ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিলভিয়া পারভিন

মাদক নির্মূলে তরুণ সমাজের ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৫ জুন ২০১৮

মাদক নির্মূলে তরুণ সমাজের ভূমিকা

তরুণরাই দেশ, জাতি ও সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র, জাতির আগামী দিনের কর্ণধার। দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে জাতির মূল চালিকাশক্তি হলো তরুণরাই। তরুণ প্রজন্মই আমাদের দেশ-জাতিকে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে টেনে নেয়ার বিরাট ভূমিকা রাখে এবং রেখে আসছে যুগে যুগে। তবে আমাদের দেশের তরুণ ও যুব সমাজের একাংশ নানাভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে মরণ নেশা মাদকের সঙ্গে। এ নেশা এমনই এক নেশা ধীরে ধীরে বিবর্ণ করে দিচ্ছে আমাদের সবুজ তারুণ্যকে। নষ্ট করে দিচ্ছে দেশের ভবিষ্যত। আমাদের দেশের রয়েছে পর্যাপ্ত তারুণ্যনির্ভর জনশক্তি। দেশের এ মূল্যবান সম্পদ মাদকের চোরাচালান ও অপব্যবহারের কবলে পড়ে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। নেশার ছোবলে পড়ে এ যুবসমাজ কর্মশক্তি, সেবার মনোভাব ও সৃজনশীলতা হারিয়ে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করছে। দেশগড়ার কারিগর সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে মাদক। মাদকের কারণেই বুক ফাটা কান্নায় পৃথিবীর আকাশ বাতাস ভারি হয়ে যায়। রাতের অন্ধকার আরও নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে পরিবারগুলোতে। এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান দেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ লাখ। কোন কোন সংস্থার মতে ৭০ লাখ। নব্বইয়ের দশকে যার পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১০ লাখেরও কম এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিল তাদের অধিকাংশই এখন ইয়াবাতে আসক্ত। সম্প্রতি ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণ যুবসমাজকে গ্রাস করেছে। প্রতিদিন যেমন ইয়াবা ধরা হচ্ছে তেমনি প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে। আমাদের তরুণরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তরুণদের সঙ্গে তুলনা করলে কোন অংশেই মেধা, মনন ও উন্নত চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে কম নয়। এক কথায় নিজ দেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ভাল অবস্থান দখল করে আছে; তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নতুন নতুন আবিষ্কার করে চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। আর আমাদের এসব অগ্রগতি-গৌরবকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে কতিপয় দেশ পেছনে লেগে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব দেশ বিভিন্ন অপকৌশলে আমাদের তরুণ সমাজের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে এমন কিছু মারাত্মক ক্ষতিকর অপসংস্কৃতি যা আমাদের সন্তানদের মেধাকে ধ্বংস করে বিপথগামী করার পাশাপাশি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। এর মধ্যে নামে বেনামে মাদককেই প্রথম সারির একটি বলতে হবে। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্যের কারণে অপরাধ বাড়ছে। তাই অপরাধ হ্রাস করতে হলে অবশ্যই মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। অন্যথায় দিন দিন অপরাধ বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশের মাদক ব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ এদিকে ঝুঁকছেও বেশি। এই ভয়াল মাদক তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্ব সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিনষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ-মায়া, ভালবাসা, পারিবারিক বন্ধন। কয়েক বছর পূর্বে ঢাকার উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার একমাত্র মেয়ে ঐশী মাদকে আসক্ত হয়ে বাবা মাকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। সন্তান শুধু মাদকে আসক্ত হওয়ার কারণেই জীবন দিতে হয়েছে নিজ সন্তানের হাতে বাবা মাকে। ইয়াবায় আসক্ত সন্তানের হাতে বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ স্বজন নির্মম হত্যার শিকার হচ্ছেন। নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধে নিজ সন্তানকে খুন করছেন। নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। তরুণ প্রজন্মই মাদক ও মাদকাসক্তি প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমি মনে করি। তারাই পারবে দেশকে মাদকমুক্ত করতে। এজন্য তরুণ-যুবকদের শুধু মাদকবিরোধী কার্র্যাবলীতে অংশ নিলেই চলবে না, বরং প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মাদকের পাচার রোধ ও এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জাতিসংঘের মাদকবিরোধী সংস্থা ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী দিবস পালন করে আসছে। এ সংস্থাটি ‘বিশ্বব্যাপী মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা’ কার্যক্রম চালু করেছে। মিডিয়াকে এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকা- ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রাখা প্রয়োজন সীমান্তে মাদক-চোরাচালান রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। কারণ, আমাদের দেশ মাদক-চোরাচালানের রুটগুলোর মাঝামাঝি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯০) ধারাগুলো সময়োপযোগী করে এর যথাযথ প্রয়োগ ও কঠোর বাস্তবায়ন করা গেলে মাদকের অপব্যবহার অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। মাদক-ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীরা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাদকাসক্ত অভ্যাস নির্মূলের জন্য যুব সমাজের একটি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট। যুব সমাজের একটি দৃপ্ত শপথই পারে তাদের মাদকের অন্ধকার থেকে ফেরাতে। মাদকাসক্ত হয়ে পৃথিবীতে কেউ কিছুই করতে পারেনি নিজেকে ধ্বংস ছাড়া। তাই আসুন মাদক মুক্ত সমাজ গঠনে সামাজিক আন্দোলন শুরু করি। মাদকমুক্ত সমাজই হোক তারণ্যের অহঙ্কার। লেখক : সাংবাদিক
×