ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চরমপত্রের মুকুল

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৭ জুন ২০১৮

চরমপত্রের মুকুল

আজও বাংলার সবুজ প্রকৃতির মাঝে মুকুলের খেলা করে। এখন বাংলার মধুমাস সঙ্গেই ২৬ জুন ছিল এমআর আখতার মুকুলের চলে যাওয়ার দিন। দিনে দিনে ইতিহাসের অধ্যায়ে ধুলা পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক মনে করে এতদিন আমার অতৃপ্ত হৃদয়ের মাঝে অব্যক্ত কান্না চেপে রেখেছিলাম। কারণ অনেক সময় নতুন প্রজন্মদের ‘মুকুলের চরমপত্র’ ও ‘চরমপত্রের মুকুল’কে পরিচিত করতে গিয়ে ওদের না শোনা না জানা না বোঝা অবাক করা চোখ দেখে বলতে হতো ‘ঙহপব ঁঢ়ড়হ ধ ঃরসব রহ ১৯৭১.....’ তবে আজ চরমপত্রে মুকুলের ১৪তম শাহাদত দিবসে জানতে চাই ওপারে চলে গেলেও এম আর আখতার মুকুল তুমি আজও জেগে আছ বাংলাদেশের হৃদয়ে। ‘১৯৭১’ না দেখলেও নতুন প্রজন্ম চরমপত্র শুনতে চায় চরমপত্র জানতে চায় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। এই তো হঠাৎ করে গত মে মাসের ২৭ তারিখে ফেসবুকের পাতায় ‘গেরিলা ১৯৭১’-এ এম আর আখতার মুকুলের ছবিসহ তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘চরমপত্র’ সম্বন্ধে কিছু লেখা ও সঙ্গে বেশকিছু মন্তব্য চোখে পড়ল। ২০১৮ এসে ‘গেরিলা ১৯৭১’ এর এক অতি চমকিত প্রকাশ তাই আশ্চর্যান্বিত আমরা-আনন্দিত সারাদেশ। এর পাতায় পাতায় চরমপত্র ও মুকুলের নানা অজানা তথ্য যা সত্যি অতুলনীয়। এত, কত, শত কথার মালায় সাজিয়ে দিয়েছে তারা মোস্তফা রওশন আখতার মুকুলকে যিনি বিজয় দেখেছেন-স্বাধীনতা এনেছেন। আসলে এম আর আখতার মুকুল নিজেই ছিলেন চরমপত্র, ৯ মাসের প্রতিদিনের প্রতিটি চরমপত্রের মাঝে তিনি ছবি এঁকেছেন অনেকের। শুধু তাই নয় গলার ভাঁজে সুরে তিনি সেই চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতেন। তাহলে কি আখতার মুকুল ছিলেন চিত্রকর ও অভিনেতা? মাত্র সাড়ে ৪ মিনিটের মাঝে তিনি এক লেখক-পাঠক-কবি-গায়ক-চিত্রকর-অভিনেতা-এক শব্দ সৈনিক। হ্যাঁ, একজন সৎ ও সাহসী আখতার মুকুল তাঁর জনসংযোগের সঙ্গে এতগুলো গুণাবলী রপ্ত করেই হয়ে উঠেছিলেন ‘জ্যাক অব অলট্রেড’ জার্নালিজম ও কমিউনিকেশনের ব্যাপ্তিকে তিনি নিয়ে গেলেন অনেক উপরে। শুধু সাহিত্য সৃষ্টি নয় থাকতে হবে লেখার মেজিক্যাল ক্ষমতা অর্থাৎ কলমের জোরের সঙ্গে থাকতে হবে কথার পটু বাগ্মিতা ও পড়াশোনা এসব কটাতেই মুকুল ছিলেন অতুলনীয়। তাই অতি সহজেই সাংবাদিকতাকে তুলে দিলেন জাতীয় পর্যায়ে। ভাষা সৈনিক মুকুল, কলামিস্ট লেখক, সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা, কূটনৈতিক, একুশে পদক ভূষিত অকুতোভয় সাহসী দুর্ধর্ষ সাংবাদিক যিনি সাংবাদিকতায় দেশের সর্বোচ্চ পদক ‘স্বাধীনতাপদক’ লাভ করেছেন দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তির অধিকারী এ ধরনের একজন অসীম গুণাবলী আখতার মুকুলের জীবনের নানা দিক দিয়ে ‘গেরিলা ১৯৭১’-এর অপূর্বসৃষ্টি। ’৭১-এ অবরুদ্ধ বাংলায় বালিসের নিচে লুকিয়ে কান পেতে রেডিওতে ‘চরমপত্র’ শোনার সেই স্মৃতি জাগানিয়া শিহরিত দিনগুলো আজও বাংলার মানুষকে পুলকিত করে তোলে। এক অবাক করা দেশপ্রেমের ঝলক তখন তাঁদের চোখে মুখে জ্বলে ওঠে। বার বার করে আজ ওরা শুনতে চায় আখতার মুকুলের নিজ কণ্ঠের কি সেই শ্লোনক্তি, ব্যঙ্গার্থ ও রসালো উপস্থাপনা-জানতে চায় আমাদের গর্বের জয়গাথা মুক্তিযুদ্ধের নানা অজানা ইতিহাস। তাই ‘গেরিলা ১৯৭১’ এর পাতায় পাতায় বর্তমান প্রজন্মের কত শত লেখা ও মন্তব্য- যা থেকে বেছে নিয়ে মাত্র কয়েকটি উদ্বৃতি দৈনিক জনকণ্ঠের প্রিয় পাঠকদের আজ ২৬ জুন চরমপত্রের যাওয়া দিনে জানতে চাই। ১. ‘গেরিলা ১৯৭১’-লেখা ’৭১-এর অবর্ণনীয় কষ্টকর দুঃসময়ে ‘চরমপত্র’ দেশবাসীকে আশাবাদী করেছিল। ‘বর্ষা আগত সারাদেশ জলমগ্ন হবে, পকিরা সাঁতার জানে না। বিচ্চুরা শুধু ওদের স্পিডবোর্ড ফুটো করে দেবেÑ তারপরই কেল্লাফতে। শত শত পাকিস্তানী অমানুষ ডুবে মারা পড়বে’- চরমপত্রের এ রকম কন্দকাহিনী ও হতাশার মাঝেও নিয়ে আসত সাহস আশার আলো। মনে হতো যুদ্ধ জয়ের বুঝি আর দেরি নেই। ২. ‘আখতার মুকুল যুদ্ধকালীন স্বাধীন বেতার কেন্দ্রের স্মরণীয় ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের যে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছেন তা আজও আমাদের হৃদয়ে প্রেথিত হয়ে রয়েছে এবং যা প্রজন্ম প্রজন্ম ভুলে যাবার মতো নয়। মুক্তিবাহিনী বিচ্চুগর ক্যাচ কামাইয়ের চোটে খান সেনাদের মাজা ভেঙ্গে গেছে। ৩. হায় বাঙালী ভুলে গেল কি সেই সব দুর্দান্ত, কঠিন ও রক্তাক্ত দিনগুলোর কথা। ৪. একজন অদ্বিতীয় সাংবাদিক ছিলেন তিনি যাঁর অবদান দেশের স্বাধীনতাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। ৫. সেই কথা বলার স্টাইল যা না শুনলে বোঝা যাবে না আর ওই উত্তেজনাপূর্ণ রাতগুলোতে তা শোনার শিহরণ, আনন্দ ও বেদন আলাদা এক অনুভূতি। ৬. ভাবতে ভাললাগে এই মহান মানুষ আমাদের বগুড়ার। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতিদিন তার চরমপত্র না শুনলে আমরা ঘুমাতে পারতাম না। গর্বিত বগুড়াবাসী লাল সালাম। ৭. এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের আমলে এই মহান নায়কের অমর কথাগুলো যদি প্রচারিত হতো তবে নতুন প্রজন্ম তা জানতে পারত। ৮. চরমপত্র তুলনা রহিত। অসাধারণ প্রতিভাধারী ছিলেন তিনি। আজ ৪৭ বছর পরও প্রমাণ হয় কি দেশপ্রেমিক, অসাধারণ প্রকাশভঙ্গি নিয়ে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করে গেছেন। ৯. এম আর আখতার মুকুলের জন্য দুই হাত তুলে বলি পরম করুনাময় আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে জায়গা দেন। ওনার চরমপত্র রণাঙ্গনের মুক্তিসেনাদের অনেক সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছিল। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে তাঁর মৃত্যু হবে না। চিরদিন বাঙালীর হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন তিনি-জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু। ১০. ভাল থাকুন ওপারে-মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুন। ১১. কোন বাঙালীই তাঁর অবদান ভুলতে পারবে নাÑ আবারও বিনম্র শ্রদ্ধা। ১২. যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন বাংলার মানুষ চরমপত্রের মুকুলকে বুকে ধারণ করবে- সত্যি তিনি দেশে সম্পদ-স্যালুট। ১৩. গভীর শ্রদ্ধা-আন্তরিক ভালবাসা-বিনম্র শ্রদ্ধা-মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক ও কথা সৈনিক-শত শত সালাম তোমাকে শত সালাম ‘গেরিলা-১৯৭১’ কে হাজারো সালাম তোমাকে মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ‘গেরিলা ১৯৭১’ এর পাতায় নতুন প্রজন্মের লেখা বেশকিছু অনুরোধ থেকে কয়েকটি না জানিয়ে পারলাম না- ক. ১৯৭১ সালের চরমপত্র আমাদের প্রেরণার উৎস ও বেঁচে থাকার অদম্য শক্তি- তাঁর জীবনের এই অসামান্য পরিচয়টুকু বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। খ. চরমপত্রগুলো আমাদের স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে প্রচার করা হলে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে অনুপ্রাণিত হবে। গ. চরমপত্রের সেই রেকর্ডগুলো এখন টিভিতে দেখানো এবং ইউটিউবে আপলোড করার জন্য অনুরোধ করছি। সরকারীভাবে কিছু করার জোর দাবি জানাচ্ছি। ঘ. ১৯৭১ সালে স্বাধীনবাংলা বেতার থেকে যে তারিখে ‘চরমপত্র’ প্রচার হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতায় ১ম পর্ব থেকে শেষ পর্যন্ত ‘চরমপত্র’-প্রচার করার জন্য যে কোন টিভি চ্যানেল যেমন- বিটিভি, চ্যানেলআই, এসএ, গাজী, যমুনা, মোহনা ও অন্যান্য চ্যানেল থেকে প্রচার করার জন্য অনুরোধ করছি। ঙ. আরও অনেক শ্রদ্ধা অশেষ ভালবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধা, লাল সালাম, সত্যিই তিনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ২৬ জুন তিনি শারীরিকভাবে চলে গেলেও চেতনায় আখতার মুকুল এখনও আছে ও থাকবেন চিরকাল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর বিশাল অবদান যতদিন আলোকিত হবে ততদিন আলোকিত করবে আগামীর প্রজন্মকে।
×