ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চিন্তায়-কাজে ব্যতিক্রম আদনান

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ২৬ জুন ২০১৮

চিন্তায়-কাজে ব্যতিক্রম আদনান

পড়াশোনা করতেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে, হঠাৎ একবার কুড়িগ্রাম যাবার সুযোগ হয় স্বেচ্ছাসেবী একটি দলের সঙ্গে। এরপর পাল্টে গেলেন পুরোপুরি, সব বাধা পেরিয়ে মোঃ আদনান হোসাইন তিনটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। বর্তমানে ‘ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান। প্রশংসিত তার কাজ দেশে এবং দেশের বাইরে। আজকে জানব তার গল্পগুলো। সাক্ষাতকার নিয়েছেন- বেনজির আবরার ডিপ্রজন্ম- প্রথম দিকের গল্প বলুন আদনান। আদনান হোসাইন- ২০০৯ এর অগাস্টে পড়তাম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেসের বিষয় মার্কেটিংয়ে। বাবা সৈয়দপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, বলা যায় সৈয়দপুর কেন্দ্রিক বড় নামী পরিবার আমাদের। ২০০৯ এর ডিসেম্বরেই ইস্ট ওয়েস্টে পড়ুয়া বড় ভাইয়ের বন্ধুরা যাবেন কুড়িগ্রামে একটি ‘উইন্টার ক্যাম্পেন’ করতে। বড় ভাইয়ের কাছে আবদার করলাম তাদের সঙ্গে যাওয়ার, আমার পরিবারের মনে সন্দেহ ছিল আমি পারব তো? গেলাম সাহস করে, সেখানে গিয়ে প্রথমবার বেশ কিছু ব্যাপার জানলাম। জানলাম কতটা অসহায় দেশের একটি বড় অংশ। বাসায় এসে বাবাকে বললাম, ‘ওদের জন্য কিছু করতে চাই।’ বাবা বললেন, ‘তোমার ওসব করা লাগবে না, তুমি পড়াশোনা করে ব্যবসা দেখো।’ খুব কষ্ট পেলেও দমে যায়নি আদনানের কাজ, ভাবলেন কি করা যায়। ২০১০ এর জানুয়ারিতে একজন ব্রিটিশ ভদ্রলোকের পার্সোনাল এ্যাসিসটেন্ট হিসেবে জয়েন করলাম, তার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করলাম। তিনি সাড়া দিয়ে বললেন, ‘তুমি উদ্যোগ নাও, পাশে থাকব।’ এরপর বন্ধু সৈয়দ ফজলে নিয়াজের কাছে বললাম, কি করি বলতো? নিয়াজ বললেন, তোর মানসিক শান্তির জন্য এখানেই আশপাশে কিছু কর। বিষয়টা পরিবারকে জানালাম। বাবা-মা খুব অবাক হচ্ছিলেন ছেলে বলে কি!! এসময়ই সবচেয়ে বড় সমর্থন দিলেন বড়বোন নিলুফার আক্তার, কানের কাছে বললেন, ‘ভাই, তুই সৈয়দপুরেই কর। আমি তোর সঙ্গে আছি।’ ডিপ্রজন্ম- স্বাভাবিক ছিল বাবার তখনকার আচরণ, এরপর কি হলো। আদনান হোসাইন- বড় আপুর সহযোগিতার আশ্বাস, পাশাপাশি সৈয়দপুরের মেডিক্যাল শিক্ষার্থী মনির সহযোগিতায় চলে গেলাম সৈয়দপুর। সেখানে আমাদের পারিবারিক পরিচিত আগেরই, একটি খ্রিস্টান বাড়ি পেলাম। মালিক বললেন, তোমরা বারান্দা ব্যবহার করতে পারবা। রুম বাকি দুটোতে আমাদের অনেক জিনিস, তাই তালাবদ্ধ থাকবে। হতাশ হলেও স্থানীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করে সেখানেই ২০১০ সালের জুনের ৪ তারিখ যাত্রা করলো ‘কাইটস একাডেমি’। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭ জন, সেখানে তারা পেলেন এক অভিভাবক। বর্তমানে স্কুলটির প্রধান শিক্ষিকা ইভা ম্যাম, যার সঙ্গে পরামর্শ করে চলছিল স্কুলটির নানাদিক। এত কিছু তো হলো, দরকার অর্থ। ভার্সিটির দুই সেমিস্টারের টাকা এনে বানালাম বাচ্চাদের ড্রেস, আইডি কার্ড আর বসার বেঞ্চ। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়ে গেল তিনমাসে ৪০ জন, ছয়মাস শেষে ১০০ তে। এরপর তো বারান্দায় আর হচ্ছে না, প্রতি বুধবারে ক্লাস করে সৈয়দপুর গিয়েছেন তখন, ছিলেন শনিবার পর্যন্ত। খ্রিস্টান পরিবারটি তখন একটি রুম ছেড়ে দিল শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়া দেখে। ডিপ্রজন্ম- আদনান, অসাধারণ। নামটা আসলো যেভাবে? আদনান হোসাইন- আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু নিয়াজকে জিজ্ঞেস করলাম কি নাম দেয়া যায় তাদের কার্যক্রমের। কথা বলতে বলতে বের হয়ে গেল ‘ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন’। এটার মানে সবকিছুতেই মানবতা। ডিপ্রজন্ম- আবার গল্পে ফিরে যাই আদনান। এরপর কি করলেন? আদনান হোসাইন- এ সময় আমি আবার কাজ করছিলাম বিবিসির একটি প্রজেক্টে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। হঠাৎ শিক্ষার্থী কমতে থাকল সৈয়দপুরে। আদনান ও তার দল জানতে লাগল কেন কমছে শিক্ষার্থী? স্থানীয়রা জানালেন, ‘যে সময়টাতে স্কুল, সে সময়টা কোন হোটেলে কাজ করলে টাকা পাবে তাদের বাচ্চারা। আবার একটি স্থানীয় এনজিও তাদের স্কুলে ক্লাস করলে টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করার কারণেই অভিভাবকরাও বিমুখ হচ্ছিলেন কাইটস একাডেমি থেকে।’ সম্পূর্ণ বিনামূল্যের এই স্কুলের বাচ্চাদের জন্য বিবিসির দু’জন কলিগের পরামর্শ মতো টিফিনের ব্যবস্থা করলেন তারা। আগ্রহ কিছুটা বাড়লেও আদতে অর্থের সমস্যা প্রচুর গ্রামটিতে। তখন আমরা বাচ্চাদের মায়েদের জন্য একটি প্রজেক্ট হাতে নিলাম। নাম ‘প্রজেক্ট প্রতিভা’। তাদের বললাম, ‘আপনাদের যদি আমরা সেলাইয়ের ট্রেনিং দেই এবং আপনাদের তৈরি পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করে দেই বাচ্চাদের আমাদের স্কুলে রাখবেন?’ মায়েরা কথা দিলেন, তারা স্বাবলম্বী হলে বাচ্চাদের পড়াশোনাতেই রাখবেন। শুরু হলো নতুন কার্যক্রম ‘প্রতিভা’। যার মাধ্যমে নারীদের ফ্রি প্রফেশনাল ক্রাফটিং ট্রেনিং করান, পাঁচজন নারী সেখানে প্রথম প্রশিক্ষণ নেন। তাদের কাজের মান ভাল হবার ফলে ফলাফলটাও ভাল হয়। দেখা গেল এই মায়েদের তৈরি পণ্য আমি ঢাকায় এনে বিভিন্ন ফেস্টের মাধ্যমে বিক্রয় করিয়ে তাদের ভাল লাভ দিতে পারছেন। হঠাৎ ভাবলাম, এটা থেকে উঠে আসতে পারে স্কুলের সব খরচও! যেই ভাবা সেই কাজ। প্রশিক্ষিত পাঁচজন নারীকে বললাম, ‘এখন সবাইকে শেখাবেন আপনারা।’ যেহেতু তারা তখন হাতে নিয়মিত অর্থ পাচ্ছেন, তারাও প্রস্তাবটা নিল। অন্য যারা প্রশিক্ষণ নেয়নি তারাও ভিড়তে লাগল এদিকে। বর্তমানে সৈয়দপুর ও টঙ্গী মিলিয়ে ২৫৫ জন নারী ট্রেনিং সমাপ্ত করে স্বাবলম্বী হয়েছেন আমাদের এই প্রজেক্টের মাধ্যমে। ডিপ্রজন্ম- স্কুলগুলোর বর্তমান অবস্থা যেমন চলছে আর আইএইচএফ কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে? আদনান হোসাইন- বর্তমানে সৈয়দপুর ছাড়াও টঙ্গী, পাটোয়ারী পাড়ায় রয়েছে আমাদের আরও দুটো স্কুল, সেগুলোও সম্পূর্ণ বিনা খরচে গরিব পরিবারের সবার জন্য উন্মুক্ত। খরচ মেটানোর জন্য ‘আমাদের স্টুডেন্ট স্পন্সরশিপ পোগ্রাম চলছে নিয়মিত, আমরা চ্যারিটি গালা নাইট করি যেখানে ২৫০০ টাকা করে টিকেট। ২০১৬ এবং ১৮ তে করেছি আমরা এটি, সর্বশেষ গালা নাইটে ইউএস এম্বাসেডর মার্শা বার্নিকাট স্বয়ং প্রধান অতিথি ছিলেন। এছাড়া হোটেল সেরিনার সহযোগিতায় আমরা ‘চ্যারিটি কফি মর্নিং’ করি আমরা। সবমিলিয়ে আমাদের চারপাশে ‘ফ্যামেলি ফ্রেন্ডস আর বিভিন্ন দেশের ভালমানুষ রয়েছেন’ এমনটাই বিশ্বাস আমার। এর ধারাবাহিকতায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে করেছি ‘সায়েন্স ফেয়ার’। কোনদিন সায়েন্স না বোঝা বাচ্চাগুলো চমকে দিয়েছিল তাদের ছোটছোট প্রজেক্ট দাঁড় করিয়ে। ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চিফ এ্যাডভাইজর স্টিভ উইলস, যিনি আরএনএলআই-এর হেড অফ ইন্টারন্যাশনাল পোগ্রাম। তার পরামর্শ পুরো ফাউন্ডেশনকে জমিয়ে রাখে। বর্তমানে রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসে ১৫ জন কর্মী নিয়ে চলছে আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি। ডিপ্রজন্ম- পরিবারের দেয়া বাধা উৎসাহে পরিণত হয়েছে কবে? সাফল্যের কথাগুলো যদি পাঠকদের জন্য জানাতেন। আদনান হোসাইন- হাহাহা। আসলে, ২০১৫ তে আমি মোস্ট প্রমিজিং সোশ্যাল এন্টারপ্রিনিয়রশীপ বাই জলকনা ক্যাটালিস্টের জন্য ইউএসএ থেকে মনোনীত হই, বলা যায় তখন প্রথম বাবা আমার কাজে অবাক হয়ে উৎসাহ দেয়া শুরু করেন। এরমধ্যেই আমি টেডএক্স বেইলি রোড, ওভার ৩০ গেস্ট স্পিকার, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম গেস্ট লেকচারার হিসেবে। স্টার্টাপ ইস্তাম্বুলের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবেও কাজ করেছি। ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে এগুলো করে আমি সত্যিকারে আনন্দ পাচ্ছি একাজগুলোতে এসে, বাচ্চাগুলোর হাসি আমার সবকিছুর অনুপ্রেরণা। আমি মনে করি এটা একটা লাইফস্টাইল যা সবাই ভাবতে পারে না নিজের জন্য। আমি গর্বিত আমার কাজগুলো নিয়ে। ডিপ্রজন্ম - আপনার জন্য রইলো অনেক শুভকামনা। আদনান হোসাইন- অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।
×