ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুন্সীগঞ্জে অভ্যন্তরীণ লঞ্চ সার্ভিস এখন শুধুই স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৩ জুন ২০১৮

মুন্সীগঞ্জে অভ্যন্তরীণ লঞ্চ সার্ভিস এখন শুধুই স্মৃতি

বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের নদী ও শাখা নদীগুলোতে এখন আর লঞ্চঘাট চোখে পড়ে না। স্টিমার, লঞ্চ ও বড় বড় জাহাজ তো এই অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত প্রায়। ঢাকা থেকে বিক্রমপুরগামী যে সব লঞ্চ ধলেশ্বরী নদীর বুকের ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করত, বিগত কয়েক যুগ ধরে সেগুলো কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন ইতিহাস হয়ে আছে মাত্র। ঢাকা সদরঘাট হতে ফতুল্লা হয়ে মুন্সীগঞ্জ, তালতলা, সিরাজদিখান, আব্দুল্লপুর, বেতকা কিংবা ডহরী কোন লঞ্চঘাটেই লঞ্চ নেই। যুগ যুগ ধরে চলে আসা বিক্রমপুরের নদীগুলোতে লঞ্চ সার্ভিস এখন শুধুই স্মৃতি। এখন লঞ্চ ঢুকতে পারছে শুধু কাঠপট্টি, মুন্সীগঞ্জ, গজারিয়া। আর অপর প্রান্তের মাওয়া। এদিক দিয়ে সবচাইতে বড় লঞ্চঘাট ছিল সিরাজদিখান উপজেলার বালুরচর লঞ্চঘাট। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় কোন একসময় যেখানে লঞ্চে ওঠার জন্য যাত্রীদের বিপুল সমাগম ছিল সেখানে এখন লঞ্চের যাত্রী নামক কিছু যে একটা সময় ছিল তার কোন চিহ্নমাত্র নেই। এই বিলুপ্ত প্রায় লঞ্চের ইতিহাস এই অঞ্চলে এতটাই সরগরম ছিল যে, তখনকার সময় বাড়ি হতে কোথাও বের হওয়া মানে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে থাকত লঞ্চ। ইন্টারনেট ঘেঁটে পাওয়া যায়, বিগত দিনে বিক্রমপুরের শ্রীনগর টু ঢাকা যাতায়াতে লঞ্চ, নৌকা ও বাস সার্ভিস চালু হয় ১৯৪৭ এর দেশভাগের বছরখানেক পর। দক্ষিণ পাইকশার গ্রামের ওয়াহিদ কোম্পানি ভারত থেকে একটি মিনি লঞ্চ পেছনে পাকিস্তানী পতাকা টাঙিয়ে শ্রীনগর নিয়ে আসে। এটাই নাকি ছিল শ্রীনগর টু ঢাকার প্রথম লঞ্চ সার্ভিস। তবে এখনও বয়োবৃদ্ধদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এই অঞ্চলে লঞ্চ চালু হবারও আগে এসব এলাকায় বিভিন্ন স্থান থেকে গয়না নৌকা চলত। ওয়াহিদ কো¤পানি যে লঞ্চটি প্রথম এনেছিল সেই লঞ্চটির নাম রেখেছিল স্বাধীন। এরপর পর্যায়ক্রমে বান্দুরার সাহা পরিবার, ষোলঘরের ফিরোজ গাজী, দক্ষিণ পাইকশার ইমান আলী ও কাসেম বেপারী মিলেমিশে বেশ কয়েকটি লঞ্চ নিয়ে আসেন এই অঞ্চলের মানুষদের যাতায়াতের জন্য। তখন লঞ্চমুখী মানুষদের আনাগোনা ছিল সবদিকে। ধলেশ্বরী তখন বিশাল নদী। এই ধলেশ্বরীর শাখা-প্রশাখা নদী বা খালগুলোও তখন কি অস্বাভাবিক পরিচ্ছন্ন ছিল! লঞ্চ ছাড়াও খালের ভেতর দিয়ে চলাচল করত নৌকা, কোষা নৌকা। উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে সেই খালগুলো এখন হাতিয়ে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। কিছু খাল খননের অভাবে বিলুপ্তপ্রায় আর বাকিগুলো হারিয়েছে অবৈধ দখলদারদের করাল গ্রাসে। . খালগুলো ছিল প্রাণ বিক্রমপুরের খালগুলোই ছিল প্রাণ। তা গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। ভরাট-দখল এখন নিত্য দিনের ঘটনা। আর আর সীমানা নির্দিষ্ট না করায় এই সুযোগ নিচ্ছে খালের পারের লোকজন বা প্রভাবশালীরা। খাল খনন একটি নিয়মিত কাজ। কিন্তু সেই খনন এখন আর নিয়মিত নেই। তাই প্রকৃতির এই শিরা উপ-শিরাগুলো এখন বন্ধ প্রায়। এতে জীব বৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বর্ষাকালে উপচে পড়া পানি থাকত খালে। শ্রীনগর হতে আলমপুর, আড়িয়ল বিল পাড়ি দিয়ে লঞ্চগুলো ষোলঘর, আলমপুর, শেখরনগর, বরাম, সৈয়দপুর, কুচিয়ামোড়া, রামকৃষ্ণদি, সাপেরচর ও ফতুল্লার ঘাটে আসা-যাওয়া করত। শুষ্ক মৌসুমে খালের পানি কমে গেলে শ্রীনগর আলমপুরের এ অংশটুকুতে কেড়াই নৌকায় চড়তে হতো। বর্ষার পূর্ণ মৌসুমে লঞ্চঘাটের টার্মিনাল দিয়ে মানুষের ওঠানামা যতটা সহজে হতো, শুষ্ক মৌসুমে তার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও তেমন সমস্যা হতো না। যখন নদীতে পানি কমে যেত তখন লঞ্চ নদীর মাঝে ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত আর ইঞ্জিনচালিত মিনি বোট দিয়ে সেই লঞ্চে যাত্রীদের উঠিয়ে দেওয়া হতো। নদী তীরের মানুষগুলোর লঞ্চ লঞ্চঘাটে ওঠানামার সোনালি স্মৃতি এখনও নাকি ব্যাপক তাড়িত করে। ৭০/৮০ দশকের অনেকেই এখনও লঞ্চের কথা বলে তারও পরে ঢাকা টু বান্দুরা লাইনের একটি লঞ্চের কথা তৎকালীন সময়ের ইয়াং ছেলেদের মুখে খুব শুনি। তেমনি একজন আবদুল হামিদ জানান, ‘নাজিয়া’ নামের একটি লঞ্চ ঢাকা থেকে সকালে আসত। সেটিই আবার বান্দুরা হয়ে সন্ধ্যায় ফিরত সদরঘাটে আর এই লঞ্চে সবাই যাতায়াত করত। কারণ সেই লঞ্চেই প্রথম চালু হয়েছিল ভিসিআরের মাধ্যমে নতুন নতুন সিনেমা দেখানো। . নৌ ভ্রমণের বিনোদন বিক্রমপুরের নৌপথে চলাচল ছাড়াও নৌভ্রমণ ছিল এই অঞ্চলের মানুষের অন্যতম বিনোদন। নানা এলাকায় ছিল নৌকা বাইচ। বিনোদনের এই উপসর্গও হারিয়ে যাচ্ছে। লঞ্চে যাতায়াত মানেই ছিল অপার বিনোদন। বর্ষাকালে লঞ্চে দাঁড়িয়ে কার্নিশে হেলান দিয়ে বিলের অপরূপ দৃশ্য দেখা ছিল বিশেষ আনন্দের! বিক্রমপুরের দুটি ঐতিহ্য মাইজপাড়া ও শ্যামসিদ্দির আকাশছোঁয়া মঠ দৃশ্যমান হয়ে উঠত যাত্রীদের চোখে। লঞ্চে বসেই প্রচুর ঝালমুড়ি, আখ ও ইংরেজী আকৃতির কুকিজ বিস্কুটসহ চা খাওয়া, অন্ধ গায়কের কণ্ঠে মাটি ও মানুষের গান শোনা, ভিখারীদের ভিক্ষাবৃত্তিÑসব যেন আজ পবিত্র এক অমূল্য স্মৃতির ভা-ার! লঞ্চ ঢাকা থেকে ছাড়ার সময় লোকজন সিনে ম্যাগাজিন যেমন ‘চিত্রালী’ ও ‘সিনেমা’ বেশি পড়ত। যাতায়াতের জন্য এই অঞ্চলে তখন লঞ্চের বিকল্প কিছুই ছিল না। বর্তমান বাংলাদেশের রূপ পাল্টেছে। আমরা ডিজিটালের ছোঁয়ায় ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি আকাশে। কালের সাথে তালমিলিয়ে আমাদের এই অঞ্চলে এখন ঘর থেকে বের হলেই দরজায় দাঁড়ানো থাকে গাড়ি। হয়তো অনেকে লঞ্চের অভাব অনুভব করে না, আবার দেখেছি অনেকে এখনও লঞ্চের নাম মুখে নিতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। . শুধুই স্মৃতি তালতলা-গৌরগঞ্জ খালকে বলা হয় বাংলার সুয়েচ খাল। সেই খালেরও করুণ দশা। ধলেশ্বরী থেকে পদ্মাকে যুক্ত করেছে এই খাল। এই খালের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকায় নৌপথে চলাচল ছিল বিশাল এলাকার সহজ পথ। মাদারীপুর, ফরিদপুর ও শরীয়তপুরসহ আশপাশের এলাকার মানুষের সহজ পথ এটি। বিশাল মেঘনা পাড়ি না দিয়েই ভেতরের এই সহজ পথে সদরঘাট যাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন শুধুই স্মৃতি। এই পথে লঞ্চতো দূরের কথা, বড় নৌকা চলতে পারছে না। সিরাজদিখান উপজেলার তালতলা এবং লৌহজং উপজেলার গৌরগঞ্জে (ডহরী) এখন লঞ্চঘাটই নেই। খালের এই করুন অবস্থান নিয়ে বিগত জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় আলোচনা হয়। লৌহজং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওসমান গনি তালুকদার খালের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। খাল বা শাখা নদী খনন না হওয়ায় আশপাশের কৃষি জমিতে লামিতে আলু চাষ করতে হচ্ছে। লৌহজং উপজেলার খিদিরপাড়া ও আশপাশের বিলে এবং এবার আলু চাষ হয় প্রায় দেড় মাস লামিতে। এছাড়া সেচের সঙ্কট রয়েছে। রয়েছে অভ্যন্তরীর নৌ যোগাযোগ সঙ্কট। এতে যাতায়ত ছাড়াও কৃষি উপকরণ পরিবহন এবং উৎপাদিত ফসল বাজারজাতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। -নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ থেকে
×