ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতি মামলায় খালেদার আপীল শুনানির আইনী লড়াই আজ থেকেই

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৪ জুন ২০১৮

দুর্নীতি মামলায় খালেদার আপীল শুনানির আইনী লড়াই আজ থেকেই

বিকাশ দত্ত ॥ সরকারী ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটি এবং কোর্টের অবকাশ শেষে ২৩ দিন পর আজ রবিবার থেকে খুলছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট। আজ থেকে আইনজীবী-বিচারপ্রার্থীদের পদচারণায় সরগরম থাকবে সুপ্রীমকোর্ট অঙ্গন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ বিএনপির সহ¯্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি, গ্রেনেড হামলা মামলা রয়েছে। এ সময় বেশ কিছু মামলার শুনানি ও রায় হবে। এখন সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি থাকবে সুপ্রীমকোর্টসহ অন্যান্য আদালতের দিকে। আদালত খোলার দিন থেকেই শুরু হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার হাইকোর্টে আপীল শুনানির আইনী লড়াই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আপীল শুনানিতে প্রস্তুত রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন। বিএনপি চেয়ারপার্সন ছাড়াও হাইকোর্টে শুনানি হবে দ-প্রাপ্ত কারাবন্দী অপর দুই আসামি সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমদের আপীলও। আজকেই রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক দিন নির্ধারণের জন্য কজলিস্টে মামলাটি আসার জন্য আবেদন করবে। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করে বিচারিক আদালত। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৫ আসামিকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়। অন্য আসামিরা হলেন, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী (পলাতক) এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান (পলাতক)। রাজধানীর বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ আদালতের বিচারক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান টানটান উত্তেজনার মধ্যে ঐতিহাসিক এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ঐ রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া একই সঙ্গে আপীলে নিম্ন আদালতের দেয়া সাজা বাতিল করে তাকে বেকসুর খালাস দেয়ার আবেদন জানানো হয়। পাশাপাশি জামিনও চাওয়া হয়। খালেদা জিয়া ছাড়াও সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমদও আপীল দায়ের করেন। এদিকে খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে দুদক। এই চারটি আপীলের ওপর শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করা হবে। এদিকে হত্যা ও নাশকতার অভিযোগে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় দায়ের করা দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি আজ অনুষ্ঠিত হবে। সুপ্রীমকোর্টের কজলিস্টে রবিবারের তালিকায় মামলাটি শুনানির জন্য রয়েছে। এর আগে গত ৩১ মে দুই মামলায় হাইকোর্টের দেয়া জামিন আদেশ ২৪ জুন পর্যন্ত স্থগিত করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ। এ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত আপীল আবেদন (সিপি) ফাইল করতে বলে আদালত। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ৫৮টি বেঞ্চ পুনর্গঠন করা হয়েছে। আজ থেকেই পুনর্গঠিত দ্বৈত ও একক বেঞ্চে বিচারিক কাজ শুরু হবে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জনকণ্ঠকে বলেন, রবিবার আদালত খুলছে। ঐ দিনই শুনানির জন্য তারিখ চাইব। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা মামলার নকল কপি হাতে পেয়েছি। আপীল বিভাগের নির্দেশ অনুযায়ী জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আপীল শুনানির দিন ঠিক রাখতে আজ রবিবার মেনশন করব। দিন ঠিক হলে শুনানিতে অংশ নেব। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আপীল নিষ্পত্তি করতে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের নির্দেশনা রয়েছে। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল জনকণ্ঠকে বলেন, আদালত খোলার পর পেপারবুকসহ অন্যান্য কাগজপত্র দেখে আমরা মামলার বিষয়টি বলতে পারব। আপীল করেছি আমরা, আর দুদক দ্রুত নিষ্পত্তি চায়। তিনি বলেন ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির আরও ৮ সিনিয়র নেতার বিভিন্ন মামলাও প্রায় শেষের দিকে বলে জানা গেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে মামলাগুলোর রায় ঘোষণা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট মামলার আইনজীবী জানিয়েছেন। এদিকে বিএনপির পক্ষের আইনজীবী বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। যে মামলাগুলো শেষের দিকে তা হলো জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, দুর্নীতি মামলায় আব্দুল্লাহ আল নোমান, মির্জা আব্বাস এবং একেএম মোশারফ হোসেন। এ বিষয়ে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লা মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, খালেদা জিয়াসহ বিএনপির ২৫ হাজার সিনিয়র নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। এগুলো রাজনৈতিক মামলা। আগামী নির্বাচনে যাতে নেতাদের অযোগ্য ঘোষণা করা যায় সে জন্য তড়িঘড়ি এ সমস্ত মামলার রায় দেয়ার চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। আমরা আইনীভাবেই এ সমস্ত মামলা মোকাবেলা করছি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও ৩৭ টি মামলা রয়েছে। ভুয়া জন্মদিন পালন ও মুক্তিযুদ্ধকে ‘কলঙ্কিত’ করার অভিযোগে মানহানির দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী ৫ জুলাই দিন ধার্য করেছে আদালত। নাইকো দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য পরবর্তী দিন নির্ধারণ করা হয়েছে আগামীকাল সোমবার (২৫ জুন)। কুমিল্লার নাশকতায় আরেকটি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কুমিল্লার বিশেষ ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। মিথ্যা তথ্য দিয়ে জন্মদিন পালন এবং জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে ঢাকার দুই মামলায় গ্রেফতার দেখাতে ও জামিন চেয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি করতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ বহাল রেখেছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের চেম্বার আদালত। একইসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপীলের ওপর ২৫ জুন আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদ- দেয়া হয়। রায় ঘোষণার ১১ দিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রায়ের সার্টিফায়েড কপি (অনুলিপি) হাতে পান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এর পর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ২০ ফেব্রুয়ারি আপীল দায়ের করা হয়। গত ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের দেয়া ওই জামিন স্থগিত চেয়ে পরদিন ১৩ মার্চ আপীল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক। হাইকোর্টের দেয়া ওই জামিন স্থগিত চেয়ে ১৪ মার্চ আপীল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের শুনানি হয়। শুনানি শেষে খালেদা জিয়াকে হাইকার্টের দেয়া জামিনাদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপীল (আপীলের অনুমতি চেয়ে) দায়ের করতে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে নির্দেশ দেয় আপীল বিভাগ। একইসঙ্গে খালেদা জিয়াকে দেয়া হাইকোর্টের জামিন ১৮ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে আপীল আদালত। এ আদেশ অনুসারে পরের দিন ১৫ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক লিভ টু আপীল দায়ের করে। এ লিভ টু আপীলের ওপর শুনানি হয় ১৮ মার্চ। শুনানি শেষে আবেদনের ওপর আদেশের জন্য ১৯ মার্চ দিন ধার্য করে আপীল বিভাগ। পরে ১৯ মার্চ আদালত লিভ টু আপীল মঞ্জুর করে। একইসঙ্গে আপীল শুনানির জন্য ৮ মে দিন ধার্য করে। তারপর আপীল শুনানি শেষে ১৬ মে রায় দেয় আপীল বিভাগ। রায়ে খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন বাতিল চেয়ে করা রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আপীল খারিজ করে দেয় আপীল বিভাগ। একইসঙ্গে নিম্ন আদালতের দেয়া ৫ বছরের সাজার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া যে আপীল করেছেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে তা আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেয় আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপীল বেঞ্চ এ রায় দেয়। এই রায়ের অনুলিপি বিচারপতিদের স্বাক্ষর শেষে গত ১১ জুন প্রকাশিত হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও ৩৭টি মামলা রয়েছে। দুর্নীতি, যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে এসব মামলা হয়। গত ৪ জানুয়ারি ১৪টি মামলা বিচারের জন্য ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ এজলাসে পাঠানো হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে আছে ৪টি। সেগুলো হলো জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, নাইকো, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতির মামলা। চারটি মামলাই সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু মামলা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা, ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি ও ভুয়া জন্মদিন পালন মামলা।
×