ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তিন দিনে ৮২ মোটরসাইকেল জব্দ

চট্টগ্রামে লাটভাইদের দাপট

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৫ জুন ২০১৮

চট্টগ্রামে লাটভাইদের দাপট

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মোটরবাইকে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে কিলোমিটার পার। একসময় টানা পার্টি হিসেবে ভারতীয় সীমান্ত পার করে অবৈধভাবে মোটরসাইকেল চোরাইপথে নিয়ে আসাই ছিল চোরাকারবারিদের টার্গেট। হাইড্রোলিক ব্রেকের মোটরসাইকেলের প্রথম এদেশে প্রবেশ হয়েছে টানা পার্টির সদস্যদের মাধ্যমে। তবে পরে এসব মোটরসাইকেল স্থলবন্দরের অকসনের মাধ্যমে এসব বাইকের অনেকগুলোই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে রাস্তায় চলার অনুমতি পেয়েছে। এখন এ ধরনের মোটরসাইকেল আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে। তবে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে দ্রুতগামী এসব মোটরসাইকেল। কিন্তু এসব মোটরসাইকেল নাম্বারপ্লেট তথা রেজিস্ট্রেশনবিহীন রাস্তায় চলাচল করছে সাংবাদিক, প্রেস, পুলিশ, পিবিআই, সিআইডি, ডিবি, আইনজীবীসহ বিভিন্ন দাপুটে শ্রেণী পেশার নামে রাস্তায় চলছে। ট্রাফিক ও থানা পুলিশ দায়িত্ব এড়িয়ে চলার কারণে এসব লাটভাইয়েরা দাপটের সঙ্গে রাস্তাকে স্পোর্টস রানওয়ে বানিয়ে ছেড়েছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে শুধু চট্টগ্রামেরই নয় রাজধানীসহ দেশের আনাচে কানাচে থাকা বিভিন্ন সড়ক ও মেঠোপথ। লাটভাইদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল পাকড়াও করতে অভিযানে নেমেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে জানান, আমরা বেপরোয়াদের পাকড়াও করতে দফায় দফায় অভিযান পরিচালনা করছি। অনিবন্ধিত, চোরাই, টানা বাইক ও বেপরোয়াদের আটক করা গেলেই রাস্তায় অন্য পরিবহনের ঝুঁকি হ্রাস পাবে। বিশেষ করে বেপরোয়াদের মাঝে বাইক আটকের ম্যাসেজটুকু পৌঁছে দিতে পারলেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। গত তিন দিনের অভিযানে ৫২টি মামলা রুজু হয়েছে আর ৮২টি বাইক আটক করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযান পরিচালনার নেপথ্যের একটি কাহিনী বর্ণনায় তিনি বলেন, এক দম্পতির শখে সুখ হরণ হয়েছে। বিয়ের দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও নিঃসন্তান ছিলেন মাহবুব-নাসরিন দম্পতি। উচ্চ শিক্ষিত, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল এই দম্পতির জীবনের অপূর্ণতা বলতে ছিল একটি সন্তানের আকুতি। একটি সন্তানের আশায় তারা সবার অকথা-কুকথা শুনেছেন। মেনেছেন সংস্কার-কুসংস্কার সবই। বিয়ের দীর্ঘ ১৫ বছর অবশেষে পূর্ণতা পায় তাদের সুখের সংসার। তাদের ঘর আলো করে আসে ছেলে সন্তান নয়ন। পোকা কামড় দিবে এই ভয়ে একমাত্র সন্তানকে মাটিতে রাখতেন না। বাইরের শব্দে ঘুম ভেঙে যাবে-তাই বাসার জানালায় লাগিয়েছেন সাউন্ড প্রুফ গ্লাস। সন্তানের সবকিছুই যেন নিজে দেখতে পারেন তাই তাকে রাখতেন চোখের সামনেই। সন্তানের বয়স বাড়লেও কমেনি বাবা-মার অফুরন্ত ভালবাসা। বরং এর সাথে যুক্ত হয় সন্তানের নানা আবদারও। একমাত্র সন্তান তাই চাহিবামাত্রই দিতে বাধ্য তারা। ফলে যে কোন কিছু চাওয়ার রাত ফুরানোর আগেই পূরণ হতো কাক্সিক্ষত সেই চাহিদা। কখনও বাবা বারণ করলে মা দিতেন লুকিয়ে। আবার কখনও মা’র মানা করা সত্ত্বেও আবদার মেটাতেন বাবা। এভাবেই বাবা-মা’র ‘বেহিসেবী’ ভালবাসায় দিন যাচ্ছিল মাত্র সপ্তম শ্রেণীতে পড়া নয়নের। তবে তাদের এমন বেহিসেবী ভালবাসাই যে একদিন তার সন্তানের জন্য কাল হবে তা বুঝেননি কখনও। সন্তানের আবদারের মুখে মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। গগণবিদারি হর্ন বাজিয়ে, সাপের মতো এঁকেবেঁকে, মরণ গতিতে বাইক চালিয়ে দিন-রাত পাথরঘাটা, জামালখান, কাজীর দেউড়ি, নেভাল দাপিয়ে বেড়াত এই নয়ন। তার এমন ‘হিরোইজম’ বাহবাও পেত সবার। সেই হিরোইজম দেখাতেই রমজানে নগরীর জামালখানে বাইক ছুটিয়েছিল সে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ২০০ গজ দূরে ছিটকে পড়ে সে। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় নয়ন। একই সাথে নিহত হয় মাহবুব-নাসরিন দম্পতির সব সুখ। তাদের বাসার সামনে এখনও আছে আবদারের সেই বাইক। শুধু নেই নয়নই। এক শখ পূরণেই হরণ হয় তাদের সব সুখ। মাহবুব-নাসরিন দম্পতির এই করুণ কাহিনী শোনার পরই ঈদের ‘বাইক স্টার’দের বিরুদ্ধে অভিযানে নামা হয়েছে। সার্বিক সহযোগিতা করল ট্রাফিক বিভাগও। প্রথম দিনের অভিযানে মোট ১২০টি মোটরসাইকেল যাচাই-বাছাই করা হয়। মোটরযান আইনে মামলা করা হয় ৩০টি। জব্দ করা হয় তিন মোটরসাইকেল। বাকিদের ভবিষ্যতে অনিয়ন্ত্রিত বাইক না চালানোর শর্তে সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয়। কিশোর আড্ডাবিরোধী অভিযানের মতো অব্যাহত থাকবে এই অভিযান। যেন আর কোন মায়ের বুক খালি না হয়।
×