ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাসিক নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো মুখোমুখি দুই মেয়র প্রার্থী

সাজানো মাঠে লিটন আস্থা সঙ্কটে বুলবুল

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৬ জুন ২০১৮

সাজানো মাঠে লিটন আস্থা সঙ্কটে বুলবুল

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচন নিয়ে তৃতীয়বারের মতো মুখোমুখি হচ্ছেন এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। ইতোমধ্যে দুই নেতাই দুদল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। তারা মাঠেও নেমেছেন। এ ক্ষেত্রে এবার লিটনের মাঠ সাজানো থাকলেও নানা হতাশা ও আস্থার সঙ্কটে রয়েছেন বুলবুল। রাজশাহী নগর ও জেলা আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতাকর্মীরা এখন অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী। এই ঐক্যবদ্ধতাই আগামী সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে জয়ী করতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন নেতারা। ইতোমধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন যে কোন ধরনের অপপ্রচার রুখে খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষে কাজ করবে বলেও শপথ নিয়েছেন। দলের অভ্যন্তরে থাকা ছোটখাটো বিভেদও এখন দূর হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, আগামী ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে জয়ী করাটা রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রয়োজনেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই নির্বাচনে লিটন জিততে না পারলে রাজশাহীর উন্নয়নের চাকা সচল করা সম্ভব হবে না। রাজশাহী আরও পিছিয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া নিদের্শে খায়রুজ্জামান লিটনকে নির্বাচনে জয়যুক্ত করতে আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করেছে। এদিকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা রয়েছে। নেতাকর্মীদের ধারণা, আওয়ামী লীগের মধ্যে এই ঐক্য বজায় থাকলে লিটনকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করা সম্ভব। কারণ নগরবাসীর মধ্যে লিটনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। আর দ্বিতীয়ত লিটন নগরীর উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করার নজির রেখেছেন। এসব বিষয়কে প্রচারে নিয়েই কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এজন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, জাতীয় নেতা শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের ছেলে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে নিয়ে সংগঠনে কখনোই কোন বিরোধ ছিল না। তবে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে অন্যান্য নেতার সঙ্গে দলীয় অনেক নেতারই বিরোধ ছিল। অনেক নেতার সঙ্গে দূরত্ব এমন কী মুখ দেখাদেখিও বন্ধ ছিল। নেতাদের মধ্যে জেগে থাকা বিরোধগুলো এখন কমেছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় সংসদ ভবনে জেলার এমপি ও শীর্ষ নেতাদের বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী-১ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-২ সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সাংসদ শাহরিয়ার আলম, রাজশাহী-৫ আসনের সাংসদ কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা, রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ এনামুল হক, সংরক্ষিত আসনের এমপি আখতার জাহান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারসহ কয়েক শীর্ষ নেতা উপস্থিত ছিলেন। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, খায়রুজ্জামান লিটনের বিকল্প নেই বলেই তো কেউ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেননি। নেতাকর্মীদের তার প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাকেই দলীয় মেয়র প্রার্থী হিসেবে চেয়েছেন। নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, খায়রুজ্জামান লিটনকে সবার মতামত নিয়ে দলীয়ভাবে মনোনীত করা হয়েছে। ফলে এখানে বিভেদ থাকার কোন প্রশ্নই নেই। নেতাকর্মীরা তার জন্য উচ্ছ্বসিত হয়েই কাজ করছেন। অপদিকে এবার নেতায় নেতায় বিভেদ রয়েছে বিএনপিতে। রাজশাহী নগর ও জেলা বিএনপির একটি অংশ বুলবুলের প্রতি রয়েছে নারাজ। জানা যায়, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনুকে মেয়র প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। দলের তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে মিনুকে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে সম্মতি দেননি। সিটি মেয়র ও রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের ওপর আস্থা না থাকায় তাকে বাদ দিয়ে এবার মিনুকে প্রার্থী করার চেষ্টা করছিল বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। কিন্তু মিজানুর রহমান মিনু শেষ পর্যন্ত তাতে রাজি না হওয়ায় মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলই আবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। মিনুর ভাষ্য, ‘বুলবুল ছোট ভাই, সে বর্তমানে মেয়র আছে। ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হলেও ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এ অবস্থায় বুলবুলেরই মনোনয়ন পাওয়া উচিত। তবে মিনুর এ মন্তব্যে দ্বিমত রয়েছে নগর বিএনপির অনেক নেতার। তাদের দাবি, ‘মিজানুর রহমান মিনু মনে করছেন রাজশাহীতে এবার খুলনা সিটি নির্বাচনের মতো ফলাফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই তিনি ঝুঁকি নিতে চাননি। বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনের বিপক্ষে শক্ত প্রার্থী দেয়ার জন্য বিএনপিতে বেশ আগে থেকেই চেষ্টা চলছিল। এ ক্ষেত্রে বর্তমান মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের জনপ্রিয়তা যাচাই-বাছাইও করা হয়। মেয়র বুলবুল তার দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে কতটা সফল হয়েছেন কতটা ব্যর্থ এসব বিষয় বিশ্লেষণ করা হয়। সেইসঙ্গে মেয়রের দায়িত্ব পালনের সময় তার ব্যবহারে সাধারণ মানুষ বুলবুলের প্রতি খুশি নাকি নাখোশ এসব বিষয়ও দেখা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় বিভিন্ন পর্যায় থেকে এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে দলের হাই কমান্ড। সেইসঙ্গে বুলবুলই প্রার্থী থাকবেন নাকি বিকল্প কোনো প্রার্থীকে দিলে ভাল ফল আসবে এ নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণের পর দলের হাইকমান্ড বুলবুলের থেকে এই মুহূর্তে মিনুকেই শক্ত প্রার্থী হিসেবে মনে করে। মিনু দীর্ঘদিনের মেয়র এবং সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যে অবস্থান তৈরি করেছেন তাতে তিনিই ভাল ফল করবেন বলে মনে করে দলের হাইকমান্ড। সেইসঙ্গে দলের ভেতরে বর্তমানে যে বিভেদ তা বুলবুলের পক্ষে স্বাভাবিক করা যতটা কঠিন, মিনুর পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হবে। এছাড়াও বুলবুল প্রার্থী হলে নগর বিএনপির একটি বড় অংশ ভোটের মাঠে নিষ্ক্রিয় থাকবে। এ সব বিবেচনায় বুলবুলের বদলে মিনুকে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মিনু রাজি না হওয়ায় বুলবুলকেই মনোনয়ন দেয় বিএনপি। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপিতে মিনুকে পছন্দ করেন না এমন কয়েকজন নেতাও মত দেন মিনুকে মেয়র প্রার্থী করার পক্ষে। অনেকেই মনে করেন এই প্রস্তাব পেয়ে মিনু আনন্দিত হবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে সেই প্রস্তাবে অসম্মতি জানান মিজানুর রহমান মিনু। মিজানুর রহমান মিনু জানান, ‘আমি ১৭ বছর মেয়র থেকেছি আর এই পদে যেতে চাই না। আমি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। দলীয় মনোনয়ন পেলে সেই ভোট করব। বুলবুল ছোট ভাই, সে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হলেও ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়নি। আমার বিশ্বাস সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে বুলবুলের জন্য কাজ করবে এবং আবারও তাকে নির্বাচিত করবে। বুলবুলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ॥ দলীয় মনোনয়ন নিয়ে রাজশাহী ফিরেই নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন রাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। সোমবার দুপুরে তিনি নগরের পাচানি মাঠে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা খায়রুজ্জামান লিটনকে মিষ্টিমুখ করান। পরে ওই এলাকার সমর্থকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন খায়রুজ্জামান লিটন। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, নির্বাচন কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামী ২৮ জুন তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করবেন। তফসিল অনুযায়ী আগামী ১০ জুলাই থেকে প্রচার প্রচারণা শুরু করা হবে। এর আগ পর্যন্ত দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে জানান তিনি। এর আগে রবিবার খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নওশের আলী। ঢাকায় থাকার কারণে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার সময় নির্বাচন কার্যালয়ে যেতে পারেন নি লিটন। এদিকে সোমবার মেয়র প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের পক্ষে মনোনয়নপত্র উত্তোলন করা হয়েছে। দুপুরে রাজশাহী আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে এ মনোনয়নপত্র উত্তোলন করা হয়। মেয়র বুলবুলের পক্ষে মনোনয়নপত্র উত্তোলন করেন, বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট কামরুল মনির।
×