপর জঙ্গীরা রেস্তুরাঁর সবাইকে ভারি অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তখন পবিত্র মাহে রমজানের রোজা চলছিল। জিম্মির পর জঙ্গীরা ইতালির ৯, জাপানের ৭, একজন ভারতীয় ও ৩ বাংলাদেশীকে গুলি ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ॥ পরদিন ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডো হামলাকারী জঙ্গী নিবরাজ ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নিহত হয়। অভিযানে রেস্তুরাঁর পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। কমান্ডোরা জীবিত অবস্থায় তিন বিদেশীসহ তাৎক্ষণিক ১৩ জিম্মিকে উদ্ধার করে। সব মিলিয়ে কমান্ডোদের অভিযান চালানোর আগে ও পরে জিম্মি দশা থেকে ৩৩ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। হামলার দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশ ও চাপে বাংলাদেশ ॥ ঘটনার পর পরই জঙ্গী গোষ্ঠী আইএসের নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এরপর সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে বলে নানাভাবে প্রপাগান্ডা চালানো হয়। বিশ্ববাসী রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিশ্ব মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনায় আসে ঘটনাটি। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশে আইএস রয়েছে বলে দাবি করে আসছিল। শেষ পর্যন্ত তদন্তে বেরিয়ে আসে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে আলোচনায় আসা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবিরই নতুন একটি অংশ যেটি নব্য জেএমবি হিসেবে পরিচিত তারাই হামলাটি চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে আইএস নেই, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। নস্যাৎ হয়ে যায় স্বাধীনতাবিরোধীদের গভীর ষড়যন্ত্র। কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের ভাষ্য ॥ হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে চলমান ধারাবাহিক অভিযানে হামলার জন্য অস্ত্রের যোগান দেয়া হাতকাটা মাহফুজ ও মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, হাদিসুর রহমান সাগর, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশ গ্রেফতার হয়। আর হামলায় জড়িতদের অনেকেই বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় গোলাগুলিতে নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে রয়েছে হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী, জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, আবু রায়হান তারেক, সারোয়ার জাহান, আব্দুল্লাহ মোতালেব, ফরিদুল ইসলাম আকাশ, বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান। আর হামলার রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হলি আর্টিজানে থাকা নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিমও কারাগারে রয়েছেন। হলি আর্টিজানের ছাদে দুই হামলাকারীর সঙ্গে ব্যবসায়ীপুত্র তাহমিদ হাসিব খানের অস্ত্র হাতের ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তদন্তে তার জড়িত থাকার প্রমাণ না মেলায় আদালতের নির্দেশে তিনি এ মামলা থেকে অব্যাহতি পান। ২০১৬ সালের এপ্রিলে হামলার চক্রান্ত হয় ॥ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, ঢাকায় বড় ধরনের হামলা করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ঝড় তুলতে, বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছে সেটি প্রমাণ করতে এবং সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা হয়। চক্রান্ত হয়। চূড়ান্ত মোতাবেক নিবরাজ, মোবাশ্বের ও রোহান, গ্রামের ছেলে খায়রুল ও শফিকুল এই পাঁচ জনকে দিয়ে আত্মঘাতী স্কোয়াড গঠন করা হয়। তাদের গাইবান্ধার গহীন চরে ২৮ দিন বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জঙ্গীদের ওই প্রশিক্ষণে নব্য জেএমবির জঙ্গী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম মূল ভূমিকা পালন করে। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার রূপনগরে পুলিশী অভিযানে মেজর জাহিদ নিহত হন। ট্রেনিং শেষে পাঁচ জনকে পাঠানো হয় ঢাকায়। তাদের থাকার জায়গা করে দেয়া হয় হলি আর্টিজানের কাছাকাছি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকা নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর গিয়াস উদ্দিনের বাড়িতে। হলি আর্টিজানে হামলার মূল কারণ ছিল রেস্তুরাঁটিতে প্রচুর বিদেশীর যাতায়াত। হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর হামলাকারীরা যাদের হত্যা করেছে, তাদের মোবাইল দিয়েই ছবি তুলেছিল। ছবিগুলো তারা তামিম চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম মারজানের কাছে পাঠিয়েছিল। তারা তখন ঢাকার শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় ছিল। তামিম ও মারজান ছবিগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। হামলার খরচ নয় লাখ টাকা ॥ মনিরুল ইসলামের ভাষ্য, হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র গোলাবারুদ, অপারেশনাল সামগ্রী, টিশার্ট, কেডস কিনতে তাদের নয় লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছিল। এরমধ্যে ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুর অভিযানে নিহত জঙ্গী নেতা তানভির কাদেরী গুলশান হামলায় অংশগ্রহণকারী পাঁচ জনের জন্য বাসা ভাড়া করে দিয়েছিলেন। তানভীর কাদেরী ডাচ বাংলা ব্যাংকে অনেক টাকা বেতনে চাকরি করত। তার স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা একটি মাল্টিন্যাশনাল এনজিওতে চাকরি করতেন। তারা বাড়ি-গাড়ি বিক্রি করে সব টাকা অপারেশনের জন্য দিয়েছেন। অস্ত্র ও বিস্ফোরক আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং যশোর থেকে ॥ মামলার এজাহারের বিবরণ অনুযায়ী, গুলশান হামলায় পাঁচটি পিস্তল, তিনটি একে-২২ রাইফেল ব্যবহার করেছিল জঙ্গীরা। ঘটনাস্থলে নয়টি গ্রেনেডের সেফটি পিন মিলেছিল। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে তিনটি ছোরা, একটি চাপাতি, একটি সাদা রঙের রুমাল এবং বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের প্রায় তিনশ’ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার হয়। বড় মিজানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী মোতাবেক, গুলশান হামলার জন্য অস্ত্র ও বিস্ফোরকগুলো জঙ্গীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর সীমান্ত দিয়ে এনেছিল। এগুলো তৈরি হয়েছিল ভারতের মালদায়। হাতকাটা মাহফুজ অস্ত্রের মূল যোগানদাতা। বড় মিজান সেসব অস্ত্র আমের ঝুড়িতে করে ঢাকায় আনে। আতঙ্ক কেটে গেছে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার দুই বছর পর সরকারের জঙ্গী দমনে ব্যাপক সাফল্যের পর সারাদেশে, কূটনীতিকপাড়ায় এবং বিদেশে আতঙ্ক কেটে গেছে। তারপরেও গুলশানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে। এতে করে বিদেশীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। গুলশান হামলার পর যেসব বিদেশী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। আর্টিজান এখন যেমন ॥ ঘটনার পর থেকে রেস্তরাঁ উঠিয়ে দিয়ে এখন নিজে থাকার জন্য বাড়িটি গোছগাছ করছেন এর মালিক সামিরা আহম্মদ ও তার স্বামী সাদাত মেহেদী। যদিও পাশের লেক ভিও ক্লিনিকটিকে আগের মতোই কর্মকা- শুরু করেছে। তবে সেখানে বিদেশীদের যাতায়াত আগের মতো নেই বলে জানিয়েছেন সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা।
×