ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৬ জুন ২০১৮

ঢাকার দিনরাত

ঈদ-পরবর্তী ঢাকায় প্রত্যেক দিনই বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হবেÑ এটি আবার ঘটা করে বলার কী আছে? তবু বলতে হয়, কেননা ঢাকাবাসীর বর্ষার ভোগান্তি অপরিবর্তিতই থাকে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা। ঈদের ছুটি শেষে আমাদের এই রাজধানী শহরটি বছরে দু’বার খানিকটা বিশ্রাম নেবার সুযোগ পায়। খানিকটা ঘুমিয়েও নেয় কি? না ঘুমোলেও তার নিশ্চয়ই তন্দ্রা ভাব আসে। যদি বলি ঢাকা হলো নকল রাজাধিরাজ, অনেকটা সৎ পিতার মতো। তার বেশিরভাগ সন্তানেরা ফেরে আপন মাতৃক্রোড়ে, বছরে দুইবার নিয়ম করে দুই ঈদে। তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? ঈদের ঠিক আগে কয়েকটা দিন ঢাকা থাকে অন্যরকম। ঈদের অব্যবহিত পরেও থাকে ভিন্নরকম। চিরচেনা ঢাকাকে চেনা যায় না, যানজটের ধকল সয়ে তিন ঘণ্টার পথ সেই সময় পেরুনো যায় মাত্র ত্রিশ মিনিটে। ঢাকার বাতাসে তখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয় না। এসবই হয়ে থাকে ঢাকা জনচাপমুক্ত হওয়ায়, আর ছুটিতে কলকারখানা বন্ধ থাকায়, রাস্তায় গাড়ির পরিমাণ লক্ষ্যযোগ্যভাবে কমে আসায়। তবে ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় বসত গড়ে তোলা প্রায় কোটি মানুষ ঢাকা ছেড়ে গেলে নগরীর প্রাণভোমরাটি কি কেঁদে ওঠে না! তাতে কি ছন্দপতন আসে না? ঢাকা তাই প্রতীক্ষায় থাকে ঈদের ছুটি ফুরানোর। শহর থেকে সাময়িকভাবে অনুপস্থিত মানুষগুলোকে স্বাগত জানানোর জন্য তার ব্যাকুলতা ক্রমশ বাড়ে। ঈদের সময়, ঈদের আগে এবং পরে রাজধানীর চিত্র অন্যান্য বছরের মতো এবারও একইরকম ছিলÑ এমনটা বলা যেতে পারে। ঈদের আগে ঢাকা ফাঁকা করে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়Ñ শহর ও গ্রামের উদ্দেশে ছুটে যাওয়া সাধারণ নিয়মে পরিণত। যারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যেতে ব্যর্থ হন তাদের হৃদয়ের ভেতর চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস, যারা যান না বলে আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখেন তারা এবং তাদের সঙ্গে ঢাকার অন্যান্য নাগরিকরা ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নেন। রাস্তাঘাটে যানবাহন ও মানুষের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে আসায় ঢাকার চিরচেনা বা বলা ভাল স্থায়ী হয়ে যাওয়া রূপ বদলে যায় সাময়িকভাবে। বহু প্রতীক্ষিত ঈদের দিন পার করেই পরের দিনটা পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করার ইচ্ছা থেকে চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পার্ক, দর্শনীয় স্থান ও বিনোদনকেন্দ্রে ভিড় করার একটা প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায় বরাবরই। অনেকে আবার পদ্মা বা যমুনা পাড়ে চলে যান সময় কাটাতে। সব মিলিয়ে ঈদে অবধারিতভাবে পাওয়া তিন-তিনটে ছুটির দিন ঢাকার দিন ও রাত কী ব্যস্ততার ভেতর দিয়েই না চলে যায়। এখানেও দু’রকমের অনুভূতি কাজ করে। একদল আছেন যাদের কাছে তিনটে দিন যেন মোটে একটা দিনের সময় দৈর্ঘ্য নিয়ে উপস্থিত হয়। ঈদের ছুটি শেষে মনে হয়Ñ ইশ এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল! আরেক দলের ছুটি যেন ফুরোতেই চায় না। তিন তিনটে দিন তাদের কাছে অলস সুদীর্ঘ এক বিরক্তি। আসলে ঈদের আনন্দ আর চাঞ্চল্য সব যেন অল্পবয়সীদেরই, বড়রা স্রেফ নিয়ম রক্ষা করে চলেন। তবু তাদের প্রাণেও যে ঈদ এসে বাঁশি বাজায় নাÑ এ কথাও আমরা জোরের সঙ্গে বলতে পারি না। ঢাকার মানুষ ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরে আসতে শুরু করে ঈদের একদিন পর থেকেই। প্রায় সপ্তাহব্যাপী চলে এই কর্মস্থলে ফিরে আসার প্রক্রিয়া। ‘কর্মস্থল’ শব্দটি ইচ্ছা করেই ব্যবহার করা হয়েছে বাসাবাড়ির পরিবর্তে। একমাত্র ঈদ এলেই তো বোঝা যায় ঢাকার সিংহভাগ মানুষই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। ঢাকায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে ঢাকাতেই আপাতত স্থায়ীভাবে তাদের থেকে যাওয়া। যদিও শিকড় তাদের ঢাকার বাইরে, মফস্বল শহরে কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। বছরে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও নাড়ির টানে সেখানেই ছুটে যাওয়া। ঢাকার মানুষগুলো ঢাকার বাইরে নিজ নিজ ঠিকানায় অল্প ক’দিনের জন্য গিয়ে সেই পুরনো দিনের মানুষটাতেই কি পরিণত হয় না? যিনি খুবই কঠোর বা রাশভারি, তিনিও স্বল্প সময়ের জন্য হলেও প্রথম ঢাকায় আসার আগের মন আর মেজাজ যেন ফিরে পান। যদি বলি অবয়বের ওপর সেঁটে বসা মুখোশখানি ক্ষণিকের জন্য হলেও খুলে পড়েÑ তাহলে ভুল বলা হবে না। আবার ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরতে ফিরতে সেই ঢাকার মানুষটির খোলসের মধ্যেই আবার একটু একটু করে তার প্রত্যাবর্তন ঘটতে থাকে। ইট-কাঠ-সিমেন্ট আর ধুলো-ধোঁয়া-যানজট এবং শব্দদূষণের এই শহরে ওই মানুষগুলোর পরিচয় সব পোশাকী বটে। পেশাগত কারণে যেমন তাদের ঢাকায় থাকা, তেমনি পেশাগত পরিচয়টাই সব পরিচয় ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে। যাক, তবু তো কোটি মানুষের একটা উপলক্ষ আছে আপন দর্পণের সামনে দাঁড়ানোর। সেই দর্পণ তার আদি ও অকৃত্রিম ভেতরের মানুষটিকে এক লহমায় সামনে টেনে বের করে আনে। মানুষ আবার পরিপূর্ণ মানবিক হয়ে ওঠে। চেনা ছন্দ অজানা শঙ্কা ঢাকা তো ফিরলো চেনা ছন্দে, কিন্তু পুরনো দুশ্চিন্তাও যে ফিরলো আবার! তাতে যোগ হয়ে চলেছে অজানা আশঙ্কা। ঘনবসতির জনচাপ দেশের রাজধানীকে কোন চুলোয় নিয়ে যাবে ভবিষ্যতে? আমাদের এই দেশটার আয়তন মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার, কিন্তু জনসংখ্যা ইতিমধ্যে ১৬ কোটি ৬৪ লাখে পৌঁছেছে। এই দেশে এখন এক কিলোমিটার জায়গায় বাস করছে ১ হাজার ১২০ জন মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবহুল দেশ চীন (মোট জনসংখ্যা ১৪১ কোটি), সেখানে প্রতি এক কিলোমিটারে বাস করে মাত্র ১৪৫ জন। ম্যাকাও, মোনাকো, সিঙ্গাপুর, হংকং-এ রকম কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ ও নগররাষ্ট্রের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের জনঘনত্ব এখন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর দক্ষিণ এশিয়ার কথা বললে বাংলাদেশ এক অকল্পনীয় মাত্রার জনঘনত্বের দেশ। ভারতের জনঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ৩৬৪, পাকিস্তানের ২৪৫, নেপালের ১৯, আর ভুটানের মাত্র ৪৬। সর্বশেষ জাতিসংঘের হ্যাবিটেট প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কংক্রিটের জঙ্গল ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজার ৫০০ মানুষ বাস করে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে ইউএন হ্যাবিটেট। ঘনবসতির দিক দিয়ে এক নম্বর অবস্থানে আছে ঢাকা, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের মুম্বাই, তৃতীয় অবস্থানে কলম্বিয়ার শহর মেডেলিন এবং চতুর্থ অবস্থানে ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলা। বাংলাদেশের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বর্তমানে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ বাস করছে। এ চিত্র নিঃসন্দেহে হতাশার। ঢাকায় যখন গলিপথেও হাঁটি তখনও সতর্ক থাকতে হয় এই বুঝি কারও গায়ে ধাক্কা লাগল। ‘শনির দশায়’ শনিবার না, বৃষ্টিকে শনির দশা বলতে একেবারেই মন সায় দেয় না। কিন্তু বৃষ্টি হলে বড় বড় সড়কেও যেভাবে ঢেউ খেলে যায়, গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে এবং যানজটে নাকাল হওয়া বাড়েÑ তাতে শনির দশা বললেই বুঝি যথার্থ শোনায়। বৃষ্টি হলেই যে ঢাকায় এমন ভয়াবহভাবে পানি জমে যায় সেটির জন্য আমরা দায়ী করব কাকে? নালা-নর্দমার মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সুগম থাকলে এভাবে পানি জমতে পারে না। ঈদের পরে জনকণ্ঠে আসার পথে সোনারগাঁও হোটেলের দক্ষিণ-পশ্চিম রাস্তায় দেখছি হাতির ঝিল লাগোয়া উদ্যানের পেভমেন্টসহ হাঁটাপথটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে গভীর গর্ত, কাজ চলছে। সারা বছর ধরে নিয়মিতভাবে নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার করা ওয়াসার কাজ। কিন্তু সংস্থাটি এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে না। শুকনো মৌসুমে নালা-নর্দমাগুলোর দিকে তাদের কোন দৃষ্টি থাকে না, শুধু বর্ষা এলেই এ ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু হয়। এ বছরও ওয়াসা নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে অর্থ বরাদ্দ চেয়েছে এবং ইতিমধ্যে তাদের ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শুনতে মন্দ লাগলেও কথাটা মিথ্যে নয় যে, জলাবদ্ধতা দূর করার উদ্যোগগুলো অনেকটাই যেন সাময়িক আপদ মেটানোর লক্ষ্য থেকে পরিকল্পিত। সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য যে সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত পরিকল্পনা করা প্রয়োজন, তা করা হয় না। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণগুলো চিহ্নিত করে সেসব কারণ অপসারণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয় বারবার। যদিও সেসব অরণ্যে রোদন বলেই আখেরে প্রতীয়মান হয়। ঢাকার ভেতরের অধিকাংশ খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় মহাসমস্যা হয়েছে। কথা হচ্ছে, ভরাট খাল পুনরদ্ধারের সুযোগ কি আর আছে? কিন্তু এখনও যেসব খাল আছে, সেগুলোর শোচনীয় দুরবস্থা দূর করার উপায় অবশ্যই আছে। এজন্যে শুধু সদিচ্ছাই সব নয়, জরুরি হলো কাজে নেমে পড়া। খালগুলোর অবৈধ দখল অপসারণ করে বর্জ্য সরিয়ে সংস্কার করা হলে সেগুলো দিয়ে অনেক বৃষ্টির পানি নেমে যেতে পারবে, এটি বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। এমনটি করা হলে যে জলাবদ্ধতা কমবে, সেটিও আমাদের জানা। জলাবদ্ধতার আরেকটি কারণ পর্যাপ্ত নালা-নর্দমার অভাব। এই অভাব দূর করার জন্য নতুন নতুন নালা-নর্দমা নির্মাণ করার বিকল্প নেই। বিশ্বকাপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঢাকায় কি এবার বিশ্বকাপের উন্মাদনা কিছুটা কম? নাকি ঈদ এসে পড়ায়, ঢাকাও ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় উচ্ছ্বাস-উত্তেজনায় ভাটা পড়েছে! যতটুকু মাতামাতি, সবই যেন অন্দরমহলে, টিভি সেটের সামনে। আর সেই সঙ্গে খেলা চলতে চলতে এবং খেলাশেষে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার সক্রিয়তায় বোঝা যায় যে বিশ্বকাপ ফুটবল জমে উঠেছে। পাড়ায়-মহল্লায়, টিএসসিতে, খেলার মাঠে বড় পর্দা ঝুলিয়ে প্রজেক্টারে ফুটবল খেলা প্রদর্শনের হিড়িক কি এবার কমে এলো? সুবিশাল মডেল টাউন উত্তরায় মাত্র একটি জায়গায় ( ১২ নং সেক্টর খেলার মাঠ) তরুণরা একজোট হয়ে বড় পর্দায় খেলা দেখছে। মগবাজারেও এমন উদাহরণ মিলেছে। কিন্তু ধানমন্ডি কিংবা মীরপুরের মতো বড় এলাকায় কি মাঠেময়দানে জায়ান্ট স্ক্রিনে বিশ্ব ফুটবলের আনন্দে তরুণেরা মাতোয়ারা হচ্ছে না? ২৪ জুন ২০১৮ [email protected]
×