ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সিদ্ধান্ত নেয়ার একক ক্ষমতা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ॥ সংশ্লিষ্টদের অভিমত

ব্যাংক মালিকদের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৪ জুন ২০১৮

ব্যাংক মালিকদের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআরআর বা ব্যাংকে নগদ জমার হার কমানোর ঘোষণা। এর প্রায় দুই মাস পর ব্যাংকের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন ব্যাংক উদ্যোক্তারা। এসব উদ্যোগ অর্থনীতির জন্য কতটা ভাল, সেই আলোচনা ছাপিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে নেয়া হলো তা নিয়ে। আর্থিক খাতে কোন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সব দেশেই অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়। সিদ্ধান্ত নেয়ার একক ক্ষমতা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের। তাছাড়া, সিদ্ধান্ত হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবনে। সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে পাঁচতারকা হোটেলে বা ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অফিসে। তাই মুদ্রানীতি নিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘটনায় বিস্মিত এই খাত সংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় নিয়েও। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের (নগদ জমার হার) সিআরআর কমানো নিয়ে বৈঠকটি হয়েছিল হোটেল প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে মুখোমুখি আলোচনায়। অন্যদিকে, ২০ জুন ঋণের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বেসরকারী ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) গুলশানে সংগঠনটির অফিসে। মুদ্রাবাজারের এসব সিদ্ধান্তের পদ্ধতি নিয়ে শঙ্কিত সাবেক নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরাও। এই খাতে আস্থার সঙ্কট তৈরি হওয়া, আমানতকারীদের ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। বলছেন, ব্যাংকের ঋণ ও আমানতকারীদের সুদের হার কত হবে, তা কোন এ্যাসোসিয়েশন বা ব্যাংক, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নির্ধারণ করে দিতে পারে না। এটা বাজার অর্থনীতির পরিপন্থী। কারণ, বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন। ফলে, বাস্তবতা এবং বাজার অর্থনীতি, ব্যবসা পলিসিই ঠিক করে কোন ব্যাংকের সুদের হার কত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, যে প্রক্রিয়ায় সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে তা মোটেও ঠিক হয়নি। ব্যাংক তো এটা করতেই পারে না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ না সুদের হার নির্ধারণ করা। তিনি বলেন, ঋণের সুদের হার ও আমানতের সুদের হার প্রতিযোগিতার বিষয়। মার্কেট ইকোনোমি অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংক তার নিজস্ব অবস্থা অনুযায়ী সুদের হার নির্ধারণ করবে। এমনকি ডিপোজিটের ক্ষেত্রেও তা ঠিক না। তার মানে এটা কোন ভাল সিগনাল দেবে না। কিছুদিন পর আরেকটি ইস্যু নিয়ে ব্যাংক এ্যাসোসিয়েশন কার্টেলের মতো, সিন্ডিকেটের মতো সিদ্ধান্ত দেবে। আরেকটা নতুন দাবি করবে। তার মানে ব্যাংকের শৃঙ্খলা, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকের পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন করে জটিলতা তৈরি করবে। মোট কথা, এটা কোন ভাল কাজ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জা আজিুজল ইসলাম বলেন, আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। যে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকেই আসৃতে হবে। তা না হলে মানুষের মধ্যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে মেরুদ-হীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করবে সবাই। এটা অর্থনীতির জন্য খুবই দুঃখজনক। আমানতকারীদের সুদের হার কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এমনিতেই যে সুদ পাচ্ছেন, তা মূল্যস্ফীতির সমান। কাজেই ঋণের সুদ কমাতে গিয়ে আমানতের সুদের হারও কমানোর ফলে ব্যাংকিং খাতের জন্য তা খুব একটা শুভ নাও হতে পারে। মির্জা আজিজ বলেন, এমনিতেই বাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হার কমে গেছে। সুদের হার কমলে নতুন করে আমানতের প্রবৃদ্ধির হারও কমবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক উদ্যোক্তাদের নিজেদের মতো করে নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ অবৈধ। এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার তারা কে? এসব ভাবনা একেবারেই অযৌক্তিক। এসব সিদ্ধান্ত মুদ্রাবাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই। বাজার কীভাবে চলবে, তা বাজারের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে। এসব সিদ্ধান্ত ঘরে বসে নেয়া যায় না। তাহলে মুদ্রানীতি দেয়ার কোন মানে হয় না। এসব বিষয়ে কোনভাবেই সরকারের সমর্থন দেয়া উচিত নয়। সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, একেক ধরনের ব্যাংকের একেক ধরনের সক্ষমতার বিষয় থাকে। সে বিবেচনা করেই ব্যাংকগুলোর সুদের হার নির্ধারণ করার কথা। ব্যাংকের মুনাফার সক্ষমতা, আমানত বাানোর ক্ষমতা, ব্যাংকের সুনাম ধরে রাখা, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে থাকা এসবের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো মার্কেট রেট হিসেবেই ডিপোজিট এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হার ঠিক করবে। কিন্তু অনেকদিন থেকেই অপ্রকাশ্যভাবে এ্যাসোসিয়েশনগুলো এই সব বিষয়ে এক হস্তক্ষেপ করে আসছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এখন সেটা অনেকটা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এটা এক ধরনের কলুষিত প্র্যাকটিসের ইঙ্গিত। আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের অভাব থাকায় এই খাতের প্রতি মানুষের আস্থা একেবারেই কমে গেছে। গত কয়েক বছর আগে ব্যাংকে যেখানে আমানতের পরিমাণ ১৮/১৯ শতাংশ ছিল এখন তা কমে ৯ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশে নেমেছে। এই অবস্থায় আমানতের সুদের হার আরও কমলে গ্রাহকরা ব্যাংকে ডিপোজিট করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। উল্লেখ্য, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকের কর্পোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়। গত ১ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণের হার ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। এতে করে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা পায়। এ ছাড়াও, সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালকদের টানা ৯ বছর পর্ষদে থাকার এবং একই পরিবারের চারজন সদস্যকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রাখার সুযোগ দেয়া হয়।
×