ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

বাজেটে সবদিক নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা চাই সংসদে

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৫ জুন ২০১৮

  বাজেটে সবদিক নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা চাই সংসদে

আজকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন, আবার ঈদের ছুটিও। মানুষ ছুটছে শিকড়ের সন্ধানে। কেউ কেউ যাচ্ছে বিদেশে। অনেকে দেশের ভেতরেই নানা পর্যটন কেন্দ্রে। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি, মেঘের গর্জন। এরই মধ্যে ক্রেতারা দোকানে দোকানে। চারদিকে ঈদকে বরণ করার প্রস্তুতি। বাৎসরিক সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। আবার বাজেট অধিবেশন চলছিল, আগামী ১৮ তারিখ পর্যন্ত মুলতবি হয়েছে অধিবেশনÑ ঈদের ছুটি সংসদ সদস্যদেরও। একদিকে ঈদের বাজার, আরেকদিকে বাজেটের বাজার। বাজারে প্রচুর টাকা, নগদ টাকা। কাগজে দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংক ঈদ উপলক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়বে। এই টাকা কী বিনা পয়সায় মানুষকে দেয়া হবে? না, মানুষ টাকা বদল করে নেবে খরচের জন্য। বলা বাহুল্য, এই নতুন নোটের জন্য ‘কামড়াকামড়ি’ হয়। অনেকে পায়, অনেকে পায় না। অথচ এর কদর ঈদ উপলক্ষে বড়ই বেশি। এই টাকা, বলা যায়, খরচের খাতায়। ভাবা যায়! ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট হাতে হাতে ঘুরবে? সবটাই খরচÑবাজারে, বকশিশে! ঈদে কী শুধু এই টাকা? এর সঙ্গে অবশ্যই যোগ হবে রেমিটেন্সের টাকা। কত? হিসাবে দেখলাম গত মে মাসে রেমিটেন্স হিসাবে এসেছে এক দশমিক ৪৮ বিলিয়ন (বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলার। অর্থাৎ প্রায় ১৫ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে দাঁড়াবে ১২-১৩ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা গ্রামে গ্রামে খরচ হবে ধরে নেয়া যায়। জুন মাসেও রেমিটেন্স আসবে ঈদের খরচের জন্য। আমার ধারণা রেমিটেন্সের হাজার বিশেক কোটি টাকা বাজারে আসবে। রয়েছে বেতন-ভাতা-বোনাসের টাকা। বেসরকারী খাতের বকশিশের টাকা। সব মিলিয়ে বিশাল এক খরচের যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে ঈদ উপলক্ষে। বস্তুত ঈদের বাজার সারা বছরের বাজার। দোকানদার, ব্যবসায়ীরা সারা বছরের বেচা-কেনা এই সময়েই করে ফেলে। লাভ-মুনাফা এই সময়ে। বাকি বছর বলতে গেলে তারা দোকানের খরচ চালায়। দিন দিন এই বাজার বড় হচ্ছে। মানুষের আয় বাড়ছে, রোজগার বাড়ছে, স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে। সরকারের একটা হিসাবে দেখলাম গত চৌদ্দ বছরে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় চারগুণ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ৫৪৩ ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা হচ্ছে ১৯৫৬ ডলার। বলা বাহুল্য, মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, মধ্যবিত্তের পরিসর বড় হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাজারও বড় হচ্ছে। ঈদে, বস্তুতপক্ষে দুই ঈদে এর প্রতিফলন ঘটে। শুধু চাল-ডাল, নুন, তেল, পিঁয়াজ, রসুন নয় মানুষ এখন ভোগ করছে বিচিত্র ধরনের পণ্যসামগ্রী। জামা-কাপড়, জুতা-মোজা, ইলেকট্রনিক পণ্য, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বিচিত্র সব ভোগ্যপণ্য-দেশী ও বিদেশী। এসবের বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে এই বাজারের একটা বড় ধরনের মহড়া হয়। শত শত, হাজার হাজার বিপণি বিতানে এই মহড়ার আয়োজন হয়। এবারের রোজা ও ঈদ পড়েছে মে-জুন মাসে। জুন মাস অর্থনৈতিকভাবে আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসেই নতুন বাজেট দেয়া হয় এবং মাসের শেষে বাজেট পাস হয়। পহেলা জুলাই থেকে তা কার্যকর হয়। এবারের বাজেট আবার গুরুত্বপূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে। সামনে নির্বাচন, তা হবে ডিসেম্বরের মধ্যেই। এমন সময়েই বাজেট। বাজেটে নতুন কিছু নেই। তবু কথা থাকে এবং কথা আছে। বাজেটে বহু সমন্বয় কর্ম আছে। এর ফলাফল এখন বাজারে পরিষ্কারভাবে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া বাজেটের কতিপয় পদক্ষেপ তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে এবং পড়েছে সংসদে। সংসদে দেখা যাচ্ছে সরকার দলীয় সদস্য এবং বিরোধীদলীয় সদস্যÑ সবাই ব্যাংকিং খাতের সমস্যা নিয়ে সোচ্চার। দেখলাম ‘সাপ্লিমেন্টারি বাজেট’ আলোচনা নেই। ওই বাজেটের আলোচনাতেই ব্যাংকের আলোচনা। প্রকৃত পক্ষে সংসদে কী আলোচনা হয়েছে তা আমার জানা নেই। আমার সূত্র কাগজের রিপোর্ট। আমি আশা করেছিলাম ‘সাপ্লিমেন্টারি বাজেট’-এর ওপর জোরালো আলোচনা হবে। অথচ কার্যত বিনা আলোচনায় ‘সাপ্লিমেন্টারি বাজেট’ পাস হয়ে গেল। দেখা যাচ্ছে ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১৫ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা বেশি খরচ করে ফেলেছে। তাদের যে বাজেট বরাদ্দ ছিল তার চেয়ে বেশি খরচ। এখন সংসদে এসেছে তা অনুমোদনের জন্য। আবার ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দ অনুযায়ী খরচ করতে পারেনি। এখানে প্রশ্ন হবে : যারা খরচ বেশি করেছে তারা কোথায় তা করেছে? কেন করেছে? খরচ যথাযথ হয়েছে কীনা? খরচে অপচয়, অদক্ষতা আছে কীনা? অন্যদিকে যারা পারল না তাদের কৈফিয়ত কেন তারা পারল না? বরাদ্দ নিল অথচ খরচ করতে পারল না কেন? ‘সাপ্লিমেন্টারি বাজেট’ আলোচনা এই দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। এই বাজেট আলোচনা করেই যেতে হয় নতুন বছরের বাজেটে। আমরা দেখতে পাচ্ছি সংসদে ‘সাপ্লিমেন্টারি বাজেট’ আলোচনা প্রায় হয়ই না। এটা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে জন্য অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় আক্ষেপ করেছেন। আমি বরং বলব এ দিকটায় অর্থমন্ত্রীর বড় ব্যর্থতা রয়েছে। তিনি সাপ্লিমেন্টারি বাজেট আলোচনায় সংসদ সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি। আর উদ্বুদ্ধকরণই বা কেন? এটা তো সংসদেরই বিষয়। এই আলোচনা সম্পন্ন করেই তো তারা ব্যাংকের আলোচনা করতে পারতেন এবং করাই তা উচিত। কারণ এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ব্যাংকিং খাত। এই খাতটি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার মধ্যে। মূল বিষয় খেলাপী ঋণ, ক্লাসিফাইড লোন। এর পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ফলে ব্যাংকে পুঁজির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, প্রভিশন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে নানা সমস্যা। এসব সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান না করে বেসরকারী ব্যাংকের মালিকরা সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। আগে এক পরিবারের পরিচালক থাকতে পরত দুজন, এখন চারজন। আগে এক নাগাড়ে পরিচালক থাকা যেত ছয় বছর, এখন নয় বছর। তাদের জন্য ‘ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট’ (সিআরআর) হ্রাস করা হয়েছে। সরকারী আমানত তারা পেত ২৫ শতাংশ, এখন ৫০ শতাংশ। এসব পদক্ষেপ ছিল বহুল সমালোচিত। এর কারণ আছে। বেসরকারী ব্যাংগুলো সাধারণ গ্রাহকের কোন কাজে আসছে না। তারা নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। নিয়মের বাইরে ঋণ নেয়া, টাকা ফেরত না দেয়া ইত্যাদি বড় অভিযোগ। এসব অভিযোগের পরও তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়াতে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। এর মধ্যে ঘৃতাহুতি দিলেন অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট কর আড়াই শতাংশ হ্রাস করেছেন। আবার একদম নতুন ব্যাংক যারা শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত নয় তাদেরও এই সুযোগ দিলেন। এই পদক্ষেপেই মনে হয় সংসদ উত্থান। আরও কথা আছে। অর্থমন্ত্রী ব্যক্তিগত করদাতাদের কোন ছাড় দেননি। গত তিন বছরে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে অনেক। প্রত্যেক বছর তা ঘটেছে ৫-৬ শতাংশ হারে। অথচ তিনি একটি পয়সা ছাড় দিলেন না। ছোট ছোট ফ্ল্যাটের ওপর তিনি ভ্যাটের পরিমাণ বাড়ালেন। উবার, পাঠাও জাতীয় উঠতি ব্যবসায় তিনি ভ্যাট বসালেন ৫ শতাংশ হারে। বলা বাহুল্য, এসব মধ্যবিত্তের সেবা। ব্র্যান্ডেড কাপড়, আসবাবপত্র, ৫৬টি পণ্যের ওপর বর্ধিতহারে ভ্যাট তিনি বসিয়েছেন। ড্রিঙ্ক, কসমেটিকস, ফল, রিডিং গ্লাস ইত্যাদি মধ্যবিত্তের পণ্যও তার ভ্যাটের আওতায়। আইটি সেবার ওপর ভ্যাট বসালেন। এভাবে দেখা যায় অর্থমন্ত্রী মধ্যবিত্তের প্রায় সব পণ্যের ওপরই ভ্যাটের আওতা সম্প্রসারিত করেছেন। এসব দৃষ্টিকটু বিষয় নয় কী? তিনি বেসরকারী ব্যাংক মালিকদের একের পর এক সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন, অথচ মধ্যবিত্তকে, গরিব মানুষকে তিনি ভ্যাটের চাপে পীড়িত করছেন। মনে হয় সংসদ সদস্যরা এসবে ক্ষুব্ধ এবং এই ক্ষোভই প্রকাশিত হয় ব্যাংকের আলোচনায়। জানি না শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে? গেল বার ব্যাংক হিসাবের ওপর শুল্ক বসানো হয়েছিল আর যায় কোথায়? পুরো বাজেট আলোচনা গেল এই সমস্যার ওপর দিয়ে। ব্যস, বাজেট আলোচনা শেষ এবং বাজেট পাস। এবারও কি তাই হবে? জানি না। ‘সাপ্লিমেন্টারি বাজেট’ পাসের পর এখন মূল বাজেটের ওপর আলোচনা শুরু হয়েছে। ঈদের জন্য এখন সংসদ অধিবেশন মুলতবি হয়েছে ১৮ তারিখ পর্যন্ত। ঈদের পর অধিবেশন পুনরায় শুরু হলে কী, আলোচনা আবার ব্যাংকের ওপরই হবে? হোক, কিন্তু বাজেটের আলোচনার তো আরও দিক রয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নের হার দিন দিন কমছে। ৯৭-৯৮ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশের নিচে নেমেছে। এর তো সমাধান দরকার। বাস্তবায়নের ক্ষমতা বৃদ্ধি না করে প্রতিবছর রাজস্ব টার্গেট এত বড় করার অর্থ কী? সরকারী কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে। তারা গাড়ি-বাড়ি পাচ্ছেন। সুদের ওপর ভর্তুকি পাবেন। তার পরও দেখা যাচ্ছে সরকারের দক্ষতা হ্রাস পাচ্ছে। সংসদে কী এই বিষয়টি আলোচিত হবে না? সরকারী খরচের গুণগত মান নিয়ে অনেক দিন যাবত সমালোচনা চলছে। এর ওপর কী সংসদে কোন আলোচনা হবে না? সরকারী ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমছে, তাদের প্রতিবছর টাকা দিতে হয় বাজেট থেকে। অথচ সরকারী ব্যাংকে সরকারী প্রতিষ্ঠান ঋণপত্র খোলে বিনা পয়সায়। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের পাওনা। এর ওপর কী কোন আলোচনা হবে না? সরকারী নীতি: ভ্যাটের আওতা বাড়ানো, অগ্রিম আয়কর উৎসে কেটে রাখা। এতে সাধারণ মানুষ ও মধ্যবিত্ত কর দিচ্ছে বেশি। ধনীরা কোন কর দিচ্ছে না। পাঁচ-সাত-দশ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণগ্রহীতারা কত টাকা আয়কর দেন তার হিসাব নিয়ে আলোচনা হবে কী সংসদে? আয়কর ব্যবস্থার কারণে কিছুসংখ্যক লোক আয়কর দেয়। কোটি কোটি লোক আয়কর ফাঁকি দেয়। এর ফলে যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে তার ওপর কী সংসদে আলোচনা হবে? ব্যাংকগুলো যে এক শতাংশ লোকের সেবা করে এবং তারা যে বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে তার ওপর কী সংসদে আলোচনা হবে? এই প্রশ্নগুলো রাখলাম। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×