ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি নেতা মেজর (অব) মিজানসহ ৪ জন রিমান্ডে

গাজীপুরে নাশকতা চালাতে চার যুবকের ষড়যন্ত্রের ছক ফাঁস!

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৮ জুন ২০১৮

  গাজীপুরে নাশকতা চালাতে চার যুবকের ষড়যন্ত্রের ছক ফাঁস!

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) মিজানুর রহমান মিজান ও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের চারজনকে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে জড়িত তারা। গাজীপুর নির্বাচনে নাশকতার বিষয়ে টেলিফোনে কলাবাগান ক্লাবে ৪ যুবকের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতা মেজর (অব.) মিজানুর রহমান মিজান। ওই ৪ যুবকের নাশকতায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। নাশকতার ভিডিও ও ছবি ধারণ করতে তাদের হাতে ‘স্পাইক্যাম’ সংযুক্ত হাতঘড়ি দেন মিজানুর রহমান। ইউটিউবে ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপেও এ তথ্য রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। অডিও ক্লিপসে মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নেয়া আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউনিয়নের যুবদল নেতা শফিকুল ইসলামকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তাকে গ্রেফতারে জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপির কর্মীদের ‘আওয়ামী লীগের ব্যাজ ও নৌকার ব্যানার’ দিয়ে আওয়ামীকর্মী সাজিয়ে ভোট কেন্দ্রে ঢুকে বড় ধরনের নাশকতা, ধ্বংসাত্মক কর্মকা-, জাল ভোট প্রদান, অপ-প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচন বানচাল, বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য ছক কষে বিএনপি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক ও সজাগ থাকায় বিএনপির এই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বানচাল, বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হওয়া যায়। মিজানকে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার রাতে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। গোয়ান্দা পুলিশ উত্তর বিভাগের উত্তরা জোনাল টিমের এসআই মোঃ সাইফুল ইসলাম ওই মামলার বাদী। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগের রাতে গুলশানের বাসা থেকে মিজানকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর মঙ্গলবার ভোটের দিন সকাল ৬টায় আশুলিয়ায় বিকেএসপির মূল ফটকের সামনের রাস্তায় জড়ো হওয়ার সময় মামলার বাকি চার আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তাদের কাছ থেকে তিনটি রিস্টওয়াচ ও ৯৫০০ টাকা জব্দ করা হয় বলে জানান অতিরিক্ত উপ-কমিশনার। গ্রেফতার করা অপর চারজন হলেন- শফিকুল ইসলাম (৪৩), মোঃ দিন্নাত (২৬), মোঃ জুনায়েদ হোসেন জয় (১৬) ও আসাদ আলী (২২)। রিমান্ডে বিএনপি নেতা মিজান ॥ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নাশকতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) মিজানুর রহমানকে ২ দিনের রিমান্ড আদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া আদালত আরও ৩ আসামিকে ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। তারা হলেনÑ মোঃ শফিকুল ইসলাম (৪৩), জিন্নাত (২৬) ও মোঃ আসাদ আলী। এ মামলায় গ্রেফতার আরেক আসামি জুনায়েদ হোসেন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে কিশোর আদালত। টঙ্গীর কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। গত ২৭ জুন বুধবার বিকেলে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক আমিনুল হক আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশ দেন। বুধবার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পুলিশ পরিদর্শক আরমান আলী ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে আসামিদের হাজির করেন। আদালত শুনানি শেষে রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশ দেয়। অপরপক্ষে আদালতে রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন শুনানি করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী সানাউল্লা মিয়া। আসামিদের জামিন না-মঞ্জুর করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেয় আদালত। হক ২৫ জুন দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে গুলশান-১ নম্বরের ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাসা থেকে মেজর (অব.) মিজানুর রহমান মিজানকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি গাজীপুর নির্বাচনে নাশকতার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এ সংক্রান্ত দুটি অডিও ক্লিপ জব্দ করা হয়। মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় একাধিক মামলা হয়েছে। গাজীপুরে নির্বাচনকেন্দ্রিক নাশকতার ষড়যন্ত্রে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। মামলার এজাহারে যা বলা হয় ॥ বিএনপি নেতা মিজানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে বলা হয়, জনগণের বিভিন্ন শ্রেণীতে দৃশ্যমান শ্রুতিনির্ভর ভুল, ক্ষতিকর উপাত্ত উপস্থাপন করে উস্কানি প্রদান করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও জনগণের মাঝে ভীতি ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করার জন্য একটি কুচক্রী মহল বিভিন্ন প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে জানতে পারে ডিবিসহ বিভিন্ন সরকারী সংস্থা। গত ২৬ জুন তারিখে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি ও নাশকতা সৃষ্টির জন্য একটি রাজনৈতিক দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য গ্রেফতার প্রধান আসামি মিজানসহ অন্যরা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় যে, ২৫ জুন ধানমন্ডির কলাবাগান ক্লাবে বসে বিকাল সাড়ে ৪টায় মিজানুর রহমান অন্যদের নিয়ে বৈঠক করে এবং ভোটকেন্দ্রের ব্যালট পেপার দখল করে নৌকায় সিল মেরে সেই দৃশ্য রিস্টওয়াচের ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করে পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও পুলিশ গ্রেফতারের চেষ্টা করছে বলে জানানো হয়। রিস্টওয়াচের ভিডিও-তে দৃশ্য ধারণের ছক ॥ ভোটকেন্দ্রের ব্যালট পেপার দখল করে নৌকায় সিল মেরে সেই দৃশ্য রিস্টওয়াচের ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করে পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেয় বিএনপির নেতা গ্রেফতারকৃত মিজানুর রহমান। গত ২৫ জুন মধ্যরাতে মিজান গ্রেফতার হওয়ার আগে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার কথিত টেলি কথোপকথনের দুটি অডিও ক্লিপ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ইউটিউবে আসা একটি অডিওতে দুইজনকে গাজীপুরের ভোট নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। সেখানে তিনি নির্বাচনের দিন গাজীপুরের কাশিমপুর ইউনিয়নের তিন ভোটকেন্দ্রে ‘আওয়ামী লীগের ব্যাজ ও নৌকার ব্যানার’ নিয়ে ঘুরতে পারবে এ রকম তিনজন ছেলে ‘ম্যানেজ’ করতে বলেন। সেজন্য টাকা পয়সা ও ভোটের দিন ‘যন্ত্রপাতি’ দেয়া হবে বলেও আশ্বাস দেয়া হয় ওই টেলি আলাপে। মিজানুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, যে পোলিং সেন্টারটা, তিনটার ভেতরে যে কোন একটা, কিন্তু এই পোলিং সেন্টারের পাশে আমাদের কোন লোকের বাড়ি থাকতে হবে। যে বাড়ির ভেতরে বইসা, জানালার ভেতরে বইসা দোতলা বাড়ি বাড়ি থাকলে সুবিধা হয়, বুঝাইতে পারছি ? লোক ভাড়া করা আর বাসা ভাড়া নেয়ার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করতে শোনা যায়। অন্য অডিওতে মিজান বলতে শোনা যায়, “এগুলারে (ভাড়া করা লোক) একটা গাড়ি দিয়া তুমি ঢাকায় চইলা আসবা। আমি ট্রেনিং মেনিং দিয়া ছাইড়া দিব। বুঝতে পারছো ? যেভাবে পরিকল্পনা হয় ॥ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্ত কর্মকর্তা উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেছেন, বিএনপি নেতা মিজানকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পরিকল্পনার কথা জানা যায়। জিজ্ঞাসাবাদে মিজান জানান, ২০০৮ সাল থেকে মিজানুর রহমানের সঙ্গে আশুলিয়ার শিমুলিয়ায় ইউনিয়নের যুবদল নেতা শফিকুল ইসলামের পরিচয়। তাদের মধ্যে প্রায়ই ঢাকায় দেখা হতো। তারা নিয়মিত ফোনেও যোগাযোগ রাখেন। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মিজান নতুন নাশকতার পরিকল্পনা করেন। ৩ দিন আগে গত ২৩ জুন মিজান তার নিজের মোবাইল ফোন থেকে শফিকুলকে ফোন দেন এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন (গাসিক) নির্বাচনে তার নাশকতার পরিকল্পনার কথা জানান। শফিকুল ফোনেই মিজানকে সহযোগিতা করা ও নাশকতা করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শফিকুলের সহযোগিতা চান মিজানুর রহমান। মিজানের কথা মতো শফিকুল টাকার বিনিময়ে ৪ তরুণের সঙ্গে চুক্তি করে। কাজ বুঝে নিতে ঢাকায় মিজানের কাছে পাঠানো হয় তরুণদেরকে। আরও কয়েকজন জন জড়িত ॥ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানায়, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগের দিন গত ২৫ জুন একটি প্রাইভেটকারে করে ৪ যুবককে মিজানের কাছে পাঠায় শফিকুল। ওই চার যুবক হলোÑ কফিল উদ্দিন, জয়, আসাদুল ও জিন্নাহ। মিজান এ সময় কলাবাগান ক্লাবে ছিলেন। কলাবাগান ক্লাবে তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকের সময় মিজান ১০ হাজার নগদ টাকা দেন তাদের। কাজ হওয়ার পর তাদের আরও টাকা দেওয়ার কথা ছিল। টাকা দেয়ার পর ‘স্পাইক্যাম’ সংযুক্ত হাত ঘড়িও দেওয়া হয় তাদের। এই ৪ যুবককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এখন ডিবি হেফাজতে রিমান্ডে রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভিযোগ আনা হচ্ছে। কলাবাগান ক্লাবে মিজান এবং ওই ৪ তরুণ বৈঠক করার সময় আরও কয়েকজন ব্যক্তি ছিল। ডিবি পুলিশ তাদের বিষয় খোঁজখবর নিচ্ছে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ফোনালাপে অংশ নেয়া শফিকুলকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তাকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন ডিবি পুলিশের ওই কর্মকর্তা। মিজানেরই কণ্ঠস্বর ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেছেন, কথোপকথনের অডিও রেকর্ড যাচাই করে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, সেটা মিজানের কণ্ঠ। এ কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিজানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে বিএনপির গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যাতে আরও অনেকেই জড়িয়ে যেতে পারেন বলে ওই কর্মকর্তার দাবি।
×