ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছিনতাইয়ের কবলে জনকণ্ঠের ডেপুটি এডিটর

ফাঁকা রাজধানীতে সাবধান- আশপাশেই ছিনতাইকারী

প্রকাশিত: ০৫:০০, ২০ জুন ২০১৮

 ফাঁকা রাজধানীতে সাবধান- আশপাশেই ছিনতাইকারী

শংকর কুমার দে ॥ এবারের ঈদের ছুটিতে ফাঁকা হয়ে যাওয়া রাজধানী ঢাকা যেন হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য। তুলনামূলক অন্যান্য অপরাধ দমনে সাফল্যের দেখা পাওয়া গেলেও রাতের রাজধানী ঢাকায় যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীর দল। ঈদের ছুটির পর যারা কাজে যোগদান করেছেন বিশেষ করে গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকসহ অনেকেই ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়ে টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ফোন, মূল্যবান কাগজপত্রসহ সর্বস্ব খুইয়ে বাড়ি ফিরেছেন এমন অসংখ্য ছিনতাইয়ের অভিযোগ পেয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ। এমনকি বিদেশী নাগরিকও পর্যন্ত বাদ যায়নি। এবারের গোটা রমজান মাসে মাদকবিরোধী অভিযান, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নানা ধরনের অপরাধমুক্ত রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সকল সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে অসংখ্য ছিনতাইয়ের অভিযোগের রেকর্ডের ঘটনা। ঢাকা মহানগর পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে এবারের ঈদের ছুটিতে ফাঁকা রাজধানী ঢাকার ছিনতাইয়ের এই চিত্র পাওয়া গেছে। এবারের ঈদের ছুটির পর সোমবার গণমাধ্যমের কর্মস্থলে যোগদানকারী অন্যান্য সাংবাদিকদের মতোই সোমবার কাজ শেষে রাতের বেলায় বাড়ি ফিরছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠের ডেপুটি এডিটর ওবায়দুল কবির। মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের অদূরে তার রিক্সাটির গতিরোধ করে দাঁড়ায় আরেকটি রিক্সারোহীবেশী ছিনতাইকারীর সংঘবদ্ধ দলের সদস্যরা। এরপর সংঘবদ্ধ দলের ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা মুহূর্তের মধ্যে আরও বেড়ে গিয়ে জনাব ওবায়দুল কবিরের রিক্সাটি ঘিরে ধরে হুমকি দিয়ে মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান কাগজপত্র নিয়ে সটকে পড়ে। সোমবার রাত প্রায় সাড়ে আটটায় জনকণ্ঠের ডেপুটি এডিটর ওবায়দুল কবিরের ছিনতাইয়ের ঘটনার আগে ও পরে আরও অসংখ্য ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ছিনতাইয়ের বিষয়টি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মোঃ মাসুদুর রহমান ও রমনা থানার ওসিকে অবহিত করে ছিনতাইকৃত টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান কাগজপত্র উদ্ধার ও ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করে পথচারীদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। শুধু দৈনিক জনকণ্ঠের ডেপুটি এডিটর ওবায়দুল কবিরই ছিনতাইকারী দলের খপ্পরে পড়ার ঘটনাই শেষ নয়, ঈদের ছুটিতে ফাঁকা পেয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে রাজধানীর ধানম-ির ২ নং রোডের সীমান্ত স্কয়ারের কাছে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন এক জার্মান তরুণী। সুইন্ডে উইদার হোল্ডের নামের জার্মান তরুণীকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তার ব্যাগ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে প্রাইভেট কারের আরোহী বেশি ছিনতাইকারীর দল। ল্যাপটপ, ক্রেডিট কার্ড, ক্যামেরা, হার্ডডিস্ক, নগদ টাকা-পয়সা, মূল্যবান কাগজপত্র ছিনতাই হয় জার্মান তরুণীর। এই জার্মান তরুণী ধানম-ির পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের ফটোগ্রাফি কোর্সের শিক্ষার্থী। তিনি ফটোগ্রাফি শিখতে ঢাকায় এসে প্রচুর ছবি তুলেছেন। সেইসব ছবিও ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইকারী দলের হাতে সর্বস্ব খুইয়ে কাঁদতে কাঁদতে পরের দিন শুক্রবার ঢাকা ছেড়েছেন জার্মান তরুণী। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ফাঁকা পেয়ে রাতের রাজধানী ঢাকাতে আরও বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকও ছিনতাইকারী দলের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন। ঈদের ছুটিতে যারা রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গেছেন এবং গ্রামের বাড়ি থেকে রাজধানী ঢাকায় ফিরেছেন তাদের অনেকেই ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েছেন। ঈদের ছুটিতে রাজধানী ঢাকা ফাঁকা পেয়ে যেন ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়। পুলিশের সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, এবারের গোটা রমজান মাসে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনাকালে জঙ্গী তৎপরতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের অপরাধী তৎপরতা রুখে দেয়ার সাফল্য অর্জন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হস্তে অপরাধ দমনের ব্যাপক তৎপরতায় ছিনতাইকারী, ডাকাত, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টিসহ নানা ধরনের শতাধিক অপরাধী চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার অভিযান এতই জোরদার ছিল যে রাজধানী ঢাকায় অপরাধ দমনে সাফল্যের দেখা পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঈদের ছুটিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ছুটি বাতিল করা হয়। কিন্তু কি কারণে ঈদের ছুটিতে ফাঁকা রাজধানী ঢাকাতে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা বোধগম্য হলো না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গোটা মাসব্যাপী ব্যাপক তৎপরতার ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে কি শেষ মুহূর্তে হাল ছেড়ে দেয়ার কারণে কি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীর দল বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ গ্রহণ করেছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, এবারের রমজান মাস ও ঈদের ছুটিতে কোন জঙ্গী হামলা, সন্ত্রাসবাদ, রাজনৈতিক হত্যাকা- বা গুপ্ত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। বড় ধরনের ছিনতাই বা ডাকাতির খবর পাওয়া যায়নি। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি নিয়ে সহিংসতা হয়নি। মাদকদ্রব্য, বৈদেশিক মুদ্রাসহ বড় ধরনের চোরাচালান ছিল অনুপস্থিত। যানবাহন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু থাকায় ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাতায়াতে কোন ভোগান্তি ও দুর্ভোগ ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ঈদের ছুটি বাতিল করে ফাঁকা রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি অভিযান, টহল জোরদার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েনসহ নানা ধরনের অপরাধী দমনে তাদের ভূমিকা ছিল চমৎকার। তবে রাজধানীতে তিনটি খুনের ঘটনা, রাজধানীর বাইরে সড়ক দুর্ঘটনার বাইরে এবার ছিনতাইয়ের ঘটনায় উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এবারের রমজান মাসের পর ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসহ বিশেষ বিশেষ জায়গায় ব্যবস্থা করা হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যে কোন ধরনের আপদকালীন মুহূর্ত মোকাবেলার জন্য রিজার্ভ ফোর্স প্রস্তুত রাখা হয়। জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীদের তৎপরতা রয়েছে এমন এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বেশি। এ ধরনের নিরাপত্তার কারণে রাজধানীর বাইরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সদস্যরা নাশকতার পরিকল্পনা চালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। বিশেষ নজরদারির মধ্যে রাখা হয় যুদ্ধাপরাধীদের দোসর ও বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। নিরাপত্তার অংশ হিসাবে জাতীয় ঈদগাহ ময়দান এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণস্থান ও গেটগুলোতে বসানো হয় আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর, সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও যানবাহনে তল্লাশি চালানো হয়েছে। ঈদগাহ ময়দান, উচ্চ আদালতসহ রাজধানীর বিপণিবিতানসহ বিভিন্নস্থানে বসানো হয়েছে বিপুল পরিমাণ সিসি ক্যামেরা। পাশাপাশি রাখা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র‌্যাব ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। ঈদগাহ ময়দানে আসা সর্বস্তরের মুসল্লিদের নিরাপত্তার স্বার্থে জাতীয় ঈদগাহ ময়দান ও তার আশপাশের এলাকায় ভাসমান দোকানপাট ও হকার তুলে দেয়া হয়। যানবাহন চলাচলেও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পুলিশের বম্ব ডিজপোজাল ইউনিট দফায় দফায় তল্লাশি চালায়। র‌্যাবের ডগ স্কোয়াডও ছিল তৎপর। রাজধানীর কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কড়া নির্দেশ ও নয়া কৌশল নিয়ে তদারকি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, এবারের রমজান মাসও ঈদের ছুটিতে দশ সহস্রাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মানুষজনকে আনন্দ বিনোদনের ব্যবস্থায় নিরুপদ্রব, নিষ্কন্টক করার জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইউনিফর্ম পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্য, মহিলা পুলিশ দলসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দশ সহস্রাধিক সদস্যের নিরলস প্রচেষ্টায় এবারের রমজান মাস ও ঈদের ছুটিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তবে ঈদের ছুটিতে ফাঁকা পেয়ে রাজধানী ঢাকাতে যেসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে সেইসব লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধারসহ ছিনতাইকারী দলের সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিবির এই কর্মকর্তা।
×