ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমানতে সুদ হার কমানোর সিদ্ধান্ত

ব্যাংকবিমুখ করবে গ্রাহকদের

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৫ জুন ২০১৮

ব্যাংকবিমুখ করবে গ্রাহকদের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সঙ্কট এখনও কাটেনি। ১১ থেকে ১২ শতাংশ সুদ অফার (প্রস্তাব) করেও গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত পাচ্ছে না কোনও কোনও ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে নতুন গ্রাহকদের কাছ থেকে ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে যাচ্ছে বেসরকারী ব্যাংকগুলো। আগামী ১ জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণে সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিট তথা এক অঙ্কে (৯ শতাংশ) নামিয়ে আনতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারী ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি)। হঠাৎ করে আমানতে সুদ হার প্রায় ৬ শতাংশ কমানোর ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সঙ্কট আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমানতে সুদ হার কমানোর সিদ্ধান্ত গ্রাহকদের ব্যাংকবিমুখ করবে। নতুন করে কেউ হয়ত ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইবে না। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্র অথবা ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করবে।’ মির্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, আমানতকারীদের ক্ষতি না করে বরং ঋণ এবং আমানতের সুদ হারের ব্যবধান (স্প্রেড) কমানোর মাধ্যমে ঋণে সুদ হার এক অঙ্কে নামানো যেত। তার মতে, ব্যাংক খাতে এমনিতেই আমানতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে গেছে। নতুন করে আমানতে সুদ কমানো হলে ব্যাংকগুলো আরও তারল্য সঙ্কটের সম্মুখীন হবে। এতে করে সুদের হার কমানোর যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেটাও ভেস্তে যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘কেবল ঋণে সুদ কমালেই হবে না, ঋণের টাকা উৎপাদনশীল খাতে যাচ্ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে।’ ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি) সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘নতুন আমানত নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা ৬ শতাংশ বেঁধে দিয়েছি। এতে পুরনো আমানতকারীদের কোনও সমস্যা হবে না।’ তিনি বলেন, ‘সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য আমরা ব্যাংকের মালিকরা চেষ্টা করছি। ব্যাংকের এমডিরা চেষ্টা করছেন। সরকারও চেষ্টা করছে।’ তবে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলছেন, ‘আমানতের সুদ কমে গেলে কেবল নতুন গ্রাহকই নয়, ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন পুরনো আমানতকারীরাও।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ যদি সত্যিকার অর্থে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে তাহলে আমানতে সুদ কমলেও ক্ষতি নেই।’ সেলিম রায়হানের মতে, যেহেতু ব্যাংক খাতে সুশাসন নেই, ফলে যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তাতে ব্যাংক খাতে সঙ্কট আরও গভীর হতে পারে। তিনি বলেন, ‘সুদ হার কমাতে চাইলেই যে কমবে, তা নয়। কোনও কিছু চাপানো হলে সেটা হবে বাজার অর্থনীতির পরিপন্থী। ঋণের সুদ কমাতে গিয়ে যে জোর করে আমানতের সুদ কমানো হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ ব্যাংকিং খাত নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে, তাতে সঙ্কট কাটবে না বলে মন্তব্য করেন সেলিম রায়হান। এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতের আমানত কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের মার্চ এই ৪ মাসে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতে জনগণের আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ২৬ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। ৩ মাস পর অর্থাৎ মার্চ শেষে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ২৫ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, একদিকে আমানত আসছে না, অন্যদিকে ঋণ ঠিকই বিতরণ করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, ব্যাংকের বেশিরভাগ আমানত আসে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৫৭টি ব্যাংকে আমানত রাখা এ্যাকাউন্টধারী রয়েছেন ১০ কোটির বেশি। এই এ্যাকাউন্টধারী ১০ কোটি মানুষের আমানত নিয়েই মূলত ব্যাংক ব্যবসা করছেন পরিচালকরা। যদিও ব্যাংকিং খাতের কোনও কোনও উদ্যোক্তা এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আরেক ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বিনিয়োগ করা টাকার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি অর্থ তুলে নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে পরিচালকদের বিনিয়োগ মাত্র ৪৬ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। একই সময়ে পরিচালকরা ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে তুলে নিয়েছেন ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এদিকে সুদের হার কমানোর আশ্বাসে ব্যাংক মালিকদের দেয়া হচ্ছে নতুন নতুন ছাড়। এ বছরের শুরুতে সুদ হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলে ৪ ধরনের সুবিধা নিয়েছেন বেসরকারী ব্যাংকের মালিকরা। নতুন করে আরও ৩ ধরনের সুবিধা পেতে যাচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকের কর্পোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রসঙ্গত, বর্তমানে ব্যবসায়ীদের উচ্চ সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে বা এক অঙ্কে নামিয়ে আনার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
×