ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোন অবস্থায়ই চিকিৎসা ছাড়া আহত ব্যক্তিকে ফেরত বা স্থানান্তর নয়

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৫ জুন ২০১৮

 কোন অবস্থায়ই চিকিৎসা ছাড়া আহত ব্যক্তিকে ফেরত বা স্থানান্তর নয়

নিখিল মানখিন ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকল্পে খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে সরকার। নীতিমালার নাম দেয়া হয়েছে ‘জরুরী স্বাস্থ্যসেবা ও সহায়তাকারী সুরক্ষার জন্য নীতিমালা-২০১৮’। নীতিমালায় বলা হয়েছে, জরুরী শল্যচিকিৎসার (অপারেশন) প্রয়োজন পড়লে উপযুক্ত অভিভাবক বা আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতেও সম্মতি ব্যতিরেকেই প্রয়োজনীয় শল্যচিকিৎসা দেয়া যাবে। এক্ষেত্রে আহত ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা থাকলে বা জীবনহানি ঘটলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। আহত ব্যক্তির চিকিৎসা প্রদানে সক্ষমতাসম্পন্ন হাসপাতাল কোন অবস্থায়ই রোগীর চিকিৎসা প্রদান ব্যতিরেকে ফেরত বা স্থানান্তর করতে পারবে না। অন্যদিকে চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হলে বা অবহেলা করলে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে যিনি বা যারা নেবেন তাদের কোনভাবে হয়রানি করা যাবে না। মামলার ভয়ে অনেক সময় সাধারণ মানুষও আহতকে যেমন উদ্ধার করে না, হাসপাতালও দায় এড়াতে চায়। এ নীতিমালার ফলে সমস্যাটি কমে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে- আহতকে হাসপাতালে আনার পর জরুরী স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে। চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তির অবহেলা বা শৈথিল্য অসদাচরণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধন/লাইসেন্স/অনুমতি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে। নীতিমালা বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে একটি জরুরী স্বাস্থ্যসেবা সেলও গঠন করবে সরকার। নীতিমালায় আহত ব্যক্তি নিজেই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে চিকিৎসাসেবা দেয়ার আগে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া যাবে না। একজন পুলিশ কর্মকর্তা আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আগে আহত ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত যানবাহনের ব্যবস্থা করবেন। নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা সুবিধা বা সক্ষমতা না থাকলে রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য লিখতে হবে। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে (গোল্ডেন আওয়ার) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিজ দায়িত্বে উপযুক্ত চিকিৎসা সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে স্থানান্তর করবে। নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, আহতকে হাসপাতালে নেয়া ব্যক্তি বা সহায়তাকারী ব্যক্তিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই আটক বা অন্য কোনভাবে হয়রানি করতে পারবে না। সহায়তাকারীকে তার পরিচয় বা টেলিফোন নম্বর দিতে বাধ্য করা যাবে না। তবে স্বেচ্ছায় তথ্য দিলে তা লিখে রাখবে এবং সংরক্ষণ করবে। এ তথ্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে। এদিকে, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এ্যান্ড রিসার্চ এর তথ্যানুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে বছরে ২৩ হাজারেরও বেশি মৃত্যু ও ৩৫ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু আহত হয়। আর্থিক ক্ষতি বিবেচনায় বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। সড়ক মহাসড়কে কারিগরি ত্রুটি, যানবাহন চলাচলে অনিয়ম, চালকের অদক্ষতা, জনসচেতনতা অভাব ও সড়ক মহাসড়কে চলাচল উপযোগী নিরাপদ যানবাহনের অভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির জরুরী চিকিৎসা আবশ্যক হলেও তারা যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পান না। বিভিন্ন ছোট বড় হাসপাতাল বিশেষ করে বেসরকারী হাসপাতালগুলো নানা অজুহাতে দুর্ঘটনার শিকার রোগীদের অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করে। আহত ব্যক্তি যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, বিকলাঙ্গ বা পঙ্গুত্ববরণ করেন এমন কি তাদের মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১১ অনুসরণ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের সংখ্যা হ্রাস, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানের সুপারিশ সর্বোপরি হাইকোর্টের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরী স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে এ নীতিমালা প্রণীত হয়। অভিযোগ রয়েছে, দেশের বেশিরভাগ বেসরকারী হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। ফলে এসব সেবাকেন্দ্রে দুর্ঘটনায় আহতদের নিয়ে গেলেও জরুরী চিকিৎসাসেবা মিলে না। অনেক হাসপাতাল আবার ঝামেলা এড়াতে দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা দিতে আগ্রহী থাকে না। আবার কোন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা দেয়ার আগেই টাকা জমাদানের নির্দেশ দিয়ে থাকে। কোন কোন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জরুরী বিভাগই নেই। এদিকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে আবার কোন কোন হাসপাতাল নামকাওয়াস্তে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সরকারী হাসপাতালে স্থানান্তর করে দেয়। এতসব অনিয়মের ফাঁদে পড়ে জরুরী চিকিৎসাসেবা পান না রোগীরা। কিন্তু এসব অনিয়মের বিষয়ে জানলেও আইনের ফাঁকফোকর থাকায় কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাসপাতালের জরুরী বিভাগগুলোকে মানসম্পন্নভাবে তৈরি এবং আধুনিকায়ন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে মানসম্মত জরুরী বিভাগ নেই। আবার জরুরী বিভাগ থাকলেও জরুরী চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, দক্ষ নার্স, টেকনিশিয়ান ও যন্ত্রপাতি নেই। তাই এ বিষয়ে সরকারের একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে। জরুরী বিভাগে কী ধরনের যন্ত্রপাতি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সসহ সাপোর্টিং কর্মচারী কারা থাকবেন নীতিমালায় উলেখ থাকতে হবে। জরুরী বিভাগ চালুর পর সরকারকে এটি মনিটরিংও করতে হবে। দেশে প্রতিদিন যত লোক হাসপাতালে আসার কিছু সময়ের মধ্যে মারা যান, হাসপাতালগুলোতে উপযুক্ত জরুরী স্বাস্থ্যসেবা কার্যকর থাকলে এর বড় অংশকেই হয়তো বাঁচানো সম্ভব।
×