ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরেজমিন গাজীপুর

ভোটারদের ঢল, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৭ জুন ২০১৮

ভোটারদের ঢল, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্মরণকালের সবচেয়ে আনন্দঘন পরিবেশে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো ভোট গ্রহণ। ভোটাররা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে আনন্দের সঙ্গে ভোট দিয়েছেন। সকাল আটটায় ভোট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায় কেন্দ্রগুলোতে। ভোটারদের চাপে অনেক কেন্দ্রকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটারদের চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, কর্তৃপক্ষকে থেমে থেমে ভোট নিতে হয়েছে। পাঁচটি কেন্দ্রে ভোটারদের চাপের কারণে ভোটগ্রহণ সাময়িকভাবে কয়েক মিনিটের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। সকালে নারী আর নতুন ভোটাদের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি। পুরুষ ভোটারদের উপস্থিতি থাকলেও, অতটা ছিল না। দুপুর গড়িয়ে বেলা দুইটা-আড়াইটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ভোটকেন্দ্রগুলোতে যেন পুরুষ ভোটারদের ঢল নামে। এমন স্বচ্ছ, ঝামেলাহীন, আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাহীন ভোট ইতোপূর্বে গাজীপুরবাসী কোনদিনই দেখেননি। কোন কেন্দ্রেই বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দু একটি কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোতে ভোট গণনা চলছিল। পরে তা জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে আনা হবে। সব কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষ হওয়ার পর জেলা নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে নির্বাচিতদের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। মঙ্গলবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র ঘুরে মিলছে এমন চিত্র। সকাল দশটার দিকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের নীলেরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা প্রচ- রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন ৮৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা হনুফা বেগম। তিনি বলছিলেন, ভোটার হওয়ার পর এমন সুন্দর ভোট আর দেখিনি, ভোট দিতেও পারিনি। আজ কোন ঝামেলা নেই। কেউ তাকে ভোট কেন্দ্রে আসার জন্য বা না যাওয়ার জন্য চাপও দেয়নি। বাড়ির কাছেই ভোট কেন্দ্র তাই ভোট দিতে এসেছি। আর যদি বেঁচে না থাকি, আর যদি কোনদিন ভোট দিতে না পারি এ জন্য ভোটটি দিয়ে গেলাম। পরে পুলিশের সহায়তায় তিনি প্রচ- রোদ থেকে বাঁচতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে ভোট দেন। স্কুল কেন্দ্রটিতে পাঁচটি লাইনে নারী আর নতুন ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রচ- রোদে দাঁড়িয়ে তারা সুশৃঙ্খলভাবে ভোট দিচ্ছেন। কোন হাঙ্গামা নেই। বাইরে বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও র‌্যাব পাহারা দিচ্ছেন। তারা ভোটারদের ভোট দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করছেন। কোন দাঙ্গা হাঙ্গামার বালাই নেই। ভোটাররা বলছিলেন, এত সুন্দর ভোট আর কোনদিনই তারা দেখেননি। তারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের প্রশংসা করে বলেন, আমরা যোগ্য লোককে ভোট দিয়েছি। ভোট দেয়ার জন্য কোন চাপাচাপি নেই। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিচ্ছেন। কোন প্রকার ভয়, অজানা আতঙ্ক বা আশঙ্কা নেই। কেন্দ্রটিতে দায়িত্বরত নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রটিতে ভোটারের সংখ্যা ২২শ’। সকাল দশটা নাগাদ প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট হয়েছে। যার অধিকাংশ নারী ও নতুন ভোটার। সেখানকার নারী ভোটাররা জানান, সকালে পুরুষ ভোটাররাও অনেকেই এসেছিলেন। তারা ভোট দিয়েই কাজে চলে গেছেন। পুরুষ ভোটারদের অনেকেই কাজ সেরে তারা বাড়ি ফেরার পর আসবেন। দুপুর বারোটার দিকে একই ওয়ার্ডের কানাইয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গিয়েও দেখা গেছে এমন চিত্র। সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন আনুমানিক ৫৬ বছর বয়সী নারী মরিয়ম বেগম। কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, অত্যন্ত সুন্দর ভোট হচ্ছে। কোন ঝামেলা নেই। সেখানে ভোটারদের রোদে দাঁড়িয়ে যাতে কষ্ট করে ভোট দিতে না হয় এ জন্য, স্থানীয়রা সবাই মিলে নিজ উদ্যোগে সেখান কাপড়ের ছাউনি তৈরি করেছেন। আমরা উন্নয়ন চাই। তাই সরকার দলের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছি। অতীতে আমরা ভুল করেছি। এবার আর সেই ভুল করতে চাই না। সরকার দলের প্রার্থীকে জেতানো ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই আমরা গাজীপুর সিটির উন্নয়ন চাই। সরকার দলের মেয়র দেখতে চাই। সকাল থেকেই কেন্দ্রটি ভোটারের উপস্থিতি ছিল অনেক। এরপর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ইসালী কেন্দ্রে গিয়েও দেখা গেছে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। ভোটাররা স্বেচ্ছায় তাদের ভোট প্রয়োগ করছেন। ভারারুল, বাড়িয়ালী, কোণাবাড়ী, চান্দনা, দত্তপাড়া, শিমুলতলী, বাংলাবাজারসহ কাশিমপুরসহ প্রায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের চিত্র একই। ভোটাররা এমন শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠিত করার জন্য সরকারকে রীতিমতো ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাদের আশা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই ধরনের শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোটকে কেন্দ্র করে গাজীপুর হয়ে উঠেছিল উৎসবের নগরী। দোকানিরা স্বেচ্ছায় দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন। তারা সেজেগুজে সবাইকে নিয়ে ভোট দিতে গেছেন। তাদের কাউকে কাউকে হেঁটে, রিক্সায়, অটোতে করে ভোট কেন্দ্রে যেতে দেখা গেছে। কারও চোখে মুখে কোন আতঙ্কের ছাপ ছিল না। তারপরেও স্বাধীনতাবিরোধীরা ভোটকেন্দ্রে নানা গুজবের খবর ছড়িয়ে প্রপাগা-া করার চেষ্টা করেছে। কোন কোন কেন্দ্রে গোলাগুলি হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে। সরেজমিনে সেসব জায়গায় গিয়ে গোলাগুলি তো দূরের কথা একটি ককটেল ফাটানোর ঘটনাও ঘটেনি বলে জানা গেছে। কয়েকটি ভোট কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সামান্য ধস্তাধস্তির ঘটনাকেই পুঁজি করে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে মোটরখাল ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে গেছে বলে প্রপাগা-া ছড়ানো হয়। বিষয়টি সর্ম্পকে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, সকালেই অতিরিক্ত ভোটার ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে যায়। অতিরিক্ত ভোটারের কাজে স্বাভাবিক কারণে চাপ পড়ে। ভোটগ্রহণের গতি কমে যায়। কারণ মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যালট পেপার সরবরাহ, ভোটারের পরিচয় নিশ্চিতসহ আনুসঙ্গিক কাজ করতে সময় লাগে। ভোটগ্রহণের গতি কমাকেই ভোট বন্ধ হয়ে গেছে বলে প্রপাগা-া ছড়ানো হয়। প্রকৃতপক্ষে এর কিছুই হয়নি। একপর্যায়ে অত্যধিক ভোটারের চাপের কারণে যারা ভেতরে প্রবেশ করেছেন, তাদের ভোটদান প্রক্রিয়া শেষ করে অন্যদের ডাকার জন্য কয়েক মিনিট স্থগিত রাখা হয়। এটিকেই ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়। পুরো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকা ছিল কঠোর নজরদারি আর কড়া নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৬ হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত ছাড়াও বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। অতিরিক্ত নিরাপত্তায় মানুষ আতঙ্কিত হয়নি বরং আশ^স্ত হয়েছেন। যা ছিল সত্যিই হতবাক করার মতো। গাজীপুরবাসী বিশ^াসই করতে পারছেন না, এমন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তারা অজানা আশঙ্কায় ভুগছিলেন। সব আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেছে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায়। গাজীপুরবাসীর প্রত্যাশা তারা এমন একজন মেয়র পাবেন যিনি গাজীপুর সিটির যানজট নিরসন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা দূর করবেন। সেই সঙ্গে বহু দিন ধরে বাসা বেঁধে থাকা সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ ও মাদকের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেবেন। দুই মেয়র প্রার্থী যেখানে ভোট দিলেন ॥ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মনোনীত প্রার্থী এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম মঙ্গলবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইয়াই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ভোট দেন। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার সকালে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের টঙ্গীর বশির উদ্দিন উদয়ন একাডেমি কেন্দ্রে ভোট দেন। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৩১ মার্চ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ১৫ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে হাইকোর্ট গত ৬ মে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিতের আদেশ দেয়। হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে আপীল করেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থী এবং নির্বাচন কমিশন। উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে ২৬ জুন নির্বাচন করার আদেশ দেয়। গাজীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ তারিফুজ্জামান জানান, নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। যার মধ্যে ছয়জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনীত এবং একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। ৫৭টি ওয়ার্ডের সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৫৪ জন এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে ৮৪ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। একটি ওয়ার্ডে সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে একজন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৫ জন এবং নারী ভোটার ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১ জন। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মোট আয়তন ৩২৯ দশমিক ৫৩ বর্গ কিলোমিটার। ভোটকেন্দ্র ৪২৫টি। ৩৩৭টি গুরুত্বপূর্ণ। বাকি ৮৮টি সাধারণ। গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ জানান, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোন কেন্দ্রে বড় ধরনের কোন ঝামেলা হয়নি। দু একটি কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটেছে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী যেকোন ধরনের পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছেন। বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
×