ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তার মানে ব্যাংক আমানতের ওপর কোন সুদ নেই!

প্রকাশিত: ০৫:০০, ২৯ জুন ২০১৮

তার মানে ব্যাংক আমানতের ওপর কোন সুদ নেই!

২০১৮-১৯ অর্থবছরের নতুন বাজেট আগামী রোববার থেকে কার্যকর হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে যথারীতি ‘ফিনান্স বিল ও বাজেট’ সংসদে পাস হয়ে গেছে। অনেক আলোচনাও হয়েছে বাজেটের ওপর। কিন্তু আমার মতো অনেকেরই মন এতে ভরেনি। বাজেটের কত দিক আছে, গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে তার ওপর সবিশেষ আলোচনার খবর পেলাম না। দৃশ্যত মনে হচ্ছে এবারের বাজেটে আলোচনার ঝড় গেছে ব্যাংকের ওপর দিয়ে। গেল বছরও মোটামুটি তাই গেছে। এটা হতেই পারে ব্যাংক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তার অবস্থা সম্পর্কে সংসদে তো আলোচনা হবেইÑ এটাই স্বাভাবিক। তবে আমার মতে ব্যাংকের ‘লড়াদশার’ আলোচনা অনেক পেছন থেকে করতে হবে। সেই প্রথম প্রজন্মের বেসরকারী ব্যাংক দিয়ে শুরু করতে হয়। তারও আগে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’-এর আলোচনা দরকার। প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকের অনেক মালিকই বেনামিতে ঋণ নিয়ে ব্যাংক খোলাসা করেছিলেন। তারপর গেছে ‘বিসিসিআই’ যার বর্তমান নাম ‘ইস্টার্ন ব্যাংক’। ইতোমধ্যে গেছে দুটি ‘ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’। একটি ন্যাশনাল ক্রেডিট লিমিটেড যা এখন ‘এনসিসি বিএল’ ব্যাংক। আরেকটি ‘বাংলাদেশ কমার্স লিমিটেড’ যা এখন ‘বিসিআই’ ব্যাংক। আল বারাকা ব্যাংকটি কোথায়? কোথায় ‘ওরিয়েন্টাল’ ব্যাংকটি? এসব ব্যাংকের বর্তমান নাম ‘আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের’ এই দুরবস্থা কেন? আরও বড় ব্যাংক আছে। দেশের শিল্পায়নে অর্থ যোগানের জন্য দুটো ব্যাংক করা হয়েছিল স্বাধীনতার পর। একটি বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি), অন্যটি বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস)। এই দুটো ব্যাংক এখন কোথায়? কী কারণে এ দুটো ব্যাংক ডুবল? কারা ডুবাল? ডোবার পর নতুন নাম ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ‘(বিডিবিএল)। সংসদের আলোচনা পত্রিকায় পড়ে আমার এসব কথা মনে পড়ছিল। ব্যাংকিং খাতের এই যে ‘লড়াদশা’ এটা তো আজকে শুরু হয়নি। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলও শুরু করেনি। এটা তো বহু প্রাচীন রোগ। ‘ব্যাংক ফিনান্সলেড’ গ্রোথ অনুসরণ করলে কী ফল হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এটা। এ ধরনের মডেল যারা অনুসরণ করেছে তারাই পড়েছে ফাঁদে! চীনও ভারতের ক্ষেত্রেও একই ফল। এ বিষয়টি সকলকে বোঝার জন্য অনুরোধ করছি এবং সেই প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যত নীতি গ্রহণের তাগিদ দিচ্ছি। আমি মনে কির পুঁজি সংগ্রহের জায়গা কেপিট্যাল মার্কেট। একে অবজ্ঞা করে ব্যবসায়ীরা শুধু ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন এটা কোন কাজের কথা নয়। অতীতে যেমন তা হয়েছে এখনও দেখা যাচ্ছে একই প্রবণতা দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা এসব ‘প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির’ মাধ্যমে ব্যবসা করেন। বিশাল বিশাল ব্যবসা। শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণপত্র পর্যন্ত তারা খোলেন। এমন কোম্পানিও আছে যারা হাজার হাজার কোটি টাকাও ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু তারা তাদের প্রফিট ভাগাভাগি করতে রাজি নন। তারা ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ করে শেয়ার বাজার থেকে পুঁজি আহরণ করে ব্যবসা করতে উৎসাহী নন। সরকারও দেখা যাচ্ছে এই ক্ষেত্রে কিছু করতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা এত বড় এবং প্রভাবশালী যে, তাদের কথামতো সরকারও চলে। এরই প্রতিফলন ঘটছে বর্তমানে ব্যাংকের ক্ষেত্রে। বেসরকারী ব্যাংকের মালিকদের সরকার কিছু দিনের মধ্যে এত সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে যে, এটা এখন সারাদেশে তীব্র সমালোচনার সূত্রপাত করেছে। এমন কী সরকারের মন্ত্রীরা পর্যন্ত সংসদে এর ওপর আলোচনা করছেন। আমি এসব আলোচনায় যাচ্ছি না। আজকের আলোচনার আমি শুধু একটি বিষয়ের ওপর সামান্য আলোকপাত করতে চাই। আর সেটা হচ্ছে ঋণের ওপর সুদের হার। বেসরকারী ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন স্থির করেছে। পহেলা জুলাই থেকে ঋণের ওপর সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক অঙ্কের সুদ। পাশাপাশি তারা এ সিদ্ধান্তও নিয়েছে যেÑ আমানতের ওপর সুদহার হবে ৬ শতাংশ। উল্লেখ্য, অর্থ মন্ত্রণালয়ও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারী ব্যাংকের ক্ষেত্রে। এই খবর কাগজে দেখলাম। এসব সিদ্ধান্তের ওপর আলোচনার কয়েকটি দিক আছে। প্রথমত : নীতিগত দিক, দ্বিতীয়ত : পদ্ধতিগত দিক, তৃতীয়ত : সিদ্ধান্তের ফলের দিক। নীতিগত দিকের আলোচনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আইনগত দিক। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, ‘বাজার অর্থনীতির’ সর্বনিম্ন নিয়ম যথাযথ প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে মালিকরা একযোগে সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘বাজার অর্থনীতিক’ বেগবান ও চালু রাখার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই ‘বালাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন’ গঠন করেছে যার ফোন নং ৫৮৩১৫৪৮৬। তারা বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছে, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ (ফলিউশন), মনোপলি ও ওলিগপলি অবস্থা, জোটবদ্ধতা (মার্জার), অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানে (ডেমিনেন্ট পজিশন), অপব্যবহার সংক্রান্ত প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকা- প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করাই তাদের উদ্দেশ্য। আমার প্রশ্ন, ব্যাংক মালিকদের বর্তমান সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্তের পদ্ধতিটি কী এখন প্রতিযোগিতা কমিশনের বিচারের আওতাধীন হয় না? এসব শুধুই প্রশ্ন। যে সিদ্ধান্তটি প্রত্যেক ব্যাংকের বোর্ডের সেই সিদ্ধান্তটি নেয়া হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে এবং মালিকদের সভায়। কেন, প্রতিটি ব্যাংক স্বচ্ছ বোর্ডে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারত। এতে শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ সুদহার করতে পারত ৮ শতাংশ, কেউ ৯ শতাংশ, কেউ সাড়ে নয় শতাংশ। এটা তো হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কারণ সব ব্যাংকের শক্তি ও সামর্থ্য এক নয়। এই হচ্ছে বর্তমান সিদ্ধান্তের একটা দিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক অবশ্য অন্যত্র। একটি দৈনিকে দেখলাম, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে গবর্নরের সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা বলেছেন তাদের ‘লিক্যুইডিটি’ নেই। তাদের স্বল্পসুদে আমানত যোগাড় করে দিতে হবে। নতুবা ৯ শতাংশে ঋণ দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হবে। তারা উল্লেখ করেছেন সরকারী ব্যাংকে ‘লিক্যুইডিটি’ আছে অর্থাৎ ‘ফান্ড’ আছে। তাদের ফান্ডের অভাব আছে এর অর্থ কী? এই অর্থ বোঝার আগে অন্য একটি বিষয়ে যাই, যা আলোচনা করা ফরজ। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার খুবই কম। অথচ ব্যাংকগুলো এখনও সমানে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। একটি দৈনিকে আমানত বৃদ্ধির কিছু তথ্য দেখলাম। আমি নিজেও সরকারের সর্বশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য পরীক্ষা করে দেখলাম। ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমানত বৃদ্ধির পরিমাণ খুবই কম। মাত্র ১০-১২ শতাংশ। আর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে আমানত বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। এখন প্রশ্ন যেখানে আমানত বৃদ্ধিতে এই স্থবিরতা চলছে সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক কী করে ১৬-১৮ শতাংশ ঋণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করে? কী করে কিছু কিছু ব্যাংক ১৮-১৯ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ সম্প্রসারণ করে? বস্তুত এই ‘এ্যাগ্রেসিভ ব্যাংকিং-এর কারণেই কয়েকদিন আগের সঙ্কটটি তৈরি হয়েছে। কিছু দিন আগে দেখা গেল কিছু কিছু ব্যাংকে টাকা নেই, তাদের লিক্যুইডিটি সঙ্কট। তারা যথেচ্ছ হারে ঋণ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন মনিটরিংই ছিল না। এতে ধরা খেল ‘ফার্মার্স ব্যাংক’ এবং ওই সঙ্কট খুবই বিশ্রি পর্যায়ে গড়ায়। বহু ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিয়ে সেই সঙ্কট থেকে বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করা হয়। এখন তাদের সামনে অন্য সঙ্কট। তারা ৯ শতাংশে ঋণ দিতে গিয়ে আমানতের ওপর সুদের হার করেছে ৬ শতাংশ। বিষয়টি কিন্তু খুবই জটিল। তারা অনেক বেশি ঋণ দিয়ে ফেলেছে। দরকার তাদের এখন কিছু ঋণ বিরতি। তাদের দম ধরা দরকার। পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা দরকার। আর নতুনভাবে ঋণ দিতে হলে তাদের ফান্ড দরকার। ৬ শতাংশে তারা কতটুকু আমানত সংগ্রহ করতে পারবে? আর আমানত সংগ্রহ না করতে পারলে তারা ঋণ দেবে কোত্থেকে? আমার নিজের মত ব্যাংকাররা নিজেদের নানা সিদ্ধান্ত দ্বারা আমানতের বাজারটিকে অস্থিতিশীল করে ফেলেছেন। এটা তাদের করা উচিত হয়নি। আমানত চাইলেই পাওয়া যায় না। আমানত সংগ্রহ করা জটিল কাজ। ব্যাংকাররা দেখা যাচ্ছে তাদের সুদিনে ‘আমানত’ বিদায় করে, আবার তাদের খারাপ দিনে ঘরে ঘরে আমানতের জন্য তদ্বির করে। এটা না করে এই কাজটি হওয়া দরকার নিয়মিত কাজ। তারা এখন তিন মাসের আমানতকে গুরুত্ব দেয় বেশি। অথচ অনেক ব্যাংকে ঋণের মেয়াদ এবং আমানতের মেয়াদের মধ্যে বড় ধরনের ‘মিসম্যাচ’ তৈরি হয়ে আছে। আমানত ছাড়া যেহেতু ব্যাংকিং হবে না তাই আমানতের স্থিতিশীল ভিত্তি তৈরি করা দরকার। এটা মানুষের সঞ্চয়। আমাদের দেশে সঞ্চয়ের দরকার। সঞ্চয়কেন্দ্রিক আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা। আমরা আমেরিকার সমাজ হতে পারব না। তাদের সঞ্চয় নেই, দরকারও নেই। রাষ্ট্রই সব করে। অতএব সঞ্চয়কে, আমানতকে উৎসাহিত করা দরকার। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ। আমানতের ওপর সুদের হার ৬ শতাংশ। এর অর্থ কী? অর্থ হলো আমানতের ওপর কোন সুদ নেই। তাহলে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখবে কেন? এই বিষয়টি ব্যাংকারদের ভাবতে হবে। শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখলে চলবে না। আমানতকারী এবং ঋণগ্রহীতা উভয়ের স্বার্থের একটা বোঝাপড়া করতে হবে। এই মুহূর্তে তাই ব্যাংকারদের উচিত হবে আমানতের ভিত্তি শক্ত করা। আমানত যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে হবে না। আবার আমানতের বৃদ্ধি না ঘটিয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি করলে আবার সঙ্কট তৈরি হবে। তাই খুবই সন্তর্পণে এগোনো দরকার। সরকারেরও উচিত আমানতকে উৎসাহিত করা। আমানতকে নিরুৎসাহিত করলে ‘আমানত’ যাবে অনুৎপাদনশীল খাতে, যাবে অন্যত্র। এতে আমাদের ক্ষতিই হবে। আমানতের বাজার, ঋণের বাজার, শেয়ার বাজার, সঞ্চয়পত্রের বাজারকে এমনভাবে সংগঠিত করা দরকার যাতে সঞ্চয় বাড়ে। সঞ্চয় থেকেই হবে বিনিয়োগ যা ভীষণ দরকার। আমানতের (ডিপোজিট) গলা টিপে ধরলে পরিণামে সবার সর্বনাশ হবে। এই সতর্কতার বার্তাটি আমি দিয়ে রাখলাম। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×