ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গাজীপুরের নির্বাচনে দেশের ভবিষ্যত প্রতিভাত হবে

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৭ জুন ২০১৮

গাজীপুরের নির্বাচনে দেশের ভবিষ্যত প্রতিভাত হবে

গতকাল (২৬ জুন মঙ্গলবার) গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের বিলম্বিত নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমার এই লেখাটি যখন সুহৃদয় পাঠকেরা পড়বেন, তখন নির্বাচনের ফল হয়তো তারা জেনে গেছেন। আমার এখনও জানা হয়নি। যতটুকু জেনেছি, ৪২৫টি কেন্দ্রে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হয়েছে। নয়টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই হবে। যদিও মেয়র পদপ্রার্থী সাতজন। লড়াইটা হয়েছে দু’জনের মধ্যে। একজন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। অন্যজন বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দীন সরকার। জাহাঙ্গীর আলমের বয়স ৩৯ বছর। তিনি তরুণ রাজনীতিক। হাসান উদ্দীন সরকারের বয়স ৭০ বছর। তিনি প্রবীণ রাজনীতিক। এই লড়াই তাই বার্ধক্য ও তারুণ্যের মধ্যে হয়েছে বলা চলে। তারুণ্যের চোখ ভবিষ্যতের দিকে। বার্ধক্যের দৃষ্টি অতীতমুখী। আমার বিশ্বাস, গাজীপুরের মানুষ উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার দিকেই রায় দিয়েছেন, বার্ধক্যময় অতীতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে পরবর্তী বরিশাল, সিলেট, রাজশাহীর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে- এমনকি পাঁচ মাস পরের সাধারণ নির্বাচনেও তার কল্যাণকর প্রভাব পড়বে। দেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যত নিশ্চিত হবে। অন্যথায় দেশ যদি আবার স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার অতীতে ফিরে যায়, তা হবে দেশের জন্য ভয়ঙ্কর। গাজীপুরে যখন নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, তখন আশা করা যায় পরবর্তী তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনেও হিংসাত্মক কোন ঘটনা ঘটবে না। নির্বাচনে তখনই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে, যখন কোন পক্ষ উত্তেজনা ছড়ায়। এবার গাজীপুর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী প্রবীণ রাজনীতিক হয়েও হিংসাত্মক কথা বলেছেন এবং উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। পুলিশী হয়রানির অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, এই হয়রানি বন্ধ না হলে তিনি এমন কর্ম করবেন, যাতে সারাবিশ্বে তাক লেগে যাবে। তার দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ হুমকি দিয়েছেন ‘খুলনার কায়দায় গাজীপুরের নির্বাচন করতে চাইলে তার ভয়াবহ পরিণতি ঘটবে।’ হাসান উদ্দীন সরকার এবং মওদুদ আহমদ দু’জনের হুমকি শুনেই আমার আশঙ্কা হয়, এই নির্বাচনে যদি জাহাঙ্গীর আলম সুষ্ঠু ও স্বাভাবিকভাবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাহলেও বিএনপি নির্বাচনে সরকারী দল কারচুপি করেছে এই অভিযোগ তুলে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় নামার চেষ্টা করতে পারে। তবে তাতে তারা সফল হবেন মনে হয় না। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে এবং পরেও তারা দেশে ‘বিশ্বকে তাক লাগানো’ সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন। তা পুলিশী এ্যাকশনেই দমিত হয়েছে। সাধারণ মানুষকে তা প্রতিহত করার জন্য মাঠে নামতে হয়নি। দেখা যাক, গাজীপুরের নির্বাচনে কি হয়েছে? হয়েছে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের, না অন্ধকার অতীতের জয়? আগেই বলেছি, এই নির্বাচনের একটা প্রভাব পড়বে আসন্ন আরও তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ওপর। এমনকি পাঁচ মাস পরের সাধারণ নির্বাচনেও এর প্রভাব বর্তাতে পারে। এজন্য সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে কয়েকটি ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় ও নির্বাচনকালে যাতে কোনভাবেই অশান্তি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টির সুযোগ কোন পক্ষ না পায়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে অবশ্যই এই ব্যাপারে সংযত রাখতে হবে। এমন প্রমাণ দেখাতে হবে যে, ভোটকেন্দ্রে কোন প্রকার অসাধুতা প্রশ্রয় পায়নি। জনগণ যেন বিশ্বাস করে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এটা নিশ্চিত করা গেলে বিএনপি তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী নির্বাচন স্বচ্ছ ও অবাধ হয়নি বলে যতই চিৎকার করুক সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করবে না এবং বিশ্ববাসীও তাতে কান দেবে না। মওদুদ আহমদ এ কথা বলতে পারবেন না যে, “গাজীপুরের নির্বাচন’ ‘ফ্রি এ্যান্ড ফেয়ার’ না হওয়ায় আমরা আগামী নির্বাচনগুলো বর্জন করব।” তবে বিএনপি যতই হুমকি দিক, শেষ পর্যন্ত তারা সাধারণ নির্বাচন বর্জন করবে, আমার তা মনে হয় না। এবারেও নির্বাচন বর্জন করলে তাদের অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী নির্বাচনমুখী। তারা বিদ্রোহী হবে। সুদূর লন্ডনে বসে তারেক রহমান স্বদেশে তার দুই নন্দী ভৃঙ্গি দ্বারা এ বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। বেগম জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এই হুমকি যদি সত্য হতো তাহলে তারা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনেও আসত না। নির্বাচনে না আসার ব্যাপারে তারা জনমত এবং তাদের দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের মতামতও খতিয়ে দেখেছেন। এই মতামত নির্বাচন বর্জনের পক্ষে নয়, তা তারা বুঝতে পারেন। বহির্বিশ্বেও এই ব্যাপারে তারা সমর্থন পাননি। সম্প্রতি তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির তিন সদস্যের এক প্রতিনিধি দল গিয়েছিলেন ভারতে। ভারতীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তিদান এবং বিএনপির পছন্দ অনুযায়ী সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মোদি সরকার যাতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ দেন এবং তার বিনিময়ে বিএনপি আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে ভারতকে কি বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেবে তা নিয়ে গোপন আলাপ আলোচনাই ছিল এই সফরের উদ্দেশ্য। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। মওদুদ বলেছেন, গাজীপুর নির্বাচনের ফল দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন তারা বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে যাবেন কি-না? অর্থাৎ গাজীপুরে হারলে তারা ওই তিনটি সিটি নির্বাচন করবেন না। আমার ধারণা, এটা হুমকি। সাধারণ নির্বাচন সংক্রান্ত দরকষাকষির লক্ষ্যে তারা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন বর্জন করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ নির্বাচন তারা বর্জন করবেন না। সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিলে তারা যদি পরাজিত হন, তাহলেও দলের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। এমনকি পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হওয়ার আশা থাকবে। নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের অস্তিত্ব থাকবে না। এটা মওদুদ সাহেবরা জানেন। আমি ধরে নিচ্ছি, গাজীপুরে জাহাঙ্গীর আলমের জয় হয়েছে। যদি হয়ে থাকে, তাহলেও বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের কমপ্লাসেন্ট হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরিশাল ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের অবস্থান খুব সবল নয়। রাজশাহীতে জামায়াতের ঘাঁটি শক্ত। সুতরাং তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মাটি কামড়ে যুদ্ধ করতে হবে এবং এই যুদ্ধজয়ের উপর সাধারণ নির্বাচনে আবার দেশ শাসনে জনগণের ম্যান্ডেট লাভ নির্ভর করে। গাজীপুরে যদি আওয়ামী প্রার্থী জয়ী না হয়, তাহলেও আওয়ামী লীগকে হতাশ হলে চলবে না। দলের অনৈক্য, একশ্রেণীর মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানের দৌরাত্ম্যে দলের যে দুর্নাম হয়েছে, তা দূর করে নির্বাচকম-লীর কাছে আগামী নির্বাচনগুলোতে দলের স্বচ্ছ ইমেজ তুলে ধরতে হবে। যোগ্য, সৎ ও জনগণের পছন্দমতো প্রার্থী মনোনীত করতে পারলে নির্বাচন জয় সম্পর্কে আওয়ামী লীগের শঙ্কা পোষণের কোন কারণ নেই। বিএনপির একমাত্র আশা, সরকার-বিরোধী নেগেটিভ এবং প্রোটেস্ট ভোট। এছাড়া বিএনপির শাসনামলে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোন নজির নেই। নজির আছে একতরফা লুটপাটের। আওয়ামী লীগ শাসনে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতির নজির থাকলেও দেশটির অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটানোর জন্য হাসিনা-সরকার বিশ্বময় প্রশংসিত। আওয়ামী লীগের সবচাইতে বড় দুর্বলতা, দেশ শাসনে তারা তাদের বড় বড় সাফল্যগুলো জনসমক্ষে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না। ফলে তাদের ছোট ছোট অসাফল্যগুলো প্রতিপক্ষ বড় করে তুলে ধরার সুযোগ নেয়। মন্ত্রী এবং এমপিরা যদি তাদের আচরণ বদলান তাহলেও দলের ভাবমূর্তি কালিমামুক্ত করতে পারবেন। আওয়ামী লীগের সবচাইতে বড় সম্পদ হাসিনা নেতৃত্ব। সম্প্রতি পাকিস্তানের টেলিভিশনে একটি টক শো দেখতে গিয়ে অবাক হয়েছি। ‘পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এক আলোচক বলেছেন, পাকিস্তানকে দুর্দশামুক্ত করতে হলে বাংলাদেশের শেখ হাসিনার মতো একজন নেতা চাই।’ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর পর এই নেতৃত্ব পেয়েও যদি নিজেদের চরিত্র বদলাতে না পারে তা হবে এই দলটির নিজের এবং দেশের জন্য মহা অকল্যাণকর। গাজীপুরের নির্বাচনের ফলাফলে অবশ্যই দেশের ভবিষ্যতের প্রতিভাস ধরা পড়বে। কামনা করি, এই প্রতিভাসে যেন দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের সাফল্য ও নিরাপত্তা ধরা পড়ে। অন্ধকার অতীতের মুখব্যাদান যেন ব্যর্থ হয়ে যায়। লন্ডন, ২৬ জুন, মঙ্গলবার ২০১৮
×