ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম –ফতওয়ায়ে আলমগীরী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২২ জুন ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম –ফতওয়ায়ে আলমগীরী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য

ফতওয়ায়ে আলমগীরী ইসলামী বিধি-বিধান সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য এক সুবিশাল ফিক্হ গ্রন্থ। এই অনন্য গ্রন্থের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জিন্দাপীর বাদশাহ্্ হিসেবে খ্যাত উপমহাদেশে মুঘল রাজত্বকালের ষষ্ঠ বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীরের অমর স্মৃতি। তাজমহল নির্মাণ করে বাদশাহ্্ আওরঙ্গজেব আলমগীরের পিতা বাদশাহ্ শাহজাহান স্থাপত্য শিল্পজগতে মশহুর হয়ে রয়েছেন। আর আলমগীর মশহুর হয়েছেন আইন জগতে ফতওয়ায়ে আলমগীরী গ্রন্থনা করে। তাঁর এই অমরকীর্তি শ্রেষ্ঠত্বের ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর হয়ে রয়েছে। ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাসে বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীরের এই অবদান অতুলনীয়। তাঁর স্মৃতিকে এটা যুগ পরম্পরাব্যাপী স্মরণীয় করে রেখেছে। ফতওয়ায়ে আলমগীরীই একমাত্র গ্রন্থ যা প্রণয়নে সাত শত যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যা সম্পাদিত হয়েছিল বাদশাহ্র প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এটা প্রণয়ন ও সম্পাদনায় সময় লেগেছিল প্রায় আট বছর এবং এর জন্য অর্থ ব্যয় হয়েছিল প্রায় দুই লাখ মুদ্রা। ফতওয়ায়ে আলমগীরী সংকলন ও সম্পাদনার জন্য যাবতীয় অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল মুঘল শাহী তহবিল হতে। বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীর এই বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করেছিলেন। আরবী ভাষায় রচিত ফতওয়ায়ে আলমগীরী গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয় ৬ জিলদে বা বৃহৎ ৬ খন্ডে। পরবর্তীকালে এটা বিভিন্ন সময়ে অন্য কয়েকটি ভাষাতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। মূল গ্রন্থখানি ৬ খন্ডে হলেও এর বৃহদায়তন কমাবার উদ্দেশে খন্ডবিশেষ ভেঙ্গে অনূদিত গ্রন্থ অধিকতর খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ফতওয়ায়ে আলমগীরীতে বিশ্বের তাবত্ নির্ভরযোগ্য ফিক্্হ গ্রন্থের বিপুল সমাবেশ ঘটেছে। এতে যে সমস্ত মাস’আলা, ফয়সালা ও বিধিসম্মত সিদ্ধান্ত বিধৃত হয়েছে তা গৃহীত হয়েছে বিখ্যাত বিখ্যাত সব ফিক্হ গ্রন্থ হতে এবং প্রতিটি মাস’আলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। আরব জগতেও ফতওয়ায়ে আলমগীরীর বিশেষ কদর রয়েছে। আরবী ভাষাভাষী অঞ্চল হতে এর একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ১৩১০ হিজরীতে মিসর থেকে প্রকাশিত এর মিসরীয় তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় শায়খ আবদুর রহমান বাহরাবী এই গ্রন্থের উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষক ও তত্ত্বাবধায়ক বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীর এবং এই গ্রন্থের সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি মুল্লা নিজামুদ্দীন বুরহানপুরীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ফতওয়ায়ে আলমগীরীতে বিধৃত প্রতিটি বিষয় এবং বিষয়ভিত্তিক মাস’আলা সাবলীল ভাষায় সুচারুভাবে সহজবোধ্য বাক্য বিন্যাসের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূল বিষয়গুলোকে এক একটি কিতাব বা অধ্যায়ে বিন্যাস করে মূল বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাবত্্ বিষয়গুলোকে বাব্ বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত করা হয়েছে এবং প্রতিটি পরিচ্ছেদে উপশিরোনাম দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, পরিচ্ছেদে বিষয়ের বিস্তৃতির নিরিখে বাব্ বা পরিচ্ছেদকে ফসল বা অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে তাতে উপশিরোনাম দেয়া হয়েছে, এই রূপ সূচারু বিন্যাসের ফলে এই বিশাল গ্রন্থের সূচীপত্র দেখে অতি সহজেই উদ্ভূত কোন মাস’আলার বা বিধিসম্মত সিদ্ধান্ত বের করা সম্ভব হয়। এই সুবিশাল গ্রন্থের কিতাব বা অধ্যায়ের সংখ্যা অনেক। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় : তাহারাত বা পবিত্রতা, সালাত, যাকাত, রোযা, হজ্জ। অধ্যায়ের পরিশিষ্টে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রওযা মুবারক্ যিয়ারতের বিস্তারিত বিবরণ বিধৃত হয়েছে। অন্য অধ্যায়সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : নিকাহ্ বা বিবাহ, মাতৃদুগ্ধ পান করানো বা স্তন্যদান, তালাক, খোরপোশ, ইতাক বা দাস-দাসী আজাদকরণ, আইমান বা কসম, হুদুদ, সরকা বা চুরি সংক্রান্ত বিবরণ, জিহাদ, কুড়িয়ে পাওয়া পরিত্যক্ত শিশু ইত্যাদি। কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু, পলাতক গোলাম, নিরুদ্দেশ ব্যক্তি, শিরকত বা অংশীদারিত্ব, ওয়াক্ফ, ক্রয়-বিক্রয়, মুদ্রা বিনিময় ও জামিন, হাওয়ালাহ্, কাযীর ব্যবহার, সাক্ষ্য, সাক্ষ্যদান, ওকালত, দাবি-দাওয়া, স্বীকারোক্তি, সন্ধি, শরিকানা কারবার, আমানত, কর্য, হেবা, ইজারা, মুকাতির, উলা, বলপ্রয়োগ, হজর বা নিষিদ্ধকরণ, মাযূন, লুণ্ঠন, শফআত, ভূমি বণ্টন, বর্গাচাষ, মুআমালা, যবেহ, কুরবানি, কারাহিয়াত, পানীয়, মদ ও মাদকদ্রব্য, শিকার, বন্ধক, অপরাধ, অসিয়াত, চুক্তি, কৌশল, খুন্ছা, বিবিধ মাস’আলা, ফরায়েজ প্রভৃতি। নানাভাবে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক অধ্যায় বিন্যাস করে প্রতিটি অধ্যায় এবং প্রতিটি পরিচ্ছেদ একাধিক অনুচ্ছেদে বিন্যাস করে ফতওয়ায়ে আলমগীরী সম্পাদিত হয়েছে। এর প্রতিটি অধ্যায়ই অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ মাস’আলায় সমৃদ্ধ। এর অন্যতম প্রধান অধ্যায় হচ্ছে হুদূদ। আরবী হদ শব্দের বহুবচন হুদূদ। হদ শব্দের অর্থ সীমা। আল্লাহ জাল্লা শানুহু আদেশের ক্ষেত্রে এবং নিষেধের ক্ষেত্রে কতকগুলো সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেটাই আল্লাহর বিধান। কেউ আল্লাহর বিধানের যে কোন একটি লঙ্ঘন করলে সে জালিম। সে নিজের প্রতি নিজেই জুলুম করে এবং তার সেই জুলুমের শাস্তিও নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : কেউ তাঁর (আল্লাহর) নির্ধারিত সীমা (হুদূদ) লঙ্ঘন করলে তিনি তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করবেন (সূরা নিসা: আয়াত ১৪)। যে আল্লাহ্ নির্ধারিত সীমা (হুদূদ) লঙ্ঘন করে সে নিজের উপরই জুলুম করে (সূরা তালাক : আয়াত ১)। ফতওয়ায়ে আলমগীরীর হুদূদ অধ্যায়ে ৬টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। হুদূদ অধ্যায়ের পঞ্চম পরিচ্ছেদে মদ্যপানের শাস্তি সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ বিধৃত হয়েছে এবং মদ্যপান করার শাস্তি কোন পর্যায়ে কিরূপ হবে তার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, কোন ব্যক্তি মদ্যপান করায় এমন অবস্থায় ধৃত হলো যে, সে তখন সম্পূর্ণ মাতাল বা নেশায় আচ্ছন্ন। সাক্ষীগণ সাক্ষ্য দিল যে, লোকটি মদ্যপান করেছে তখন এই মদ্যপায়ীর ওপর হদ ওয়াজেব হবে। এই ক্ষেত্রে তার হদ হবে আশি দোররা অর্থাৎ আশিটি কশাঘাত। এই পর্যায়ে আলোচনায় বলা হয়েছে যে, অল্প পরিমাণে মধ্যপান করলে যে হদ বর্তাবে বেশি পরিমাণে মদ্যপান করলেও সেই হদ বর্তাবে। কেউ যদি মদ্যপান করে তার মদ্যপানের কথা স্বীকার করে এবং যদি তার শরীরে মদের গন্ধ থাকে তাহলে ঐ একই শাস্তি তার ওপর বর্তাবে। ফতওয়ায়ে আলমগীরীর চুরি সংক্রান্ত অধ্যায়ে চুরির বিবরণ ও চোরের শাস্তি বিধান বিধৃত হয়েছে। এই অধ্যায়ে চারটি পরিচ্ছেদ আছে। এর প্রথম পরিচ্ছেদে চুরির বিস্তারিত এবং চোর সাব্যস্ত হওয়ার বিবরণ রয়েছে এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে কোন পর্যায়ে চোরের হাত কেটে দিতে হবে তার বিধিসম্মত সিদ্ধান্ত বিধৃত হয়েছে। ফতওয়ায়ে আলমগীরীতে জিহাদ সংক্রান্ত অধ্যায় রয়েছে। জিহাদ সংক্রান্ত এই অধ্যায়ের নবম পরিচ্ছেদে মুরতাদ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আরও যে সমস্ত কুফরী কালামের উল্লেখ এতে রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : যদি কেউ কাউকেও গুনাহ কাজ করতে দেখে বলে ওহে! তুমি কি আল্লাহকে ভয় করো না? উত্তরে সে যদি বলে: না। তবে তা কুফরী বলে গণ্য হবে। যদি কেউ কোন ব্যক্তিকে এমনিতেই বলে যে, তুমি কি আল্লাহ্কে ভয় করো না? আর সেই ব্যক্তি ক্রোধের সঙ্গে বলে যে না। তবে সে কাফির হয়ে যাবে। যদি কেউ কুরআন মজীদের কোন আয়াতে কারীমাকে ইন্কার করে, অথবা কোন আয়াতে কারীমার প্রতি দোষারোপ করে তবে সে কাফির হবে। যদি কেউ কোন ব্যক্তিকে বলে যে নামাজ পড় আর জবাবে সেই ব্যক্তি যদি বলে যে, কোন বুদ্ধিমান লোকের জন্য এই কাজ করা অর্থাৎ নামাজ পড়া সমীচীন নয় অথবা যদি বলে যে, তুমি নামাজ পড়ে কতটুকু লাভবান হয়েছ? অথবা যদি বলে যে, নামাজ পড়া আর না পড়া একই কথা- এমন ধরনের যাবতীয় উক্তিই কুফর বলে গণ্য হবে। কেউ কবর আযাবকে অস্বীকার করলে সে কাফির হবে। বাকি অংশ আগামী শুক্রবার লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.)
×