ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রিম ঝিম বরষা...

বর্ষার রোমান্টিকতা শুরু এবার মৃদু সুরে

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ২৮ জুন ২০১৮

বর্ষার রোমান্টিকতা শুরু এবার মৃদু সুরে

সমুদ্র হক ॥ যদিও মাঝে মধ্যে বারিধারায় বর্ষা পরিচিতি তুলে ধরেছে তারপরও সেই রোমান্টিকতার বিচ্ছেদও চোখে পড়ছে। তবে ঈষাণ কোণে লুকিয়ে থাকা ছাই রঙের মেঘ সুর তুলেছে -বিচ্ছেদের ছন্দ লয়ে এবার বর্ষার মিলন উঠবে পূর্ণ হয়ে। আবহাওয়া বিভাগ প্রতিদিনের যে আভাস দিচ্ছে তাতেও বর্ষার সেই রূপ ফুটে উঠছে না। হালে বজ্রপাতের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সেই ছন্দে ভাটা পড়েছে। যেন এই রোদ এই বৃষ্টির খেলা। বৃষ্টির পর সাধারণত তাপ কমে যায়। এবার উল্টো। সঙ্গে নিয়ে আসে ভাপসা গরম। তারপরও আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল বলে কথা। মৃদু সুরে বর্ষার রোমন্টিকতা শুরু হয়েছে। বর্ষা কতটা মধুর-বেদনার আর কতটাই বা রোমান্টিকতা! সেই বাল্মীকি থেকে কালিদাস হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাঙালীর ঋতু বন্দনায় কতই না বর্ণনা এসেছে। সব ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথই প্রকৃতিতে মানব মানবীর হৃদয়ের আবেগের ধারা তৈরি করেছেন। যেখানে অকারণে চোখের জলও ভাললাগার কারণ হয়ে ওঠে। বাংলা কাব্যে সাহিত্যে সঙ্গীতে বর্ষাকে নিয়ে যত গান যত কবিতা যত গল্প যত উপন্যাস অন্য কোন ঋতুকে নিয়ে এতটা নেই। বর্ষার এই ধারায় গীতিকারদের কথায় কতই না সুর উঠেছে। সতীনাথের কণ্ঠে “এলো বরষা যে সহসা মনে তাই রিমঝিমঝিমরিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই...” মান্না দের কণ্ঠে “ওগো বরষা তুমি ঝরো নাকো এমন করে.....” হেমন্তের কণ্ঠে “তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো...” লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে আষাঢ়-শ্রাবণ মানে নাতো তো মন ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তালাত মাহমুদের কণ্ঠে “এই রিম ঝিম ঝিম বরষা হাওয়া হিম হিম হিম পরসা ” গানে হৃদয় বীণায় কত আকুতি জেগে ওঠে। সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে “বরষারও প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়...”। আধুনিক গানের এই ধারার বহু আগে বর্ষার কাব্য ধারায় মহাজন কবি বিদ্যাপতি গোবিন্দ দাস, চন্ডী দাস মেঘ বৃষ্টির অনুষঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতাকে মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ আরও এগিয়ে মেঘকে ছুঁয়েছেন হৃদয়ের রঙে। মেঘ তো পালা করে এসে খেলা করে। বর্ষায় আকাশজুড়ে ভেসে আসে নানা বর্ণের মেঘ। মেঘমেদুর, মেঘপুষ্প, জলদ, মেঘাগম, মেঘবহ্নি, মেঘযামিনী, জলধর মেঘগুলোই বেশি ভাসে। মেঘের আরেকটু পারেই রঙধনু। কালিদাসের বর্ণনায় রেবা নদীর তীরে বর্ষার দিনে মালবিকা প্রিয়তমের প্রতীক্ষায় ছিল। এর মধ্যেই হলুদ বরণ গায়ক দল হেরে গলায় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর সুর তুলে বর্ষার বারতাই জানিয়ে দেয়। বাংলার বর্ষার সত্তাকে ঘিরে আছে বাস্তবতায় মানুষের জেগে ওঠার সংগ্রামের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করার আহ্বান। এই সময়েই নদ নদী ফুলে ফেঁপে রুদ্ররূপ ধারণ করলে নদী তীর ও চরগ্রামের মানুষ জেগে ওঠে নিজেদের রক্ষায়। মাটির বাঁধও যখন রক্ষা করতে পারে না তখন মানব জীবনের সঙ্গে পশুপাখির জীবন রক্ষার তাগিদও মানবিক গুণাবলীতে যোগ হয়। কে আপন কে পর তা মুছে যায়। স্রোতের তীব্র ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকার বৈঠা ঠেলে পাড়ি দেয় শুকনো ভূমির আশ্রয়ে। ভালবাসার বন্ধনে একাকার হয়ে যায় মানুষ। বর্ষার সজল মেঘের গভীর কালোয় এক অরুণ আলোর দেখা পায় মানুষ। এই কথাগুলো বর্ষার অনুভবে আলাদা সুরে এসেছে। বেদনার্ত এমন আলেখ্যের মধ্যেই মানুষ নিজেদের ছন্দেই এগিয়ে যায়। বর্ষায় অনুষঙ্গ যাই থাক বৃষ্টির সুর মানব-মানবীর হৃদয়ে আরেক সুর এনে দেয়, যা মধুছন্দে নেচে ওঠে। গ্রামে টিনের চালা ঘরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ধ্রপদী সুর তোলে। বৃষ্টিতে ভিজে এবং ছাতা নিয়ে বেড়ানো সে আরেক ছন্দ। এই ছাতা বছরের অনেকটা সময় ঘরের কোণেই থাকে। ধুলোও জমে। তবু ওই ধূলির পরতে ভরা বস্তুটি হাতে না নিলেই নয়। বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে এই ছাতা। ছাতা মেরামতের কারিগর-টাইকরদের মৌসুম এই বর্ষাকাল। বর্ষার পানি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গেই গ্রামের কিশোররা ঠেলা জাল নিয়ে মাছ ধরতে নামে। কিশোর কিশোরী হাঁটু পানি পেরিয়ে যায় এ বাড়ি ও বাড়ি। তরুণরা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ঢলের পানিতে। গ্রামীণ জীবনে বর্ষার এমন ধারার মধ্যে মানুষ খুঁজে নেয় জীবনের অর্থ। আগের দিন যেখানে ছিল শুকনো সড়ক রাতভর বৃষ্টিতে পরদিন সেই সড়ক ডুবে গেলে বর্ষার ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। বর্ষায় জলেভেজা কেতকি (কেয়া) দূর থেকে সুবাস এনে দেয়। বাঙালী সংস্কৃতিতে বর্ষার প্রতীকী ফুল কদম। “বাদল দিনে প্রথম কদম ফুল করেছ দান..” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কদমকে এভাবে টেনে এনে ব্যঞ্জনা দিয়েছেন গানের সুরে। গ্রামীণ জীবনের এই ধারার পাশাপাশি শহুরে জীবন আরেক ধারার। দেশের বড় শহরগুলোতে বৃষ্টি এনে দেয় যন্ত্রণার দুর্ভোগ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বৃষ্টি হলেই ভোগান্তির মাত্রা যায় বেড়ে। খ-কালীন বন্যার রূপ নেয় মহানগরী। স্তব্ধ হয়ে পড়ে সব কিছুই। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম বন্ধুর পথের মতো। তবুও থেমে থাকে না জীবন। বর্ষার এমন জীবনেই মানুষের পথ চলা।
×