ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কমিশন এখন বলছে ইভিসি মিটার স্থাপন ৩ বছরে সম্ভব নয়

গ্রাহকের স্বার্থরক্ষায় দেয়া আদেশ থেকে এবার বিইআরসির পিঠটান

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২২ জুন ২০১৮

 গ্রাহকের স্বার্থরক্ষায় দেয়া আদেশ থেকে এবার বিইআরসির পিঠটান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় দেয়া নিজেদের আদেশের বিরুদ্ধে নিজেরাই অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কমিশন ২০১৫ সালে তিন বছরের মধ্যে ইলেক্ট্রনিক গ্যাস ভলিউম ক্যারেক্টর (ইভিসি) মিটার স্থাপনের আদেশ দেয়। কিন্তু বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানি এখনও কমিশনের এই আদেশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি। কমিশন এখন নিজেই বলছে তিন বছরে এ ধরনের আদেশ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ ধরনের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য অন্তত পাঁচ বছর সময় প্রয়োজন। বৃহস্পতিবার কমিশনে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি এবং বিতরণ কোম্পানির মার্জিন বৃদ্ধির ওপর গণশুনানিতে কমিশনের সদস্য আব্দুল আজিজ খান কমিশনের আগের দেয়া আদেশ সম্পর্কে এমন বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি এক সময় তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আজিজ খান শুনানিতে জানান, ইভিসি মিটার বিভিন্ন দেশে সুফল বয়ে আনেনি। এছাড়া বাণিজ্যিক সংযোগে ইভিসি মিটার ব্যবহার করা যায় না। কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বলছে, ইভিসি মিটার স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকের প্রকৃত ব্যবহার ভিত্তিক বিল প্রণয়ন করতে হবে। বাণিজ্যিক ছাড়া অন্য বড় ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে ইভিসি মিটার স্থাপন করা জরুরী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির এক সদস্য উদাহরণ হিসেবে বলেন, কোন ক্ষেত্রে একজন গ্রাহককে সংযোগ দেয়ার সময় ধরা যাক ১৫ পিএসআই চাপে গ্যাস দেয়ার অঙ্গীকার করল বিতরণ কোম্পানি। কিন্তু যেহেতু গ্যাসের সঙ্কট রয়েছে তাই ওই গ্রাহক সব সময় ১৫ পিএসআই থেকে কম চাপে গ্যাস পায়। কোন কোন সময় চাপের পরিমাণ ২/৩ পিএসআইতে নেমে আসে। কিন্তু বিতরণ কোম্পানি যখন সাধারণ মিটারে বিল করে তখন সর্বক্ষণিক চাপ ১৫ পিএসআই ধরেই করে থাকে। এক্ষেত্রে গ্রাহক যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে তার অতিরিক্ত বিল প্রদান করে। কিন্তু ইভিসি মিটার থাকলে গ্রাহক যে চাপে গ্যাস পাচ্ছে ওই চাপেই বিল আসার কথা। প্রকৃত ব্যবহারেরই বিল দিতে হয়। যাতে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা হয়। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের আয় কমে যাবে এই আশঙ্কায় ইভিসি মিটার স্থাপনে বরাবর অনীহা দেখিয়ে আসছে। এরপরও বিইআরসি এবং জ্বালানি বিভাগের চাপে কিছু ইভিসি মিটার স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ’১৫ সালে দেয়া আদেশে তিন বছরের মধ্যে পুরো ইভিসি মিটার স্থাপনের নির্দেশনা ছিল। একই সঙ্গে গৃহস্থালির ক্ষেত্রেও গ্রাহক যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে তার অতিরিক্ত বিল প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। বাসা বাড়িতে একজন গ্রাহককে মাসে ৮৮ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার ধরে গড়ে দুই চুলার বিল করা হয় ৮০০ টাকা। কিন্তু গড়ে একজন গ্রাহক ২০ ঘনমিটারের বেশি গ্যাস ব্যবহার করে না। গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়া বন্ধ করতে বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিরা এক্ষেত্রেও চরম অনীহা দেখাচ্ছে বলে বিইআরসির গণশুনানিতে উঠে এসেছে। কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি বলছে গৃহস্থালির গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি জরিপ করা যেতে পারে। মিটারবিহীন এবং মিটারযুক্ত গ্রাহক কি পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত। এলএনজি আসলে দেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে। তখন অতিরিক্ত দামে গ্রাহককে গ্যাস কিনতে হবে। তখন গ্যাস ব্যবহার সঠিকভাবে নিরূপন হওয়া উচিত বলে মনে করা হয়। শুনানিতে ভোক্তাদের পক্ষে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আদেশ দেয়ার সাগে তিন বছর পরে এসে বলা হচ্ছে ইভিসি মিটার স্থাপন করতে পাঁচ বছর দরকার হবে। কিন্তু এই সময়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোও বিইআরসিকে এ বিষয়ে অবহিত করেনি। এমনকি সময়ে সময়ে এসব বিষয় অবহিত করার কথা থাকলেও বিতরণ কোম্পানি তা থেকে বিরত থেকেছে। এখন এসে এ ধরনের বক্তব্য অনভিপ্রেত বলে দাবি করেন তিনি। শুনানিতে অধ্যাপক আলম জানতে চান কোম্পানিগুলোর অবস্থান দেশের বিভিন্ন শহরে হলেও বোর্ড মিটিং এবং কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ঢাকায় হয় কি না। বিতরণ কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয় ঢাকায় সমস্ত বোর্ড মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। এছাড়া এজিএমগুলো কোন না কোন পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজন করে থাকে। বৃহস্পতিবার সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিতরণ মার্জিন ২০১৮-১৯ এ প্রতি ঘনমিটারে শূন্য দশমিক ১৬২৫ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করে কারিগরি কমিটি। এখন এই বিতরণ মার্জিনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ২৯৫৩ টাকা। একই ভাবে জালালাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিতরণ চার্জ একই সময়ের জন্য কারিগরি কমিটি ঘনমিটার প্রতি শূন্য দশমিক ১০৩৫ টাকা করার সুপারিশ করেছে। কোম্পানিটির বিদ্যমান বিতরণ চার্জ ঘনমিটারে শূন্য দশমিক ২৫০০ টাকা। প্রসঙ্গত, সিলেট অঞ্চলে গ্যাস বিতরণ করে জালালাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। আর খুলনা, বরিশাল এবং ভোলায় গ্যাস বিতরণের কথা সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কেম্পানির। কিন্তু ভোলার বাইরে আর কোথাও গ্যাস নেই দক্ষিণ-পশ্চিমের এসব জেলায়। কয়েক বছর আগে খুলনায় গ্যাস দেয়ার কথা বলে সঞ্চালন লাইন তৈরি করা হলেও বিতরণ লাইন আর তৈরি করা হয়নি। সঙ্গত কারণে সঞ্চালন লাইনটি পড়েই রয়েছে। আর বিতরণ লাইন নির্মাণের জন্য লাইন পাইপ এবং অন্য যন্ত্রাংশ কেনার পর এখন তা অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে সুন্দরবন।শুনানিতে কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম, সদস্য রহমান মুর্শেদ, মাহমুদুউল হক ভুইয়া, আব্দুল আজিজ খান ও মিজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। একই সঙ্গে জালালাবাদ এবং সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা শুনানিতে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপনের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
×