ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাট শিল্পের পুনর্জাগরণ

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২৪ জুন ২০১৮

পাট শিল্পের পুনর্জাগরণ

ঘুরে দাঁড়িয়েছে ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাট। কৃষিজাত এ পণ্যটির চাহিদা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, গত নয় বছরে রফতানি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। পাটশিল্পে পুনর্জাগরণে দেশে পাট চাষের ধুম পড়েছে। কয়েক বছরে চাষীরা পাটচাষ করে লাভবান হওয়ায় পাট চাষের জমির পরিমাণও বাড়ছে। গড়ে উঠছে পাটজাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এ শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিশেষ করে পাটের জিন আবিষ্কারের পর থেকেই পাট নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। পাটের পাতা থেকে তৈরি চা বিদেশে রফতানি হচ্ছে, আঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের তন্তু। নানা কাজে পাটের তৈরি উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে। পাটের ব্যবহার বাড়ায় পাটচাষীদের যেমন আর্থিক উন্নয়ন ঘটছে, তেমনিভাবে দেশের অর্থনীতিতেও উল্লেখযোগ্য ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাট শিল্পের পুনর্জাগরণের এ-ধারা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। দড়ি, কার্পেট, বস্তা ইত্যাদির বাইরেও পাট যে আরও নানা কাজে লাগতে পারে, এক দশক আগেও তা তেমন আলোচনায় আসেনি। এখন প্রাকৃতিক এই তন্তু ব্যবহৃত হচ্ছে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে। পাটের পাতা দিয়ে তৈরি চা রফতানি শুরু হয়েছে জার্মানিতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারি-বেসরকারী কার্যকর উদ্যোগের ফলেই পাট খাত প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পাটের হারানো গৌরব ফিরে আসায় পাট নিয়ে রোড শোর মতো অনুষ্ঠানও হচ্ছে। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, পাটশিল্পে প্রাণ ফিরে এলেও পাট খাতের একমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন’ (বিজেএমসি) এখনও লোকসানে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান লোকসান দাঁড়িয়েছে ৬১৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। পাট নিয়ে যেখানে এত সাফল্যের কথা জানা যাচ্ছে, সেখানে সরকারী প্রতিষ্ঠানটি কেন লোকসানে-তা নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি। বিষয়টি লজ্জা এবং পরিতাপেরও। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারী পর্যায়ে পাট খাত থেকে আয় ক্রমেই বাড়ছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে ৬৬ কোটি ডলার আয় করেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। বেসরকারীভাবে আয় বাড়লেও সরকারী প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পেছনে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চিহ্নিত হয়েছে। অতীতে ভরা পাটের মৌসুমেও দেখা গেছে, সরকারী এ প্রতিষ্ঠানটি বাজার নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা মনে করি, সরকার নিয়ন্ত্রিত পাটকলগুলোর লোকসান কমানোর উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। এ জন্য পাটকলের আধুনিকায়ন, কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত, দুর্নীতি রোধ এবং পাটের বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরী। মনে রাখা দরকার, এ ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ হলে বাজার ব্যবস্থাপনা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যাবে। এতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে পাটচাষে আগ্রহ হারাবে। অন্যদিকে পাট খাত আবারও অতীতের মতো দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। সঙ্গত কারণে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পাট চাষ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পাটনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়বে-পাটচাষীদের পাশাপাশি শিল্প-সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা এমন অভিমতের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়, বাংলাদেশের পাট বিশ্বামানের, বাংলাদেশের পাট শিল্পের অভিজ্ঞতা শতবর্ষ পুরনো, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিনকোড আবিষ্কারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন; এ সত্ত্বেও বাংলাদেশে পাট এক বিড়ম্বনা ও লোকসানের অন্য নাম হয়ে আছে। পাটের বিকাশের গোড়া কৃষকের হাতে হলেও এর আগায়, অর্থাৎ সরকারী ব্যবস্থাপনায় পচন ধরেছে। এখনও পাটচাষ, পাটশিল্প এবং পাটচাষীরা চরমভাবে উপেক্ষিত। তবে পাট খাতের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণের কথা স্বীকার করেই বলা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটজাত তন্তুর চাহিদা রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাট খাতকে শক্ত মেরুদ-ের ওপর দাঁড় করাতে সচেষ্ট হতে হবে। পাটশিল্পে যেহেতু পুনর্জাগরণ ঘটেছে, সুতরাং এ ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারীভাবে এ শিল্পকে উৎসাহ দিতে, প্রয়োজনে কৃষকদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান এবং উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাও জরুরী। অন্যদিকে সরকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন’ (বিজেএমসি) কেন লোকসান গুনছে, তার কারণ শনাক্ত করে দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করা দরকার। পাট শিল্পের বর্তমান সাফল্য ধরে রাখতে হলে সরকারী এ-খাতটির অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের বিকল্প থাকা উচিত নয়। নেতিবাচক মনোভাব কাম্য নয় পাট আমাদের অন্যতম অর্থকরী ফসল। এ খাতের বিকাশ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। অথচ তা নিয়েই পরস্পরবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। অর্থমন্ত্রী নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে বলেছেন, ‘লোকসান কমাতে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি) একেবারে বন্ধ করে দেয়া উচিত। এদের কোন কাজ নেই। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজমেন্ট হরিলুটে জড়িত।’ অন্যদিকে পাট প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিগত সরকারগুরো বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পাট খাত ধ্বংস করেছে, আর বর্তমান সরকার এ খাত চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বিজেএমসি যে লোকসান দেয় তা যৌক্তিক, কারণ এ খাতের সঙ্গে ৬০ হাজার শ্রমিক জড়িত, তাদের বেতন-ভাতা দিতে হয়।’ স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন দেশের প্রধান অর্থকরী পণ্য ছিল পাট। আর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিজেএমসি ছিল দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান। দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল সংস্থাটির অধীনে থাকা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাটকল। বর্তমানে সংস্থাটির আগের সেই অবস্থা আর নেই। বেশিরভাগ পাটকল ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সেসব পাটকলের অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে বিজেএমসির অধীনে রয়েছে ২৬টি মিল। এসব মিলেরও কোন কোনটির উৎপাদন বন্ধ থাকে মাঝে মধ্যে। সন্দেহ নেই, এর অন্যতম কারণ লোকসান। এটি সত্য, নানা কারণে বিজেএমসিকে লোকসান দিতে হচ্ছে। দুর্নীতি, মাথাভারি প্রশাসন, সরকার কর্তৃক সময়মতো পাট কেনার অর্থছাড় না দেয়া ইত্যাদি এর কিছু কারণ। কিন্তু তাই বলে সংস্থাটি বন্ধ করে দেয়া হলে সেটা হবে মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার শামিল। মনে রাখা দরকার, জনবলের দিক থেকে বিজেএমসি এখনও দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তাছাড়া সরকার যখন নতুন করে পাট খাতের উন্নয়নের কথা ভাবছে, তখন বিজেএমসসি নিয়ে এ ধরনের মনোভাব নেতিবাচক বার্তাই বহন করে। অর্থমন্ত্রী হয়ত বাজেটের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিজেএমসি বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেছেন। কারণ সংস্থাটির জন্য দেয়া ভর্তুকি প্রতি বছর বাজেটের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কোন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়ে যাওয়া কাজের কথা নয়। তাই যা করা প্রয়োজন তা হল সংস্থাটির লোকসান কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ। এ উদ্যোগ নানাভাবেই নেয়া যায়। প্রথমত, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করা। দ্বিতীয়ত, পাটকলে পুরনো যন্ত্রপাতির বদলে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন। তৃতীয়ত, ভরা মৌসুমে পাট কেনার অর্থছাড় করা। চতুর্থ, পাটের বহুমুখী পণ্য তৈরি করে নতুন বাজারের সন্ধান। সর্বোপরি, পাট ও পাটশিল্পের উন্নয়নে সময়োপযোগী নীতি নির্ধারণ। পাট খাতের রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। পাট পরিবেশবান্ধব পণ্য হওয়ায় বিশ্বে প্লাস্টিক পণ্যের বদলে পাটপণ্যের ব্যবহার বাড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বিজেএমসি। সংস্থাটিকে সেভাবে কাজে লাগাতে হবে। বিজেএমসি বন্ধ করে দিয়ে পাট খাতকে এগিয়ে নেয়া যাবে না, বরং এ প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করে আরও এগিয়ে নেয়ার উপায় খুঁজতে হবে।
×