ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের মানসিক রোগীরা ভুল ও অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২০ জুন ২০১৮

 দেশের মানসিক রোগীরা ভুল ও অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন

নিখিল মানখিন ॥ মানসিক রোগ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অনেক সময় এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনটি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, মানসিক রোগীদের অনেক সময় পাগল বা বিকারগ্রস্ত বলেও চিহ্নিত করা হয়। ফলে তারা সমাজে লাঞ্ছিত ও অবহেলিত হন। অথচ এসব মানসিক রোগীকে যথাসময়ে চিকিৎসা করালে তারাও পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। দেশের অনেক মানসিক রোগী ভুল ও অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও দুই-তৃতীয়াংশ মানসিক রোগী চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত। দেশে মানসিক রোগে আক্রান্ত বিপুলসংখ্যক মানুষের চিকিৎসার জন্য সরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মাত্র ৮১৩টি শয্যা রয়েছে। বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেই পৃথক কোন সেবাকেন্দ্র। এছাড়া এ রোগে চিকিৎসার জন্য দেশে মাত্র ১৯৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। এই ১৯৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে ১শ’ জনই থাকেন ঢাকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা সুবিধা সংকটে ভুগছেন মানসিক রোগীরা। গ্রামাঞ্চলে তাদের কেউ কেউ কবিরাজি (ঝাড়ফুঁক) চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ রোগের আধুনিক চিকিৎসার অবকাঠামো নেই। বিভাগীয় পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধা থাকলেও তা রোগীর তুলনায় খুবই অপ্রতুল। দেশে অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যাও হাতেগোনা। অথচ দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের শতকরা ১৬ ভাগ মানসিক রোগী। মানসিকভাবে অসুস্থদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। মোট আক্রান্তের শতকরা ১৯ ভাগ নারী এবং ১২ দশমিক ৯ ভাগ পুরুষ মানসিক রোগী। ১৮ বছরের নিচে শতকরা ১৮ দশমিক ৪ ভাগ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার শতকরা ১৬.১ ভাগ যেকোন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ০.০৭ জন মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। উন্নত দেশে এ অনুপাত প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ১০ জন, মধ্যআয়ের দেশে ২.৭ জন অনুন্নত দেশে ০.০৫। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, বর্তমান হারে জনবল বৃদ্ধি পেতে থাকলে আগামী ১শ’ বছরেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা অন্তর্র্ভুক্তকরণ এখন সময়ের দাবি। এ লক্ষ্য অর্জনে সাধারণ চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান, মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিকরোগ চিকিৎসার কারিকুলাম সম্প্রসারণ ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যসূচীতে বিষয়টির অন্তর্র্ভুক্তকরণ জরুরী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উপজেলা, জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। এদিকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করে আসছে যে, শিশু ও নারীরাই এর শিকার বেশি হয়। এ লক্ষে বর্তমান সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ প্রণয়ন করেছে। এগুলো থেকে বেশ সুফলও আসছে। এ অর্জনকে স্থায়ী করতে সমাজকে তৎপর হতে হবে। এছাড়া মানসিক রোগ নিয়ে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়া দরকার। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ খন্দকার মোঃ সিফায়েত উল্লাহ বলেন, সার্বিক স্বাস্থ্যের অংশ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত। দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় কর্মরত জনবলের মানসিক বিষয়ক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, মানসিক রোগীদের প্রতি থাকতে হবে মানবিক আচরণ। একজন মানুষ নানা কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হতে পারে। সমন্বিত সেবা দেয়ার মধ্য দিয়ে এ রোগে আক্রান্তদের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারি। পরিপূর্ণ সুস্থ থাকার জন্য মানসিকভাবে সুস্থ থাকা প্রয়োজন। মানসিক রোগের কারণে সৃৃষ্ট অক্ষমতা অন্যান্য শারীরিক রোগের কারণে সৃষ্ট অক্ষমতার চাইতে কম নয়। মানসিক রোগীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ ঝুনু শামসুন্নাহার বলেন, শারীরিক রোগের মতো মানসিক রোগও একটি রোগ। কিন্তু মানসিক রোগগুলোকে মানুষ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তাই মানসিক রোগকে অবহেলা করার প্রবণতাও আমাদের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে। মানুষ প্রাথমিকভাবে কোন মানসিক সমস্যায় ভুগলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে না গিয়ে কবিরাজ, ফকির বা মাজারে যায় চিকিৎসার জন্য। এতে মানসিক রোগের তীব্রতা আরও বেড়ে যায় এবং রোগীর অবস্থাও ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। তিনি বলেন, যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখতে হবে, অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা যাবে না। পরিবার ও সমাজের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুনতাসির ফারুফ বলেন, বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচী বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাধা মানসিক রোগ ও চিকিৎসার প্রতি জনগণের ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সচেতনতা এবং তথ্যের অভাবে মানসিক রোগীরা দেশে বিদ্যমান স্বাস্থ্য সেবাটুকু নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জনসাধারণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও মানসিক রোগের চিকিৎসার বিষয়ে জনসচেতনতা কর্মসূচী আরও বেগবান করা। দেশে বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পাবনা মানসিক হাসপাতালসহ সব সরকারী হাসপাতালে মানসিক রোগ বিভাগ রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ সেবা দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে রোগীর শয্যা সংখ্যা ২শ’টি। এর এক-তৃতীয়াংশ শয্যায় দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতালে খুব কম খরচে ইনডোর ও আউটডোরে চিকিৎসা দেয়া হয়। প্রতিবছর এই হাসপাতালে বহির্বিভাগে প্রায় ২২ হাজার মানসিক রোগী চিকিৎসা সেবা নেয়। মন খারাপ বা হতাশা, টেনশন, ভীতি, সামাজিক পরিস্থিতির ভীতি, মৃত্যুভীতি, পরীক্ষাভীতি, একা কোথাও যাওয়ার অক্ষমতা, ভয়ানক দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়া, এক কাজ বারবার করা, শারীরিক কারণ ছাড়াই শরীরে ব্যথা ইত্যাদি রোগীদের গ্রুপ বা ব্যক্তিগত পর্যায়ের সাইকোথেরাপি দেয়া হয় বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানান, বিপুল এ জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ অনেক সময় প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও চিকিৎসা প্রাপ্তির তথ্যের অভাবে সময়মতো চিকিৎসা সেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এতে জনগণের কর্মক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যা জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা। মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। এর অন্যতম কারণ মানসিক স্বাস্থ্য, রোগ ও এর চিকিৎসার প্রতি জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমাজে মর্যাদাবোধের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এজন্য অনেকে মানসিক রোগের চিকিৎসা নেয়াকে সমাজিকভাবে লজ্জাকর মনে করেন যেটি শারীরিক রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কিন্তু সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অনেকসময় রোগী ও পরিবারের সদস্যগণ খারাপ আচরণের শিকার হন। এজন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা জরুরী। মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ বিষয়টি শুধুমাত্র রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও নিরাময় প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর অর্থ ব্যাপক। মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও বিশেষক্ষেত্র ব্যতিত জোরপূর্বক আটকে রাখা মর্যাদাহানিকর। নিম্নমানের সেবা, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়া এসব বিষয় মর্যাদার সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়টি খেয়াল করে মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্রুত রোগ নির্ণয় করে তাকে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা আমাদের নৈতিক ও সামজিক দায়িত্ব।
×