ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে বাজেট আলোচনার সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আমরা কারও কাছে মাথা পেতে নয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই সরকারের ধারাবাহিকতা আছে বলেই সব উন্নয়ন প্রকল্প দৃৃশ্যমান

অগ্রযাত্রা যেন না থামে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৮ জুন ২০১৮

অগ্রযাত্রা যেন না থামে

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা দেশের চলমান উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা যেন থেমে না যায়, অব্যাহত থাকে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী জাতি, আমরা কারোর কাছে কেন হাত পেতে চলব? আমরা কারোর কাছে হাত পেতে নয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমরা নিজেরা যে দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তা আমরা প্রমাণ করেছি। বর্তমান সরকার টানা দুই মেয়াদে ৯ বছর পূর্ণ করে ১০ বছরে পা দিয়েছে। মানুষের সত্যিই দিনবদলের পরিবর্তন হয়েছে। যেহেতু সরকারের ধারাবাহিকতা আছে, একটানা সাড়ে ৯ বছর আমরা ক্ষমতায় রয়েছি বলেই সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আজ দৃশ্যমান। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ সালের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনার সমাপনী আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনরুল্লেখ করে বলেন, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-মাদকের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। মাদক একটি দেশকে, সমাজকে ও সংসারকে ধ্বংস করে দেয়। এদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রাখব, যে যাই বলুক তাতে কিছু আসে যায় না। দেশকে আমরা মাদকমুক্ত করবই। দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আরও এগিয়ে নিয়ে যাব। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে সংসদে অর্থবিল পাসের মাধ্যমে প্রস্তাবিত বাজেটের উপর দীর্ঘ আলোচনা শেষ হয়। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটটি পাস হবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টানা দু’বার ক্ষমতায় আসতে পেরেছি বলেই সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- দৃশ্যমান হয়েছে, জনগণ তার সুফল পাচ্ছে। সমৃদ্ধ আগামীর পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করেই এই বাজেট দেয়া হয়েছে। দেশ কতটুকু এগিয়ে যাবে, মানুষের জীবনমানের কতটুকু উন্নয়ন ঘটবে, সেটি বিবেচনা করেই বাজেট দেয়া হয়। দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যই আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসে, তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ে, দুর্নীতি করে, এলিট শ্রেণী তৈরি করে অবৈধভাবে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। জনগণের কোন চিন্তা করে না, উন্নয়নও করতে পারে না। সেটা দেশের জনগণ কখনও ভুলে যাবে না। তিনি বলেন, ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জনগণ বুঝতে পারে সরকার মানে জনগণের সেবক। ৯ বছর পূর্ণ হয়ে ১০ বছর হচ্ছে, মানুষের সত্যিই দিনবদলের পরিবর্তন হয়েছে। যেহেতু সরকারের ধারাবাহিকতা আছে, একটানা সাড়ে ৯ বছর ক্ষমতায় আছি বলেই সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আজ দৃশ্যমান। বিএনপি আমলের ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট আজ ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছি। বিএনপির আমলের ১৯ হাজার উন্নয়ন বাজেট ছিল, আমরা এবার এক লাখ ৭৩ হাজার এডিপি দিতে পেরেছি বলেই দেশ সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া সরকাররা বাজেট দেওয়ার আগে বিদেশের কাছে ধর্না দিত। এছাড়া বাজেটই হতো না। ইনশাআল্লাহ বর্তমান সরকার ৯০ ভাগ নিজস্ব অর্থায়নে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন করেছি। তিনি বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ ভাগে উন্নীত হবে। প্রতিবার ৭ ভাগের ওপর প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করা অত সহজ ছিল না। আমরা এখন স্বল্পোন্নত নেই, উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছি। ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনের মতো শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশের কাতারে আমরা রয়েছি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, দেশকে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যাব। আমরা সেটা করতে পেরেছি। আমাদের অর্জনের পেছনে রয়েছে সকল মেহনতি মানুষ। এ সফলতা এসেছে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। সংসদ নেতা বলেন, দেশপ্রেম ও আন্তরিকতা থাকলে দেশের যে প্রকৃত উন্নয়ন করা যায় আমরা তা প্রমাণ করেছি। অনেক সমৃদ্ধিশালী দেশকেও আমরা উন্নয়নের ক্ষেত্রে পেছনে ফেলেছি। দেশবাসীর কাছে অনুরোধ, আমাদের এই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা যেন থেমে না যায়, অব্যাহত থাকে। আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী জাতি, আমরা কারওর কাছে হাত পাতব কেন? আমরা নিজেরা পারব না কেন? আমরা যে পারি তা প্রমাণ করেছি। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের বিনিয়োগ থেমে নেই;বরং বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী আছে বলেই এত বড় বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছি, তখন রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। মানবিক কারণে আমরা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। ছোট একটা ভূ-খন্ডে বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে এতো উন্নয়ন কিন্তু কম কথা নয়। ১৬ শ’ মেগাওয়াট নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম হয়েছি। চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সঙ্কট রয়েছে বলে আমরা এলএমজি আমদানির ব্যবস্থা করছি। রান্নার কাজে এলপিজির দাম হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছি। কারণ মানুষের জীবনমান উন্নত ও স্বাভাবিক করাই বর্তমান সরকারের প্রধান লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ৫০ লাখ অসহায় মানুষকে আমরা বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। মৎস্য উৎপাদনেও আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা বিনামূল্যে ছাত্র-ছাত্রীদের বই দিচ্ছি। আমরা চাই না দেশের একটি মানুষও গৃহহারা থাকুক। আমরা সব মানুষকে ঘর-বাড়ি দেব। ইনশাআল্লাহ একটি মানুষও গৃহহারা থাকবে না। তিনি বলেন, শুধু একটি বছরের নয়, আমরা একশ’ বছরের উন্নয়নের ডেল্টা প্লান নিয়েছি। আমরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রেখে কাজ করছি, দেশটাকে উন্নত করার জন্য যা যা করার তার সবই করছি। আমরা সমুদ্রতল থেকে আজ মহাকাশ জয় করেছি। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে মহাকাশে চলে গিয়েছি। আমরা কোথাও পিছিয়ে নেই।’ ৭৫ পরবর্তী জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া কেউই স্থলসীমানা ও সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করার সাহস পাননি। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করেছি। এখন ব্ল-ইকোনমি গ্রহণ করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, কোটা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা করা হয়। যাদের জন্য কোটা করেছি তারাই না চান তবে রাখার দরকার কী। কেবিনেট সেক্রেটারির মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানেই ঠিক হবে। এরপর যদি কেউ মফস্বলে চাকরি না পায় তখন আমাদের কেউ দায়ী করতে পারবে না। কিন্তু অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা থাকবে। কারণ তাঁদের জন্যই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এ সময় আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা বলেন, আমার ছেলে জয় (সজীব ওয়াজেদ জয়) যুক্তরাষ্ট্রে এমআইটিতে সুযোগ পেলেও অর্থের টাকা যোগান দিতে পারিনি। মিশনারি স্কুলে পর্যন্ত পড়ে সে বড় হয়েছে। চাকরি করে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রী হয়েও ছেলের পড়ার জন্য টাকার জোগাড় করতে পারিনি, কার কাছে টাকা চাইব? আর স্টুডেন্ট লোন নিয়ে মেয়ে পুতুল অক্সফোর্ডে পড়েছে, ২১ বছর বয়স থেকে সে চাকরি করে পড়াশুনা করেছে। পড়াশুনা শেষ করে এখন সে আবার চাকরি করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের কলাকৌশল আমরা বুঝে গেছি, সেজন্য জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি কখনও আমাদের সময় বাড়েনি। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই দ্রব্যমূল্য রাখতে পেরেছি। আর দেশের মানুষের স্বার্থেই আমরা কৃষি ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দিচ্ছি। উৎপাদনের মূল্য থেকে আমরা কম মূল্যে জনগণকে বিদ্যুত দিচ্ছি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে দেছে, স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। বাংলাদেশটা যেন উন্নত হোক। আমার জীবনের কোন চাওয়া-পাওয়া নেই, বিয়ে-শাদি কোথাও যাই না। দিনরাত শুধু দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার করেনি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু জাপানে এই সেতু নির্মাণের প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জিয়া এসে বন্ধ করে দেয়। খালেদা জিয়াও বন্ধ করে রাখে। আমরা ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু শুধু সড়ক নয়, রেলপথও নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেই। দুর্নীতির অভিযোগ চ্যালেঞ্জ দিয়ে জিতেছি, নিজস্ব অর্থায়নেই আমরা পদ্মা সেতু করছি। আরও সহজে সেতুটি করতে পারতাম। ফ্লাড ডিজাইনে হলে দ্রুত হতো, কিন্তু আমরা দোতালা সেতু করছি বলেই একটু সময় লাগছে। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, পদ্মা সেতু হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন করব। তিনি বলেন, যমুনা সেতু করতে গিয়ে জমি অধিগ্রহণে দেড়গুণ দিতে হতো, পদ্মা সেতুতে তিনগুণ দিতে হচ্ছে। এজন্য প্রকল্পের টাকা বেশি লাগছে। পুঁজিবাজার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুস্থভাবে দেশে পুঁজিবাজার চলছে, এর উন্নয়নে যা যা করার সবই করে দিয়েছি। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিশ্বের অন্যতম বিনিয়োগের স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনিয়ম দূর করে পুঁজিবাজারে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। একটি জ্ঞাননির্ভর বিনিয়োগকারী নিশ্চিত করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান যাতে সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে সেজন্য পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-মাদকের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। মাদক একটি দেশকে, সংসারকে ধ্বংস করে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রাখব, যে যাই বলুক তাতে কিছু আসে যায় না। দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাব। এই বাজেট নিয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রী আবারও বাজেট উপস্থাপন করুক, সেটাই আমরা চাই। বাংলাদেশকে আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই ইনশাআল্লাহ।
×