ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : পল ক্রুগম্যান;###;অনুবাদ : এনামুল হক

বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৮ জুন ২০১৮

বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে

মার্কিন সরকার একটা নীতি হিসেবে আক্ষরিক অর্থেই সন্তানদের তাদের বাবা-মায়ের বাহুবন্ধন থেকে কেড়ে নিয়ে ঘেরাটোপের মধ্যে রেখে দিচ্ছে। সরকারী কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেন এগুলো খাঁচা নয়। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট চাইছেন যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তার সহযোগীদের ব্যাপারে তদন্ত পরিচালনা বাদ দিয়ে বরং তার রাজনৈতিক শত্রুদের পেছনে লাগুক। তিনি তার গণতান্ত্রিক মিত্রদের অপমান-অপদস্থ করে চলেছেন ও অন্যদিকে খুনে একনায়কদের প্রশংসা করছেন। ফলে একটা বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে অভিন্ন বিষয় কোন্টি? স্পষ্টতই সেই অভিন্ন বিষয়টি হলো এসব কিছুই হোয়াইট হাউসে যিনি বসে আছেন সেই মানুষটির চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, তার মতো আর কোন নিকৃষ্টতম মানুষ এই প্রেসিডেন্ট পদ ধারণ করেননি। তবে এর চেয়েও বৃহত্তর একটি বিষয় আছে এবং সেটা ঠিক ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কিত নয়। আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি তা হলো আমেরিকার দীর্ঘকাল ধরে স্থায়ী মূল্যবোধগুলো যা আমেরিকাকে মহান করে তুলেছিল সেগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে এক শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিরাজমান। বিশেষ করে বলতে হয়, আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় ক্ষেত্রে এমন এক মাত্রার আধিপত্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছি যা প্রাচীন রোমের তুঙ্গে থাকার দিনগুলোর পর থেকে আর দেখা যায়নি। তবে বিশ্বে আমাদের ভূমিকা সর্বদাই ছিল অর্থ ও অস্ত্রের চাইতেও বেশি কিছু। আদর্শের বেলায়ও সেই একই কথা আমেরিকা তার নিজের চাইতেও বৃহত্তর কিছুর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল- দাঁড়িয়েছিল সর্বজনীন নীতিমালা হিসেবে স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পক্ষে। অনেক সময় আমরা অবশ্য এসব আদর্শের প্রশ্নে ঘাটতির পরিচয় দিয়েছি। তথাপি এই আদর্শগুলো ছিল বাস্তব ও গুরুত্ববহ। অনেক দেশ বর্ণবাদী নীতি অনুসরণ করেছে। কিন্তু সুইডিশ অর্থনীতিবিদ গুনার মিবড়াল ১৯৪৪ সালে আমাদের নিগ্রো সমস্যার ওপর একটা বই লেখার সময় এই সমস্যাটিকে আমেরিকার উভয় সঙ্কট বলে অভিহিত করেছিলেন। কারণ, তিনি আমাদের এমন এক জাতি হিসেবে দেখেছিলেন যার মধ্যে ‘আলোকায়নের ঘ্রাণ’ ছিল এবং যার নাগরিকরা কতক স্তরে সচেতন ছিল যে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি আমাদের আচরণ আমাদের অনুসৃত নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং আমেরিকার এক মৌলিক ধরনের শোভন শালীনতা হয়ত সাধু চরিত্র আছে এই মর্মে তার বিশ্বাসের সত্যতা শেষ অবধি নাগরিক অধিকার আন্দোলনের উত্থান ও সাফল্যের দ্বারা সুপ্রতিপন্ন হয়েছিল যদিও সেই আন্দোলনের সাফল্য ছিল অসম্পূর্ণ। কিন্তু আমেরিকার এই সাধু চরিত্র যা প্রায়শই লঙ্ঘিত হয় তবে এখনও যা বাস্তব সত্য আমেরিকার শক্তিমত্তার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক? বিশ্ব বাণিজ্যের কথা না হয়নি বলা হলো। এর জবাব হলো ৭০ বছর ধরে আমেরিকার সাধু চরিত্র ও আমেরিকার মহিমা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলেছে। আমাদের আদর্শ এবং অন্যান্য দেশও জানে যে আমরা এই আদর্শ ধারণ করে থাকি এই বাস্তবতাই আমাদের এক ভিন্ন ধরনের মহাশক্তিতে পরিণত করেছেÑ যা অন্যদের মনে আস্থার জন্ম দিয়েছে। কথাটা ভেবে দেখুন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যখন শেষ হলো, আমরা ও আমাদের ব্রিটিশ মিত্ররা বস্তুতপক্ষে বিশ্বের এক বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছিলেন। আমরা আমাদের দখলদারিত্বকে স্থায়ীরূপ দিতে পারতাম। অথচ বশংবদ পুতুল সরকার বসিয়ে দিতে পারতাম যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে করেছিল এবং এও সত্য যে কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশে আমরা তা করেও ছিলাম। দৃষ্টান্তস্বরূপ ইরানের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস মোটেও ভাল নয়। কিন্তু আমরা বরং প্রধানত যে কাজটা করেছিলাম তা হলে পরাজিত শত্রুদের আবার নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা এবং এমন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলাম যারা আমাদের মৌলিক মূল্যবোধগুলো পোষণ করত এবং সেই সব মূল্যবোধ রক্ষায় আমাদের মিত্রে পরিণত হয়েছিল। প্যাক্স আমেরিকান (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন নেতৃত্বে উত্তর গোলার্ধের বৃহৎ শক্তিবর্গকে বোঝানো হয়) ছিল এক ধরনের সাম্রাজ্য; নিঃসন্দেহে আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে ছিল সমশক্তিগুলোর মধ্যে অতিমাত্রায় প্রথম। তবে ঐতিহাসিক মানদ-ের বিচারে ওটা ছিল লক্ষণীয়ভাবে অবিপজ্জনক ধরনের সাম্রাজ্য। শক্তির পরিবর্তে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং শ্রদ্ধাবোধ এই সাম্রাজ্যকে একত্রে ধরে রেখেছিল। (প্রাচীন প্যাক্স রোমানার সঙ্গে এর প্রকৃতপক্ষে কিছু সাদৃশ্য টানা যেতে পারে। তবে সেটা হলো আরেক কাহিনী। ট্রাম্প বলেন যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিগুলো আমেরিকাকে এমন এক পিগি ব্যাংকে (অর্থাৎ টাকা পয়সা জমানোর এমন এক ঘরোয়া বৈঠক ব্যাংক সেটার আকৃতি দেখতে শূকরের মতো) পরিণত করেছে সেখান থেকে সবাই টাকাকড়ি লুটে নিচ্ছে। আপনারা সেই চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে দেখতে প্রলুব্ধবোধ করতে পারেন। তবে সেটা আর যা কিছুই হোক না কেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কাহিনী। বাণিজ্য চুক্তিগুলোর উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকাকে আরও সমৃদ্ধ করা (সেটা হয়েও ছিল)। তবে গোড়া থেকে সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ডলার ও সেন্টের ব্যাপার স্যাপার ছাড়াও আরও বেশি কিছু। বস্তুতপক্ষে আধুনিক বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাটি বহুলাংশে ছিল ফ্রাকলিন ডি রুজভেল্টের দীর্ঘকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ডেন হালের মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভাবিত অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায় গোষ্ঠীর পরিকল্পনাজাত নয়। হাল বিশ্বাস করতেন যে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সমৃদ্ধ বাণিজ্য ‘স্থায়ী শান্তি’ গড়ে তোলার এক অপরিহার্য শর্ত। সুতরাং আপনারা ভাবতে চাইতে পারেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ চুক্তি সৃষ্টিটা ছিল সেই এক স্ট্র্যাটেজির অংশÑ যা থেকে মোটামুটিভাবে একই সময় মার্শাল পরিকল্পনার আবির্ভাব ঘটেছিল এবং ন্যাটো গঠিত হয়েছিল। কাজেই এখন সবকিছু ঘটছে সবই একটি অংশ থেকে উদ্ভূত। সীমান্তে নৃশংসতা চালানো, অভ্যন্তরীণ আইনের শাসনকে আক্রমণ করা, গণতান্ত্রিক নেতাদের অপমান করা ও গু-া-বদমাইশদের প্রশংসা করা এবং বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করা এসব কিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে আমেরিকার কৈবল্যের অবসান ঘটানো এবং যেসব আদর্শের কারণে আমরা অন্যান্য শক্তিশালী জাতি থেকে ভিন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়েছিলাম সেই আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। আর আমাদের এই আদর্শবলীকে প্রত্যাখ্যানকালে যে আমরা শক্তিশালী হব তা নয়, বরং এতে আমরা দুর্বল হয়ে যাব। আমরা ছিলাম, মুক্ত বিশ্বের নেতা, এক নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি। এখন আমরা এসব কিছুই ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি। তার চেয়েও বড় কথা এতে আমাদের নিজেদের স্বার্থেরও কোন সিদ্ধি হবে না। ৭০ বছর আগে আমেরিকা সে রকম প্রভাবশালী শক্তি ছিল এখন তার কাছাকাছি নেই। ট্রাম্প যদি মনে করে থাকেন যে তার হুমকির মুখে অন্যান্য দেশ পিছু হটবে তা হলে সেটা হবে বিভ্রম। আর আমরা যদি এক পুরোদস্তুর বাণিজ্য যুদ্ধের দিকে ধাবমান হই এবং যে সম্ভাবনাটি ক্রমশই বাড়ছে বলে আমার মনে হয় তা হলে তিনি এবং যারা তাকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে তারা এই যুদ্ধের পরিণতি দেখে দারুণ ধাক্কা খাবেন কিছু শিল্প লাভবান হবে, তবে লাখ লাখ শ্রমিক হবে কর্মচ্যুত। কাজেই ট্রাম্প আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলছেন না। বরং যে বিষয়গুলো আমাদের মহান করেছিল সেগুলোকে তিনি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছেন। আমাদের পরিণত করছেন স্রেফ আরেক মস্তান যার তর্জন গর্জন যতটা কাজে দেবে বলে তিনি ভাবছেন তার তেমন কিছুই হবে না। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×