ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশে রোডম্যাপ

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৯ জুন ২০১৮

খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশে রোডম্যাপ

এম শাহজাহান ॥ কৃষি অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে ফুড প্রসেসিং করে সেই পণ্য রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ‘রেডি টু ইট’ ক্যাটাগরির আওতায় শীতকালীন সবজি থেকে শুরু করে দেশের মৌসুমি ফল আম-কাঁঠালের মতো পণ্যের প্রক্রিয়াজাত খাবার রফতানি হবে বিদেশে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশে কি সমস্যা রয়েছে এবং তা উত্তরণে করণীয় নির্ধারণে একটি রোডম্যাপ তৈরি করছে সরকার। সম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক এই শিল্পখাতে উদ্ভিদ, মৎস্য ও প্রাণিজ খাদ্য, মধু ও মৌমাছির বিপণন, বোতলজাত পানি ও লবণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান রেডি টু ইট ক্যাটাগরির আওতায় ১৪০টি দেশে প্রক্রিয়াজাত খাবার রফতানি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, রেডি টু ইট পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার প্রায় ৭০ হাজার কোটি ডলার। এর বিপরীতে এ খাতে বাংলাদেশের রফতানি খুবই নগণ্য। এ সংক্রান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেডি টু ইট ক্যাটাগরির পণ্য খাতে রফতানি আয় ২০২১ সাল নাগাদ ৬০০ কোটি ডলার এবং ২০৪১ সাল নাগাদ আড়াই হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এজন্য বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর উপর তাগিদ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কৃষি অর্থনীতির আকার বাড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষির উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে, বাংলাদেশ থেকে প্রসেসিং বা প্রক্রিয়াজাতকরণ খাবার আমদানির পাশাপাশি এ শিল্পে যৌথ অথবা একক বিনিয়োগের প্রস্তাব করছেন বিদেশী উদ্যোক্তারা। পোল্যান্ডের বিনিয়োগকারীরা কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বিনিয়োগের জন্য ইতোমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শুধু ফুড প্রসেসিং শিল্পের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির জন্য জমি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, ফুড প্রসেসিং শিল্পের উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋতুভেদে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক ব্যবহার করা গেলে দ্রুত এ শিল্পের রফতানি বাড়ানো সম্ভব। এজন্য ফুড প্রসেসিং শিল্পের বিকাশ ঘটানোর কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের নীতিগত সহায়তা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়া শুল্ক ও অশুল্কজনিত যেসব সমস্যা রয়েছে তাও দূর করা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে।বেসরকারী খাতে এ শিল্প উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইতোমধ্যে রোডম্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে ফুড প্রসেসিং শিল্পের বিকাশ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গত বছর সরকারী উদ্যোগে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্স মনে করছে, উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা প্রদান ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে অতি দ্রুত দেশের এই সম্ভাবনাময় খাত ফুড প্রসেসিং শিল্পের বিকাশ ঘটবে। ফুড প্রসেসিং শিল্পের আওতায় বাংলার ঐহিত্য কুমিল্লার রসমালাই থেকে বগুড়ার দই, টাঙ্গাইলের চমচম এমনকি নেত্রকোনার ঐহিত্য বালিশ মিষ্টি সবই রফতানি করা সম্ভব। এছাড়া এ্যাগ্রো ফুড প্রসেসিং শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাগ্রো প্রসেসরস এ্যাসোসিয়েশনের মতে, (বাপা), ফুড প্রসেসিং শিল্প সম্ভাবনাময় খাত। বর্তমান প্রতিবছর এ শিল্পে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ফুড প্রসেসিং পণ্য রফতানি হচ্ছে। উৎপাদন বাড়ানো গেলে রূপকল্প-২১ সামনে রেখে বছরে ৬০০ কোটি ডলারের বিশ্ব বাজার তৈরি হতে পারে। সংগঠনটির সভাপতি এ এফ এম ফখরুল ইসলাম মুন্সী সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, ভিশন-২১ সামনে রেখে এ শিল্পখাত উন্নয়নে উদ্যোক্তারা কাজ করছেন। এক্ষেত্রে সরকারী সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এমনকি চীন ও জাপানে প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অবকাঠামো দুর্বলতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত কৃষি রফতানিতে ব্যাংক সুদের হার ও শুল্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও উচ্চ সুদের হার রয়েছে। আবার দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়ছে। ফলে আমরা পণ্যের দামে প্রতিযোগীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছি। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রূপকল্প-২১ সামনে রেখে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা পূরণ করতে হলে এখন কৃষিভিত্তিক এই শিল্পে নজর দেয়া প্রয়োজন। কৃষিভিত্তিক এই সেক্টরের বিনিয়োগ বাড়ানো হলে ফুড প্রসেসিং করে সব ধরনের খাদ্যপণ্য রফতানি করা সম্ভব। এসব খাদ্যপণ্যের কদর রয়েছে প্রবাসী বাঙালীদের কাছে। এছাড়া এসব খাবার বিদেশীদের কাছেও খুব পছন্দ। ইতোমধ্যে ফুড প্রসেসিং শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে আরএফএল শিল্পগোষ্ঠীর ‘প্রাণ’ সামগ্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। এদের পাশাপাশি এ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে স্কয়ার শিল্প গ্রুপ ও আহমেদ ফুড প্রোডাক্টস। ফুড প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে আমের আচার থেকে শুরু করে এখন মুড়ির মোয়া পর্যন্ত বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। জানা গেছে, রফতানি নীতিমালায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাতের তালিকায় স্থান পেয়েছে এ্যাগ্রো-প্রোডাক্টস ও এ্যাগ্রো-প্রসেসড পণ্য। এ শিল্পের বিনিয়োগকারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হ্রাসকৃত সুদ-হারে প্রকল্প ঋণ প্রদান করার ঘোষণা রয়েছে। এছাড়া আয়কর রেয়াত প্রদান, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিমানে পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান, বন্ড সুবিধা, পণ্যের মানোন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি সুবিধা সম্প্রসারণ করা, কমপ্লায়েন্ট শিল্প স্থাপনে বিনাশুল্কে ইকুইপমেন্ট আমদানির ব্যবস্থা করা, পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতে সহায়তা করা হবে। পাশাপাশি বিদ্যুত, পানি, গ্যাস প্রভৃতি ইউলিটি সার্ভিসের ক্ষেত্রে ডব্লিউটিওর এ্যাগ্রিমেন্ট অন এ্যাগ্রিকালচারাল এবং এ্যাগ্রিমেন্ট অন সাবসিডিজ এ্যান্ড কাউন্টার ভেইলিং মেজারসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সম্ভাব্য আর্থিক সুবিধা বা ভর্তুকি প্রদান করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। জানা গেছে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে এ শিল্প খাত একদিকে যেমন কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করছে, তেমনি প্রক্রিয়াকরণের কারণে কৃষিজাত এসব পণ্য সংরক্ষণ করা যাচ্ছে বছরজুড়ে। স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর এসব খাদ্য দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটাতেও সহায়তা করছে। বিশেষ করে টমেটো, আলু, আম, জলপাই, বিভিন্ন ধরনের ভেজিটেবলস থেকে বর্তমানে দেশেই চিপস, কুকিবাইট, ভেজিটেবল জুস, চানাচুর, আলুচুর, ম্যাংগো জুস, পিংক গোয়াভা, ফ্রুট মকটেল, চকলেটসহ বিভিন্ন খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে এ্যাগ্রো-প্রসেসিং খাতে উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। নিজস্ব প্রসেসিং ইউনিট রয়েছে এমন প্রসেসড ফুড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭০০। এছাড়া বর্তমানে ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্যের প্রায় ২২ শতাংশ হচ্ছে এ্যাগ্রো প্রসেসড পণ্য। জিডিপিতে এর অবদান ২ শতাংশ।
×