ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষা ও বিশ্বায়ন ॥ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৬ জুন ২০১৮

বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষা ও বিশ্বায়ন ॥ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ

বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। আর এই জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে সংগঠনটিকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছেন সেটি হলো আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন পুরনো ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেন’-এ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম দিয়ে সংগঠনটি জন্মলাভ করে। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। কৌশল এড়িয়ে সরাসরি অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ধারণ করল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম এবং অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে আমাদের সংস্কৃতির উপাদান নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। মনে রাখতে হবে, জাতিরাষ্ট্রের কাঠামো রাজনৈতিক কিন্তু ভিত্তিটা হলো সংস্কৃতিÑ যার সূত্রপাত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আলোচ্য নিবন্ধে আলোকপাত করতে চাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা, বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কী ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের ভেতরে-বাইরে সংস্কৃতিকে কীভাবে দেখছে আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার সংগ্রাম যে কোনো জাতির সংস্কৃতির মূল উপাদান হলো তার ভাষা। ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়া গেলে সে জাতি আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। প্রতিবাদের ভাষা থেকে যায় অজ্ঞাত। মূক ও বধির সম সে জাতিকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করা যায় সহজেই। পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা নির্ধারিত হবার আগেই যখন উর্দু ও ইংরেজিকে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ব্যবহার করা শুরু হলো, মূলত তখনই বাঙালিরও ঘুম ভাঙতে শুরু করে। আর এ ঘুম ভাঙাতে গিয়ে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় যুব সম্মেলন, আর ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে জন্ম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এ দুটি সংগঠন গড়ে তোলায় মূল ভূমিকা পালন করেন ছাত্র ও যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ‘বাংলা’র প্রস্তাব কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়। প্রতিবাদে ২ মার্চ শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এই সংগঠনের আহ্বানে ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় প্রথম সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১১ মার্চ ধর্মঘট সফল করতে গিয়ে যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৬৩ জন নেতাকর্মী কারারুদ্ধ হন। ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৮-দফা চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হলে কারাবন্দিরা মুক্তিলাভ করেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক সাধরণ ছাত্রসভায় ৮-দফার চুক্তিনামায় ৩টি সংশোধনী এনে তা বাস্তবায়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজীমুদ্দীনের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। উক্ত ছাত্রসভার সভাপতি এবং একমাত্র বক্তা ছিলেন আপসহীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের অনুসারীরা ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনস্থ ‘রোজ গার্ডেন’-এ এক প্রতিনিধি সম্মেলনে মিলিত হয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করেন। সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কারারুদ্ধ যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলীতে ‘মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভ’কে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনেও আওয়ামী লীগ এবং এর নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ছাত্র, যুব ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের এক সভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং এর সমমনা সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের দিক-নির্দেশনা এবং আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে বন্দী মুক্তির দাবিতে ‘আমরণ অনশন’ পালন ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূণ। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সকল কমিটি এবং দেশবাসীকে যথাযথ মর্যাদায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৯৫৩ সালে ১৪ ও ১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহের অলকা সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে ৪২ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশিত হয়। ইশতেহারের ৮ম দফায় ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’ এবং ১৬-দফায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় ছুটির দিবস ঘোষণা করা’র প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর অনেক আলাপ-আলোচনার পর হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্ট ঘোষিত ২১-দফায় ছিল ভাষা সংক্রান্ত ৩টি প্রস্তাব। ১নং দফায় বলা হয়েছে ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।’ ১৭নং দফায় বলা হয়- “বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যাঁহারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহিদ হইয়াছেন তাঁহাদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করা হইবে এবং তাহাদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে।” ১৮নং দফায় বলা হয়েছে- “২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ঘোষণা করিয়া উহাকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হইবে।” ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়। এরপর দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্পর্কে আর কোনো দ্বিধা থাকল না। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুর হকের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে ইতোপূর্বে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ‘বর্ধমান হাউজ’কে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এ সঙ্গে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন- ১. ড. কুদরাত-ই-খুদা ২. ড. কাজী মোতাহার হোসেন ৩. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ৪. ড. এনামুল হক ৫. খান বাহাদুর আব্দুর রহমান ও মুহম্মদ বরকতুল্লাহ, ডেপুটি সেক্রেটারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের এ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়নের পূর্বেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল সংবিধানের ৯২-ক ধারা প্রয়োগ করে ৩০ মে ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে কেন্দ্রের শাসন জারি করে। এর ফলে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার কাজও বন্ধ হয়ে যায়। ৩ জুন ১৯৫৫ কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রত্যাহার করে এবং ৬ জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের দ্বিতীয়বারের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার কাজ আবার শুরু হয়। ২৬ নভেম্বর ১৯৫৫ যুক্তফ্রন্ট সরকার ‘বাংলা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকার শিক্ষা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহম্মদ বরকতুল্লাহ-কে প্রস্তাবিত বাংলা একাডেমির স্পেশাল অফিসার নিয়োগ করেন এবং একই সাথে আরও ৯ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দান করা হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউজের বটতলায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। ড. মুহম্মদ এনামুল হক বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগ এবং ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যদি যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত না হতো, তবে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা কখনোই সম্ভব হতো না। শহিদ মিনার নির্মাণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাষা আন্দোলনে আত্মদানকারীদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে পূর্ববঙ্গ সরকারের পূর্তমন্ত্রী আবদুস সালাম খান ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে, শহিদ বরকতের নিহত হবার স্থানের পাশেই একটি শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থান বাছাই করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ দৈনিক সংবাদ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি আবদুল কাদের সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘নতুন খবর’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় পূর্ববঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি ও যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নির্ধারিত স্থানে শহিদ মিনার নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ঐ বছরেরই ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের শরিক দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সরকার পূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলী এ. জব্বারকে শহিদ মিনার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদান করে। এ সময় সরকার শহিদ মিনারের নকশা নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা ছিলেন গ্রিক স্থপতি ভক্সিয়াডেস, শিল্পী জয়নুল আবেদীন ও প্রধান প্রকৌশলী এ. জব্বার। কমিটি ইংল্যান্ড ফেরত শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশাকেই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করে। হামিদুর রহমানের এই নকশার ভিত্তিতেই ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করা হয় এবং ১৯৫৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শহিদ মিনারের ভিত, মঞ্চ এবং ৩টি স্তম্ভ নির্মাণের কাজ করা হয়। এ ছাড়াও শহিদ মিনারের জন্য হামিদুর রহমান এক হাজার বর্গফুটের একটি ‘মুর‌্যাল’ এবং শিল্পী নভেরা আহমেদের ৩টি ভাস্কর্যের কাজও ঐ সময়ে শেষ করেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগ সরকারকে হটিয়ে সামরিক শাসক ক্ষমতা দখল করলে আপাতত শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর লে. জেনারেল আজম খানের উদ্যোগে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা অনুযায়ী শহিদ মিনারের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত হয়। ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত এই শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন শহিদ বরকতের মাতা হাসিনা বেগম। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকারী ছাত্রদের দ্বারা বরকতের নিহত হবার স্থানে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ বা শহিদ মিনার নির্মিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলবেলা তা উদ্বোধন হওয়ার পর ঐদিনই নুরুল আমিন সরকার তা ভেঙ্গে ফেলে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসমূহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা তার যথাযোগ্য মর্যাদ পায়নি সরকারি-বেসরকারি কোন পর্যায়ে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। গণতান্ত্রিক বিধিবিধান অনুযায়ী তিনিই তখন পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। সে সময়ে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘একুশের স্মরণ সপ্তাহ’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন প্রসঙ্গে বলেন, “বুদ্ধিজীবীরা পরিভাষা দিন আর না দিন, আওয়ামী লীগ যেদিন রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করিবে সেই দিন হইতেই সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হইবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করিবো নাÑ তাহা হইলে সর্বক্ষেত্রে কোনোদিনই বাংলা চালু করা সম্ভব হইবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু ভুল হইবে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না।” [সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক ও সংবাদ, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১] চলবে... লেখক : সংস্কৃতি কর্মী
×