ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির অভিযোগ হালে পানি পাচ্ছে না

উন্নয়নের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন গাজীপুরবাসী

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৮ জুন ২০১৮

   উন্নয়নের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন গাজীপুরবাসী

গাফফার খান চৌধুরী, গাজীপুর থেকে ফিরে ॥ বিগত বিএনপি সমর্থিত মেয়রের রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন না করা, যানজট নিরসনে কোন প্রকার উদ্যোগ না নেয়া, বিগত দিনে জনপ্রতিনিধি থাকার সময় একটি নির্দিষ্ট জায়গায় উন্নয়ন করা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রার্থীর বয়স ও শারীরিক অক্ষমতা, এই সাত কারণে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের ভরাডুবি হয়েছে। যদিও ২০ দলীয় জোট ভরাডুবির মূল কারণ হিসেবে ক্ষমতায় না থাকা এবং ভোটে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কোন প্রকার দাঙ্গা হাঙ্গামা ছাড়াই অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিএনপির এমন অভিযোগ হালে পানি পাচ্ছে না। এমন অভিযোগে অসুন্তুষ্ট ২০ দলীয় জোটেরই অনেক নেতাকর্মী। তারা বলছেন, প্রার্থী হিসেবে অন্য কাউকে দিলে ভোটের ব্যবধান কমে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারত। অন্যদিকে রাস্তা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব হিসেবে গাজীপুরকে গড়ে তোলার অঙ্গীকার, গাজীপুরকে যানজটমুক্ত করতে প্রায় তিন বছর ধরে নিজস্ব লোক দিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখা, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদক নির্মূলে নানাভাবে কাজ করা, শিক্ষায় নিজস্ব অর্থায়নে মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান অব্যাহত রাখা, বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও পরিশ্রমী হওয়ায়, গাজীপুরবাসী রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন চাওয়ায় এবং অতীতে বিএনপির প্রার্থীকে মেয়র নির্বাচিত করে কোন সুফল না পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় প্রার্থী এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার মূল কারণ। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে তৈরি পোশাক থেকে। এসব পোশাক কারখানার অধিকাংশই গাজীপুর জেলায় অবস্থিত। তাই এর উন্নয়ন করতে ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন গঠন করেন। এর আয়তন ৩২৯ দশমিক ৫৩ বর্গ কিলোমিটার। ওই সময় লোকসংখ্যা ছিল ২৫ লাখ। ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড নিয়ে সিটি কর্পোরেশনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৫ আর নারী ভোটার ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১। ভোটকেন্দ্র ৪২৫টি। আয়তনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি কর্পোরেশন গাজীপুর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালেই সিটি কর্পোরেশনটিতে প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচন হয়। প্রথমবারের নির্বাচনে মেয়র হিসেবে অনেক ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। ভোটারদের ভাষ্য, তাদের ধারণা ছিল তিনি যেহেতু শিক্ষক, সে মোতাবেক তুলনামূলক অনেক ভাল মানুষ হবেন। তিনি উন্নয়ন করবেন। কিন্তু দেখা গেল হিতে বিপরীত। মেয়র হওয়ার পর কোন কাজই হলো না। বিশেষ করে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনসহ পুরো এলাকার রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা চরম খারাপ। রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার কোন উন্নতি ঘটল না। কিছু কিছু দুর্গম জায়গা আছে। সেসব জায়গায় উন্নয়নের নূন্যতম ছোঁয়া পর্যন্ত লাগেনি। ক্ষমতায় থাকলেও যানজটের মতো মহাদুর্ভোগ থেকে তারা বাঁচতে পারলেন না। প্রতিদিন রাস্তায় তাদের অতিরিক্ত টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। যেখানে দশ মিনিটে হেঁটে যাওয়া সম্ভব, সেখানে ত্রিশ-চল্লিশ টাকা রিক্সা বা অটোরিক্সায় ভাড়ায় দিয়ে যেতে হলো। তার ব্যর্থতাটুকু পর্যন্ত তিনি কোন সময়ই তাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন না। সারাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে, অথচ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তেমন কোন উন্নয়নই হচ্ছে না। তাই গাজীপুরবাসী একজোট হয়ে উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ভোটারদের যুক্তি, তারা গাজীপুরের উন্নয়ন চান। তাই তারা উন্নয়নের পক্ষে থাকতে চান। অতীতে তারা আবেগে গা ভাসিয়েছিলেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ক্ষমতাসীন সরকার যেভাবে দেশের উন্নয়ন করছে, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে গাজীপুরেও উন্নয়ন হবে। তাই তারা সঠিক জায়গায় ভোট দিয়েছেন। সার্বিক দিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নানা হিসেব নিকেষেই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার নির্বাচন শুরুর পর থেকেই পিছিয়ে ছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রার্থীর বয়স ও শারীরিক অক্ষমতা। প্রার্থী একা চলতে পারেন না। তাকে চলতে হলে কমপক্ষে দুইজনের সহায়তা নিতে হয়। ভোটারদের বক্তব্য, যে প্রার্থী নিজেই বয়সের কারণে চলাফেরা করতে পারেন না, তার পক্ষে ভোটারদের আর কতটুকুই বা খেদমত করা সম্ভব! এ ছাড়া ২০ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ের গ্রুপিং এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল হাসান উদ্দিন সরকারকে মারাত্মকভাবে ভোটারদের কাছে দুর্বল করে ফেলে। বিগত দিনে হাসান উদ্দিন সরকার যখন জনপ্রতিনিধি ছিলেন, তখন তিনি শুধু একমুখী উন্নয়ন করেছেন। উন্নয়নের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তিনি টঙ্গীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ভোটারদের কথা, তিনি তো শুধু টঙ্গীর নেতা ছিলেন না। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন। হাসান উদ্দিন সরকারের এমন একপেশে মনোভাব ভোটারদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ভোটারদের কথা, রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কথা হাসান সরকারও বলেছেন। তবে নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থীর মতো নিজস্ব লোকজন দিয়ে যানজট নিরসনে কোন প্রকার উদ্যোগ নেননি। নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম প্রায় তিন বছর ধরে গাজীপুরের যানজট নিরসনে জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের নামে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকভাবে বৃত্তি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানে অন্তত তিন শ’ বেকার মানুষ রয়েছেন। তাদের মাসিক সম্মানজনক বেতন দেন জাহাঙ্গীর আলম। সেই বেতনের টাকায় তাদের সংসার চলে। তারা হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, থানা পুলিশ ও কমিউনিটি পুলিশের সঙ্গে মিলে রাস্তার যানজট নিরসনে পালাক্রমে টানা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন। এতে করে যানজট কিছুটা হলেও কমে এসেছে। যা গাজীপুরসহ আশপাশের জেলার বাসিন্দাদের জন্য রীতিমতো আর্শীবাদ। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা আগ থেকেই বলে আসছেন, ক্ষমতাসীন সরকার তাদের প্রার্থীদের জোর করে পাস করিয়ে নিবেন। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। অথচ ভোটের দিন দেখা গেল, কোন কেন্দ্রেই মেয়র প্রার্থী বা তাদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে কোন হাতাহাতির ঘটনাও ঘটল না। মারধর তো দূরের কথা। মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিলেন। কোন চাপ নেই, কোন আশঙ্কা বা আতঙ্ক ছিল না। একটি ককটেল পর্যন্ত ফুটল না। গাজীপুরবাসী অতীতে কোনদিনই এমন নির্বাচনী পরিবেশ আর দেখেনি। নির্বাচনের এমন পরিবেশের কারণে ভোটের দিনেও অনেক ভোটার তাদের মত পাল্টে উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এ ছাড়া বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও পরিশ্রমী হওয়ায় সকল শ্রেণী পেশার ভোটারদের বেশি আগ্রহ ছিল জাহাঙ্গীর আলমের প্রতি। এ জন্য নীরবে বিশাল বিপ্লব ঘটে গেছে জাহাঙ্গীরের পক্ষে। বিএনপি প্রার্থীর দল বদলের ইতিহাসও ভোটের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। বিগত দিনে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে গাজীপুরে জঙ্গীদের একের পর এক হামলার ঘটনা, অনেক জঙ্গী গাজীপুর থেকে গ্রেফতার হওয়া এবং সর্বশেষ নির্বাচনকালীন সময়েও দুইজন দুর্ধর্ষ জঙ্গী গ্রেফতারের ঘটনাও নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের চরম ভরাডুবি হয়েছে। বিএনপি তাদের ভরাডুবির জন্য সরকারের কারসাজি, ভোটে অনিয়ম ও তাদের সরকার ক্ষমতায় না থাকার যে দাবি করে আসছে, তা নিছক কথার কথা। কারণ বিগত দিনে বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান মেয়র হয়েছিলেন। তখনও আওয়ামী লীগই রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। তাই বিএনপির এমন অভিযোগ শুধু ভোটার নয়, তাদের দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীরাও বিশ্বাস করেন না।
×