ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিষাক্ত হালদায় মরছে মাছ, দেশের একমাত্র মৎস্য অভয়াশ্রম বাঁচানো যাবে কি?

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৪ জুন ২০১৮

বিষাক্ত হালদায় মরছে মাছ, দেশের একমাত্র মৎস্য অভয়াশ্রম বাঁচানো যাবে কি?

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চলতি বর্ষা মৌসুম শুরুর আগ থেকেই ভারি বর্ষণের পরও দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের আধার চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও রাউজান সংলগ্ন হালদা নদী যে বিষাক্রান্ত হয়ে আছে তা থেকে উত্তরণ ঘটছে না। ঢাকার বুড়িগঙ্গা মরেছে বহু আগে। এরপর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী রয়েছে লাইফ সাপোর্টে। আর এখন মিঠা পানির মাছের অভয়াশ্রম হালদা নদী আর্ত চিৎকার চলছে। ভয়াবহ বর্জ্য দূষণে হালদা সংলগ্ন শাখা খালগুলো রীতিমতো বিষ ও বর্জ্যরে আধারে পরিণত হয়েছে। ফলে গত সপ্তাহের শেষ কদিন হালদা নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরছে এবং তা ভেসে উঠেছে। তবে সর্বশেষ শনিবার এ নদীতে মরা মাছ ভেসে ওঠেনি বলে নিশ্চিত করেছেন চবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা নদী নিয়ে বিশিষ্ট গবেষক ড. মোঃ মঞ্জুরুল কিবরিয়া। এদিকে, হালদা নদী বিষাক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কয়েক দিন ধরে মরে ভেসে ওঠার ঘটনায় শনিবার মদুনাঘাট এলাকায় সচেতন জনগণের পক্ষে হালদাকে বাঁচাতে মানববন্ধন হয়েছে। এছাড়া হালদা নদীর দূষণ রোধে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ সালাম। গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে এমএ সালাম বলেছেন, হালদা নদী, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার শাখা খালগুলো ভয়াবহ দূষণের শিকার। দীর্ঘদিন যাবত শিল্প বর্জ্যরে কারণে হালদা নদী ও হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর বুড়িশ্চর, উত্তর ও দক্ষিণ মার্দাশা, চিকনদ-ি, ফতেপুর, মেখল ও গড়দুয়ারা ইউনিয়নের ফসলের মাঠ, খাল, পুকুর ও জলাশয়গুলো মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে আছে। চলতি বর্ষা মওসুমের শুরুতে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের কারণে হালদা নদী, হাটহাজারী ও রাউজানের বিস্তীর্ণ এলাকা বিষাক্ত পানিতে একাকার হয়ে আছে। নদীতে মাছ মরে ভেসে উঠছে এবং দূষিত পানি লোকালয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে এর গৃহীত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। উল্লেখ্য, গত ১৯ জুন থেকে হালদা নদীতে ছোট, বড়, মাঝারি বিভিন্ন আকৃতি ও প্রজাতির মরা, আধমরা মাছ ভেসে উঠতে থাকে। রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হোসেন রেজা জানিয়েছেন, এসব মরা মাছ জাল ফেলে ধরে বিক্রির প্রক্রিয়ায় জড়িতদের অনেককে আটক করে সাজাও দেয়া হয়েছে। মরা মাছের মধ্যে মৃগেল, রুই, কাতলা, চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ রয়েছে। সর্বোচ্চ ওজনের একটি মৃগেল মাছ মরে ভেসে উঠেছে, যার ওজন প্রায় ১৫ কেজি। এদিকে এ ঘটনার পর ইতোমধ্যে মাছ মরার ঘটনা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা চালিয়েছেন। এতে প্রাথমিকভাবে যে রিপোর্ট মিলেছে তাতে বলা হয়েছে, হালদা নদীর পানিতে মাত্রারিক্তি এ্যামোনিয়া পাওয়া গেছে। এছাড়া অক্সিজেনের হার ব্যাপকভাবে কমে গেছে। বিশেষজ্ঞ মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, পানি দূষণ মাত্রা উদ্বেগজনক। যাতে জলজ কোন প্রাণির জন্য ইতিবাচক নয়। এ্যামোনিয়ার উপস্থিতি ব্যাপক হয়েছে, যা জলজ প্রাণির জীবনকে প্রতিনিয়ত হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, হালদা নদীর দশ পয়েন্টে ইতোমধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেছে, পানিতে ডিজল্ব অক্সিজেন অতিমাত্রায় কমে গেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, কর্ণফুলী পেপার মিলসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানার বর্জ্য হালদা সংলগ্ন বিভিন্ন উপখাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর অক্সিজেন এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্প থেকেও বিষাক্ত বর্জ্য বিভিন্ন খালের শাখা উপশাখা হয়ে হালদা নদীতে গিয়ে পড়ছে। কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে আসছে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি। যা হালদা নদীকে গ্রাস করছে। বর্ষা মওসুমে বৃষ্টির ফলে যে কোন নদীর পানি অপেক্ষাকৃতভাবে স্বচ্ছ রূপ নেয়- সেখানে হালদা নদীতে চলতি মওসুমে এ অবস্থা কেন সৃষ্টি হল তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়ায় মানববন্ধনসহ সভা সমাবেশ শুরু হয়েছে। হালদা নদীর পানি বিষাক্ত হচ্ছে ক্রমাগতভাবে এ বিষয়টি নতুন কোন তথ্য নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে প্রাকৃতিকভাবে মিঠা পানির প্রজননের একমাত্র আঁধার হিসেবে চিহ্নিত এ নদীকে রক্ষার জন্য বহু পদক্ষেপ ও ঘোষণা জানান দেয়া হলেও বাস্তবিক অর্থে দিন দিন এ নদীও মরতে বসছে। এর আর্তচিৎকার সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর কর্ণকুহরে কখন পৌঁছুবে এবং বাস্তবিক অর্থে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে সে আশায় বুক বেঁধে আছে বিশেষজ্ঞসহ আগ্রহী বিভিন্ন মহল।
×