ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইউএনএইচআরসি ছাড়ল যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২১ জুন ২০১৮

ইউএনএইচআরসি ছাড়ল যুক্তরাষ্ট্র

ইউনাইটেড নেশন্স হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলকে (ইউএনএইচআরসি) ‘রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের নর্দমা’ অ্যাখ্যায়িত করে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘ভন্ডামি ও নিজেদের সেবায়’ নিয়োজিত সংস্থাটি ‘মানবাধিকারের সঙ্গে উপহাস করে আসছিল’ বলেও মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি। মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও’র সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে হ্যালি সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক এ কাউন্সিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার কথা জানান।- খবর বিবিসি ও এএফপির। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি এর আগে মানবাধিকার সংস্থাকে ‘ইসরাইলের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক পক্ষপাতের’ দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। সংস্থাটির সদস্য থাকা উচিত হবে কী না, যুক্তরাষ্ট্র তা পর্যালোচনা করে দেখছে বলেও গত বছর জানিয়েছিলেন তিনি। গত বছর হ্যালি সংস্থাটির আলোচ্যসূচীতে ‘ইসরাইলের প্রসঙ্গ থাকলেও, ভেনিজুয়েলার প্রসঙ্গ না থাকায়’ বিস্ময় প্রকাশ করে একে ‘তেল আবিববিরোধী পক্ষপাতদুষ্টতা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। পক্ষপাত দূর করতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। এমনটি না হলে যুক্তরাষ্ট্র সংস্থাটি ত্যাগ করবে বলেও আভাস ছিল তার। ৪৭টি সদস্য রাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত কাউন্সিলকে ‘মানবাধিকার সুরক্ষায় খুবই দুর্বল সংস্থা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন পম্পেও। যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ এবং সেগুলোর সমাধানের প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে শঙ্কা মানবাধিকার কর্মীদের। মুখপাত্রের মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস যুক্তরাষ্ট্রকে সংস্থাটির সদস্য হিসেবে দেখতেই ‘বেশি পছন্দ’ করবেন বলে জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া সিদ্ধান্তকে ‘হতাশাজনক খবর’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে দেশটির এ সিদ্ধান্তে তিনি ‘বিস্মিত নন’ বলে জানিয়েছেন। ওয়াশিংটনের এ ঘোষণাকে ‘বিবেকবর্জিত’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতিতে মেক্সিকো থেকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ব্যক্তিদের আটক করায় হাজার হাজার শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পর বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনার মধ্যেই মানবাধিকার সংস্থা থেকে দেশটির বেরিয়ে যাওয়ার এ ঘোষণা এলো। ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বলেছে, ইসরাইলের আগ্রাসী পদক্ষেপকে গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরার কোন উপায় নেই। অন্যায় আগ্রাসনের পক্ষে সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বেরিয়ে গেছে। তাদের এ পদক্ষেপের কারণে ইসরাইল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও একঘরে হয়ে পড়বে। মানবাধিকার সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিক হতাশা জানিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ ও সংস্থা। জাতিসংঘে স্লোভেনিয়ার রাষ্ট্রদূত ও সংস্থাটির বর্তমান সভাপতি ভজিস্লাভ সুচ বলেছেন, শক্তিশালী ও ক্রিয়াশীল এ সংস্থাটিকে উর্ধে তুলে ধরা এখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সংস্থার সংস্কারকে ‘প্রয়োজনীয়’ অ্যাখ্যা দিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনও যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ট্রাম্পের মানবাধিকার নীতি একপেশে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনের এ ‘সাহসী সিদ্ধান্তের’ ভূঁয়সী প্রশংসা করেছেন। সংস্থাটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মার্কিন সিদ্ধান্তের পর বেশ কয়েকটি টুইটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য অনেক দিন থেকেই মানবাধিকার সংস্থার সংস্কারের বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছিল। সংস্কার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাবিদাওয়া জাতিসংঘ না মানায় ট্রাম্প প্রশাসন মানবাধিকার সংস্থা থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে চলতি সপ্তাহেই মানবাধিকার কর্মী ও কূটনীতিকরা জানিয়েছিল। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর এবার জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়াটা ট্রাম্পের চরম জোটবিমুখ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মানবাধিকার সংস্থা অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূ-খ-ে ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি একেবারে নির্ধারিত স্থায়ী আলোচ্য বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। ওয়াশিংটন চায় এ আলোচ্যসূচী বাদ দেয়া হোক। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের এ সংস্থা নিয়ে অবশ্য আগে থেকেই সমালোচনা চলছিল। মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ, এমন দেশগুলোকেও সদস্য করে নেয়ায় কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে পশ্চিমা দেশগুলোর। নিয়মানুযায়ী বছরে তিনবার বসে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে এ মানবাধিকার সংস্থা। সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, বুরুন্ডি, মিয়ানমার ও সাউথ সুদানের মতো দেশগুলোতে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আলাদা কমিশন গঠন ও স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকও পাঠিয়েছে এ সংস্থা। মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের বদলে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের এ সংস্থা গঠন করা হলেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এটি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা সংস্থায় যোগ দেন। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ফের এর সদস্য হয়। পরের বছর চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, আলজিরিয়া ও ভিয়েতনামকে সদস্যপদ দেয় এ সংস্থা। ‘বিতর্কিত মানবাধিকার পরিস্থিতি বিদ্যমান’ এমন দেশগুলোকে সদস্যপদ দেয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে পশ্চিমা দেশগুলো। পরিষদের কার্যকারিতা নিয়েও এর পর থেকেই প্রশ্ন তুলতে থাকে তারা।
×