ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেটে স্বাস্থ্য খাত

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৬ জুন ২০১৮

বাজেটে স্বাস্থ্য খাত

গত ২ জুন ২০১৮ যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ ও মানসূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্থানের ওপরে এবং শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের নিচে। গবেষণায় যে ১৯৫টি দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩। ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১৪৫, ১৪৯ ও ১৫৪। তালিকায় শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের অবস্থান যথাক্রমে ৭১ ও ৭২। তালিকায় শীর্ষে আছে ইউরোপের দেশ আইসল্যান্ড। অন্যান্য আন্তর্জাতিক গবেষণায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার সাফল্যের কথা কমবেশি বলা হয়। বর্তমান স্বাস্থ্যসেবার এ অগ্রগতি অবশ্যই প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটের লক্ষ্য হচ্ছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুলভ মানসম্মত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করে একটি সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। প্রধান যে কার্যাবলীর জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয় সেগুলো হচ্ছে- ১) স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। ২) স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান এবং জনগণের প্রত্যাশিত সেবার পরিধি সম্প্রসারণ। ৩) স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সুবিধাসহ জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও প্রতিকার। ৪) মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন ও বিতরন এবং আমদানি ও রফতানিযোগ্য ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ। ৫) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা শিক্ষা, নার্সিং শিক্ষা, জাতীয় জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কার্যাবলী। ৬) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত স্থাপনা, সেবা ইনিস্টিটিউট ও কলেজ নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ। ৭) শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি এবং পুষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন। ৮) স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সকল স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট বরাদ্দের ৫.০৩ শতাংশ রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের জন্য, যা ২৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। গত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে মোট বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার ২৪ কোটি টাকা। ওই বরাদ্দ ছিল জাতীয় বাজেটের ৫.৩৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে এ বছর মোট বরাদ্দ ৩ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা বা ১৭ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে জাতীয় বাজেটের আকার ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশে বলা হয়েছে, একটি দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন থেকে দীর্ঘদিন ধরে বাজেটের ১০ শতাংশ দাবি করে আসছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাংলাদেশে ৩২ ডলার, ভারতে ৬১ ডলার, নেপালে ৩৯ ডলার, ভিয়েতনামে ১১১ ডলার, মালদ্বীপে ৭২০ ডলার, শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১০০০ ডলার। স্বাস্থ্য বাজেটের বাস্তবায়নের প্রধান সমস্যাগুলো হচ্ছে- ১। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এ বাজেট অপ্রতুল। ২। বাজেট যাই থাকুক এর ব্যয় প্রক্রিয়া খুবই দুর্বল (চড়ড়ৎ চবৎভড়ৎসধহপব ড়ভ ঁঃরষরংধঃরড়হ) ৩। বাজেট ছাড় প্রক্রিয়া কখনো কখনও বিলম্বিত হওয়ার ফলে বার্ষিক অর্থবছরের শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে অর্থ অপচয়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে চিকিৎসা খাতে খরচ হচ্ছে ৬৩ শতাংশ। ফলে প্রতিবছর প্রায় চল্লিশ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বিশ্বে গড়ে পকেট থেকে চিকিৎসা খরচের হার ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যুগোপযোগী নীতিমালা বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রতিবদ্ধতাগুলো- ১) অপর্যাপ্ত বাজেট ২) দুর্নীতি ৩) বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ হ্রাস ৪) আর্থিক জবাবদিহির অভাব ৫) সময়োপযোগী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির অভাব ৬) দক্ষ মানব সম্পদ স্বল্পতা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি ১০০০০ মানুষের জন্য প্রয়োজন ১০ জন চিকিৎসক এবং ৩০ জন নার্স। বর্তমানে বাংলাদেশে এর অবস্থান উল্টোÑ চিকিৎসক রয়েছে ৫.৫ জন এবং নার্স ২.১ জন। ইতোমধ্যে সরকার ১০ হাজার নার্স এবং ৯৭৯২ জন চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে। ৭) অপর্যাপ্ত ভৌতিক অবকাঠামো ৮) শহর গ্রাম পর্যায়ে সম্পদ বন্টনের অসামঞ্জস্যতা ৯) ধনী দরিদ্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সুসম সুবিধা গ্রহণের সুযোগের অভাব। ৪৭ বছরের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বৈরী পরিস্থিতি ছিল প্রায় ২৮ বছর। বিদ্যমান ছিল সামরিক শাসন, হত্যা, ক্যু আর দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। যে কোন মূল্যায়নেই আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অবস্থান। এত প্রতিকূল পরিস্থিতির পরেও স্বাস্থ্য খাতের অর্জন বিশ্বে প্রশংসনীয়। সবেমাত্র আমরা উন্নয়নশীল দেশের পদযাত্রায় পা রাখলাম। বাস্তব সীমাবদ্ধতা রয়েছে অনেক। আমাদের মাথাপিছু আয় ১৭৬২ ডলার। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার মাথা পিছু আয় ২৯,০০০ ডলার। সেক্ষেত্রে রাতারাতি বাংলাদেশের পক্ষে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্বে সমাদৃত বাংলাদেশের যে অর্জনগুলো রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-১) শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস ২) টিকাদান কর্মসূচীর ব্যাপক সফলতা ৩) কিছু কিছু সংক্রামক রোগ নির্মূল এবং অন্যগুলো নিয়ন্ত্রণে ৪) গড় আয়ু বৃদ্ধি ৫) পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সফলতা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার চতুর্থ (২০১৭-২০১২২) স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা, পুষ্টিবিষয়ক উন্নয়ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকার এই বিশাল বাজেটের প্রকল্পে বিশেষভাবে যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছেÑ ১) সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বাংলাদেশের ৫৯ শতাংশ রোগীর মৃত্যুর কারণ হচ্ছে অসংক্রামক রোগ। ২) পুষ্টি ৩) খাদ্য নিরাপত্তা ৪) মানব সম্পদ উন্নয়ন ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে ১৩১২৬টি ক্লিনিক গ্রামাঞ্চলে প্রশংসনীয় সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ৩২টি ওষুধ বিনামূল্যে রোগীদের প্রদান করা হয়। অনেকগুলো ক্লিনিকে প্রসূতির ব্যবস্থা রয়েছে। দরিদ্র, গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে আরও ২৩৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ক্রমে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রধান যে লক্ষ্যগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে- ১) পুষ্টিহীনতা ২) সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও প্রতিকার ৩) অত্যাবশকীয় ওষুধ ও ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা ও বিতরণ ৪) শিশু সুরক্ষা ও সুস্থ পরিবেশ ৫) সুস্থ শিশু ও তার স্বাভাবিক বিকাশ ৬) রোগীদের চিকিৎসার জন্য পকেট খরচ হ্রাস করা। ৭) সুস্থ জীবন যাপনের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা। ৮) শহর গ্রাম চিকিৎসা সুবিধার বৈষম্য কমিয়ে সমানুপাতিক সুযোগ বৃদ্ধি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ। বর্ধিত বাজেটের একটি বড় অংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ইনক্রিমেন্টে চলে যায় এবং একটি অংশ স্বাভাবিক মূল্যস্ফিতিকে ভারসাম্য করে। আমাদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে দুর্বলতা রয়েছে। যেহেতু চিকিৎসা একটি জরুরী বিষয় তাই এক্ষেত্রের টেন্ডার প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং এবং ফলোআপ পদ্ধতিকে আরও আধুনিক এবং বাস্তবসম্মত করতে হবে। পর্যাপ্ত সৎ, দেশপ্রেমিক, আন্তরিক, দায়বদ্ধ, দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই বর্তমান বাজেটের সর্বোচ্চ ব্যবহার কাম্য। এর যথাযথ ব্যবহারের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আমাদের বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। লেখক : সাবেক উপাচার্য ও অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
×