ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেশ কিছু শুল্ক পরিবর্তন করে সংসদে অর্থবিল পাস

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ২৮ জুন ২০১৮

বেশ কিছু শুল্ক পরিবর্তন করে  সংসদে  অর্থবিল  পাস

সংসদ রিপোর্টার ॥ জাতীয় সংসদে বুধবার রাতে অর্থবিল ২০১৮ পাস হয়েছে। বাজেট পাসের আগে অর্থমন্ত্রী বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক হার পুনর্বিন্যাস করেন। এরপর তিনি অর্থবিল বিবেচনার জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। অর্থবিলের ওপর বিরোধী দলের সদস্যরা বেশ কিছু জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর অর্থমন্ত্রী অর্থবিল ২০১৮ পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করেন। যা সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের সর্বসম্মতিতে পাস হয়। বিল পাসের পর প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী এমপিরা অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে। উল্লেখ্য, বিগত ৭ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থবিল ২০১৮ ও বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। জাতীয় সংসদে গত ১৯ দিন ধরে বাজেটের ওপর আলোচনার সমাপ্তি টানতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশরতœ শেখ হাসিনার উপর্যুপরি দুই মেয়াদের শেষটি এই বাজেট ও এই ১০টি বাজেটেই তার পরামর্শ এবং দিক-নির্দেশনা আমার বাজেটগুলোকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, আমাদের সরকার জনগণের সরকার। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের লক্ষ্য হলো জনকল্যাণ। এজন্য গঠনমূলক এবং বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা আমাদের যথোপযুক্ত নীতি-কৌশল প্রণয়ন ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে সহায়তা করে। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার ২০০৯ সালে থেকেই যে দুটি বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেয় তা হলো রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং বাজেটের আয়তনের প্রসার। রাজস্ব আদায় গতিশীল না হলে রাষ্ট্রের সেবা প্রদানের ক্ষমতা বিঘিœত হয়। বাজেটের আয়তন বাড়লে রাষ্ট্র নানা ধরনের সেবা দিতে সক্ষম হয়। প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি ৭.৮ শতাংশ। বিবিএস-এর সাময়িক হিসাব মতে বিগত দুই বছরের মতো চলতি অর্থবছরেও আমরা লক্ষ্যমাত্রা (৭.৪ শতাংশ) ছাড়িয়ে ৭.৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে যাচ্ছি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.০৫ শতাংশ, যার বিপরীতে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.১১ শতাংশ। এর পরবর্তী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয় ৭.৪ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ শক্তিশালী ধারা সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটের আকার নিয়ে যখন কথা বলা হয় তখন এক উচ্চাভিলাষী, নির্বাচনী বাজেট, বাস্তবায়নের অযোগ্য ইত্যাদি নামে অভিহিত করার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে, খাতভিত্তিক বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা নিয়ে অনেকে কথা বলেন। সময়ের বিবর্তনে ও দেশের আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনে তথ্য-প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তনসহ সম্পদ বণ্টনের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ফলে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও বণ্টনগত উৎকর্ষতা নিশ্চিত করতে গিয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বিজ্ঞজনদের সঙ্গে আমরাও একমত যে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, নারী ও শিশু উন্নয়নসহ মৌলিক খাতসমূহে যথোপযুক্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে পারলে আমরা প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসের লক্ষ্য অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে পারতাম। এটুকু বলতে পারি যে, সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যে আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছি। আমার বিশ্বাস, সম্পদ সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় শীঘ্রই আমরা কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনতে পারব। মৌলিক খাতসমূহ পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ছাড়াও ভৌত অবকাঠামো ও সংরক্ষণে যথেষ্ট সম্পদ সঞ্চালনে সক্ষম হব। বাজেট বাস্তবায়নেও বর্তমান অর্থবছরে আমাদের কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। বিশেষ করে বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। এছাড়া আগামী অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নে প্রকল্প পরিচালকদের ক্ষমতায়িত করা হয়েছে। আর্থিক খাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে অনেক বক্তব্য সংসদে এবং সংসদের বাইরে ক্রমাগত দেয়া হচ্ছে। আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে নানা কথা উঠেছে এবং আমার বিরুদ্ধে এক ধরনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও করা হয়েছে। আমাদের সরকারী ব্যাংকগুলোর অবস্থা সকলের প্রত্যাশার পর্যায়ে নেই এবং এগুলোর মূলধন আমরা পুনর্ভরণ করে যাচ্ছি। ব্যক্তি মালিকানা খাতের ব্যাংকগুলো সম্বন্ধে বলা হচ্ছে যে, সেগুলোতে লুটপাট হচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানা খাতের একটি সমস্যা হচ্ছে, সেখানে বিভিন্ন ব্যাংক একে অন্যকে সাহায্য করে এবং এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের ঋণ পেয়ে থাকেন। এ সম্বন্ধে আমি আগামী মাসে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা-ভাবনা করছি। এমপিওভুক্তি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রায় ৯ বছর এমপিওভুক্তি বন্ধ রাখার পরে আগামী ১লা জুলাই থেকে এমপিওভুক্তি খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে এমপিও ব্যবস্থাটি পরিবর্তনের জন্য প্রত্যেক এলাকায়ই কিছু বরাদ্দ দেয়া হবে। জরাজীর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে নতুন শ্রেণীকক্ষ তৈরির জন্য অতিরিক্ত কিছু বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাজেটের সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু শুল্ক কাঠামো পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন। যা অর্থবিল পাসের মাধ্যমে সংসদে গৃহীত হয়। তথ্য-প্রযুক্তির প্রসারের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সেবার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। ব্যবসায়ী পর্যায়ে কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশের ওপর পূর্বের ধারাবাহিকতায় মূসক অব্যাহতি প্রদান করা হয়। দেশীয় মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তমান ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রেখে এ শিল্পের অধিকতর বিকাশের লক্ষ্যে সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য শুধু স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল বিজনেস সেবা এবং তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর সেবার সংজ্ঞা সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবং ধূমপায়ীর সংখ্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নিম্নস্তরের সিগারেটের প্রতি দশ শলাকার মূল্য ৩২ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ এবং অতি উচ্চস্তরের সিগারেটের প্রতি দশ শলাকার মূল্য ১০১ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১০৫ টাকা করা হয়েছে। জর্দা ও গুলে বর্তমানে শুল্ক-করসহ মূল্যের পূর্বের অভিঘাত অপরিবর্তিত রেখে প্রতি গ্রাম জর্দার ট্যারিফ মূল্য ১.২০ এবং প্রতি গ্রাম গুলের ট্যারিফ মূল্য ০.৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণসহ দেশের সকল মানুষ শীতের সময় ত্বকের পরিচর্যায় ব্যবহৃত পেট্রোলিয়াম জেলির ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দ্বারে দ্বারে বিদ্যুত পৌঁছানোর অঙ্গিকার বাস্তবায়ন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিকট বিদ্যুত সেবাকে সাশ্রয়ী করার লক্ষ্যে অর্থবছরে ফিলামেন্ট বাল্বের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। মোটরসাইকেল শিল্পের অধিকতর বিকাশের লক্ষ্যে দেশী মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি বহাল রেখে সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুধু স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৭ শতাংশের অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি-এর বিপরীতে প্রযোজ্য ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পরিবর্তে নিট ৭ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে শুধু ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে এয়ার লাইন্সসমূহের বন্দর সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। আমদানি পর্যায়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে মূসক নিবন্ধিত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাল্কে আমদানিতে এর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ হতে হ্রাস করে ১০ শতাংশ হারে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে দেশী দুগ্ধ খামার শিল্প অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে পারে। তাই দেশী শিল্পের প্রতিরক্ষণের স্বার্থে এর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাটারিসহ বিভিন্ন শিল্পে মৌলিক কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পণ্যটি আমদানিতে ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বিদ্যমান রয়েছে। শিল্পের মৌলিক কাঁচামাল বিবেচনায় পণ্যটির আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ হতে হ্রাস করে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। দেশে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আর্গন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দেশী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। পণ্যসমূহের ওপর বর্তমানে ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বিদ্যমান রয়েছে। পণ্যসমূহের শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিরক্ষণ প্রদানের জন্য অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আর্গন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে রেগুলেটরি ডিউটি ০ শতাংশ হতে বৃদ্ধি করে ২০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ৭৫০ ওয়াট পর্যন্ত ক্ষমতার মোটর তৈরি করছে। পণ্যটি আমদানিতে মূলধনী যন্ত্রপাতির সুবিধা বিদ্যমান থাকায় শুধু ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রযোজ্য হয়। এতে দেশীয় মোটর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। দেশী শিল্পের প্রতিরক্ষণের লক্ষ্যে ৭৫০ ওয়াট মোটরের মূলধনী যন্ত্রপাতির শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূসক, ৫ শতাংশ এআইটি ও ৫ শতাংশ এটিভি আরোপ করা হয়েছে। সফটওয়্যার আমদানিতে ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে। ডাবল কেবিন পিকআপ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে ২০০০ হতে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত ডাবল কেবিন পিকআপ আমদানিতে ২৫ শতাংশ রেগুলেটরি বিদ্যমান আছে। ডাবল কেবিন পিকআপের ওপর বিদ্যমান রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ শতাংশ হতে হ্রাস করে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।
×