ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অংশ নিচ্ছেন ৩২ দেশের ৭৩৬ ফুটবলার ৬৪ ম্যাচে

পর্দা উঠছে আজ ॥ বিশ্বকাপ ফুটবল গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৪ জুন ২০১৮

পর্দা উঠছে আজ ॥ বিশ্বকাপ ফুটবল  গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ

মজিবর রহমান ॥ অপেক্ষার প্রহর শেষ। এসে গেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিশ্বকাপ ফুটবলের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার সময়। সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের চোখ এখন প্রথমবারের মতো আয়োজক রাশিয়ার ওপর। বিশ্বকাঁপানো বিশ্বকাপ ফুটবলের টানটান উত্তেজনার পালা শুরু আজ রাতেই। বিশ্বের সেরা সব ফুটবল শিল্পীর নয়নাভিরাম নৈপুণ্য, ঝলক আর পায়ে-বলের আগুন ঝরানো অপার সৌন্দর্যের সার্থক প্রদর্শনী দেখার অপেক্ষায় গোটা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমী। ৩২ দেশের এই মহারণে কোন তারকার বদৌলতে কোন দলের বৃহস্পতি তুঙ্গে এক মাসের আনন্দ-বেদনার লড়াই শেষে জানা যাবে ১৫ জুলাইয়ের ফাইনাল শেষে। গ্রেট ব্রিটেনের বিখ্যাত পপ গায়ক রবি উইলিয়মসকে দেখা যাবে আজ রাতে রাশিয়ার ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রীড়াযজ্ঞ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী মঞ্চে। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের আশি হাজার দর্শক ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে তার সুরের মূর্ছনা। রাশিয়া-সৌদি আরব ম্যাচের আগে আধ ঘণ্টার এই সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের সূচী ফিফা যেভাবে তৈরি করেছে তাতে ব্রাজিলের প্রাক্তন তারকা রোনাল্ডোই একমাত্র ফুটবলার যিনি আলোকিত করবেন অনুষ্ঠানের মঞ্চ। বিশ্বকাপ খেলতে না পারলেও দর্শক হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ এই উত্তেজনায় শরিক। বাড়ির ছাদে, গাছের ডালে পতপত করে উড়ছে বিশ্বকাপের সেরা দলগুলোর পতাকা। উত্তেজনা আর উন্মাদনার ঝড় বয়ে চলতে শুরু করেছে ফুটবলানুরাগীদের ঘরে ঘরে। বিশ্বকাপের রংধনুর আবিরমাখা আলোয় মেতে উঠেছে গোটা দেশ। বাংলাদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা যে কতটা বিস্ময়কর, সেটা বিশ্বকাপ এলেই উপলব্ধি করা যায়। কি শহর, কি গঞ্জ-গ্রাম। হাটে-মাঠে সর্বত্র বয়ে চলে বিশ্বকাপ ফুটবলের জোয়ার। দেশের জনপদ যেন তপ্ত হয়ে ওঠে বিশ্বকাপ উত্তাপে। টিভির বদৌলতে এখন নীরব গ্রামীণ জনপদের রাতও কেঁপে ওঠে ফুটবলের মিছিল-সেøাগানে। প্রিয় দলের সাফল্যে উচ্ছ্বাস আর ব্যর্থতায় দীর্ঘশ্বাস বুক নিংড়ে ঝরে পড়ে ফুটবলপ্রেমী মানুষের দেশটিতে। চার বছর অন্তর বিশ্বকাপ শুরু হলে যে কথাটি সবার আগে সামনে চলে আসে তা হচ্ছে কে জিতবে শিরোপা? এ নিয়েই চলতে থাকে মাতামাতি। ব্যত্যয় ঘটছে না এবারও। গোটা বিশ্বেই এখন বিশ্বকাপ উত্তাপ। এবার কার নৈপুণ্যে মাতবে বিশ্ব তাই এখন দেখার। আসলে ফুটবলের বিশ্বকাপ বলে কথা। ৩২ দেশ, ৬৪ ম্যাচ, প্রতি টিমে ২৩ ফুটবলার। মোট ৭৩৬ জন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বকাপে আরও একজন তারকা থাকে। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে তার নাম ছিল ‘ব্রাজুকা’। এবার রাশিয়ায় এডিডাসের তৈরি ‘টেলস্টার ১০’Ñ বিশ্বকাপের সরকারী বল। এখানেই শেষ নয়Ñ সবকিছুর ওপরে আছে আরও এক মহানায়ক। সেটা ‘ট্রফি’। যাকে ঘিরেই এত উত্তাপ-উত্তেজনা। আসলে ফুটবল একটি সুন্দর শৈল্পিক খেলা। বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়োজন-যা ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে বিবেচিত। খেলোয়াড়দের নয়ন জুড়ানো ক্রীড়াশৈলী আর দর্শকদের আনন্দ বিশ্বকাপ ফুটবলকে করে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন ও উপভোগ্য। জনপ্রিয়তার মানদ-েÑ অলিম্পিক গেমস থেকে শুরু করে অন্য যে কোন ক্রীড়া আসরের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণের খোরাক নিঃসন্দেহে বিশ্বকাপ ফুটবল। মূল পর্বের ৩২ দলকে ঘিরে আবর্তিত এ উন্মাদনা এক সার্থক সুন্দর ছবি আঁকে পৃথিবীর ক্যানভাসে। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বর্ণিল, আকর্ষণীয় এই উৎসবকে ঘিরে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ৩২টি দেশ অংশ নেয় ছন্দময় এই উন্মাদনায়। সুনির্মল বিনোদনের পরিপূর্ণ স্বাদ নেয় তারা ময়দানী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে। এবারও ব্যতিক্রম ঘটবে না। নিঃসন্দেহে বলা যায় ইউরোপীয় আর লাতিন ছন্দে উপভোগ্য হয়ে উঠতে বাধ্য গোটা আসর। ফুটবলপ্রেমী পর্যটকদের ভিড়ে এখন উৎসবের নগরী মস্কো। এখানেই ৮০ হাজার দর্শক ধারনের লুঝনিকি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় স্বাগতিক রাশিয়া-সৌদি আরব ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে বিশ্বকাপের শিরোপা যুদ্ধ। বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য মোট ১১টি শহর বেছে নিয়েছে রাশিয়া। সবগুলো শহরেই উৎসব-আমেজ। স্থানীয় ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে ভিনদেশী দর্শক, খেলোয়াড়, কর্মকর্তাদের দীপ্ত পদচারণায় মুখরিত গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো। যেন আনন্দের ঢেউ সর্বত্র। কে জিতবে কাপ ॥ মস্তিষ্ক বলছে এবারের আসরে কাপ জিতবে ‘এন জে টেন’-এর ব্রাজিল। আর মন বলছে ‘এল এম টেন’-এর আর্জেন্টিনা। আবার হৃদয়ের বিশাল একটা অংশজুড়ে ‘সি আর সেভেন’। বলা হচ্ছিল এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে দামি তারকা পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের নেইমার, দুইবারের শিরোপা জয়ী আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি ও ইউরো জয়ী পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর কথা। সন্দেহ নেই মেসি, নেইমার ও রোনাল্ডোই এবারের আসরের সবচয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত তারকা। যদিও বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে বড় একটা অংশজুড়ে স্থান করে নিয়েছেন হালের সেনসেশন মিসরের মোহাম্মদ সালাহ। ইংলিশ জায়ান্ট লিভারপুলের জার্সিতে অসাধারণ সব গোল করে চলে এসেছেন মহাতারকার কাতারে। তবে এই ভাললাগা-ভালবাসায় অভিমান করতে পারেন বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, দুইবারের শিরোপা জয়ী ফ্রান্স, একবারের আসর সেরা স্পেন ও ইংল্যান্ডের সমর্থকরা। কারণ, শিরোপা জয়ের মতো তকমা তাদেরও রয়েছে। সামর্থ্য রাখে সমস্ত হিসাব পাল্টে দিয়ে ‘শিরোপা’ নামক বিশ্বকাপের মহানায়ককে আপন করে নেয়ার। এই তালিকায় ইউরোপের ‘পাওয়ার হাউস’ চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি সবচেয়ে এগিয়ে। কিন্তু রোনাল্ডোর অসাধারণ ফুটবলশৈলীর কারণে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পরই পর্তুগালকে টেনে আনা। এবারের ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগীজ দলটি বিশ্বকাপে বেশ সাড়া জাগাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখে এক রোনাল্ডো নির্ভর দল নয় এবার। রোনাল্ডোকে ঘিরে ‘ওয়ান ম্যান শো’ টিমের অপবাদটা চাপা পড়ে গেছো ফরাসীদের কাঁদিয়ে নিঃসন্দেহে ইউরোপ সেরা হওয়ার বদৌলতে। এ কারণেই পর্তুগালকে নিয়ে আশাবাদী অনেকেই। রোনাল্ডো ক্ষণজন্মা ফুটবলার। ‘কথায় আছে প্রতিভা কখনও ঝাঁকে ঝাঁকে জন্মায় না। সময়ের বিবর্তনে তারা আসেন কালেভদ্রে। আর এ কারণেই তারা ক্ষনজন্মা’। রোনাল্ডো তাদেরই একজন। ‘সি আর সেভেন’ পর্তুগীজদের প্রাণভ্রমরা। অভিজ্ঞদের সঙ্গে অনেক প্রতিভাবান তরুণ। গড় হিসেবে বিগত বিশ্বকাপের তুলনায় অনেক পরিণত এই পর্তুগাল। এক কথায়- ‘এভারেজ টিম’। সবাই সমান দক্ষ-প্রাণশক্তি রোনাল্ডো আরও অনেক এগিয়ে। তবে তার চেয়েও বড় কথা গোলের খেলা ফুটবলে আগাম হিসাব অনেকাংশে অচল। ফাইনালে উঠে আসতে পারে গোনার বাইরে থাকা দলও। শিরোপার অন্যতম দাবিদার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্সের মতো পরীক্ষিত শক্তিকে টেক্কা দিয়ে হিসাবের বাইরের যে কোন দুই দল হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলে আসতে পারে শিরোপার কাছাকাছি। ঠিক যেমনটি ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলে দেখিয়ে দেয় স্পেন-হল্যান্ড। আর প্রথমবার ফাইনালে উঠেই বাজিমাত করে স্পেন। ডাচরা অবশ্য আরও তিনবার ফাইনালে খেলেছে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস রাশিয়া বিশ্বকাপে নেই হল্যান্ড। সঙ্গে চারবারের বিশ্বকাপ জয়ী ইতালি। বাছাই উৎরাতে না পারায় আকাশটা তাদের বেদনায় নীল। জিততে পারে ইউরোপের কোন দেশ ॥ আসলে ফুটবল একটি সুন্দর শৈল্পিক খেলা। বিশ্বকাপ আনন্দের এই মেলায় ঘটতে পারে অনেক ঘটনাই। কাজেই বর্ণিল এই আসরে চিরাচরিত ধারায় শুধু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে নিয়ে মাতামাতি করলেই চলবে না। কাপ এবার ইউরোপেই যে থাকবে না এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। ফুটবল মাঠের চিত্তনাড়া লড়াইয়ে দুই লাতিন পরাশক্তি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে পেছনে ফেলে এবারও শিরোপা জিতে নিতে পারে ইউরোপের কোন দেশ। বিশ্বকাপ শুধু দলের নয়। দুই মহাদেশেরও মর্যাদার লড়াই। এতে পায়ে-বলের মনোমুগ্ধকর ছন্দ, নান্দনিক গোলের অপূর্ব দৃশ্য, দর্শকের মাঝে উত্তেজনা-উন্মাদনার জোয়ার বইয়ে কোন দেশের ফুটবলাররা হাসবেন শেষ হাসি তা বিশ্বকাপের শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত বলা কঠিন। সঙ্গত কারণে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, টানটান উত্তেজনা, খেলা শেষে ফলাফলকে ঘিরে হাসি-কান্নার যে অধ্যায় তা ফুটবলকে তুলে এনেছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের রাজার আসনে। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই সোস্যাল নেটওয়ার্ক সাইট ফেসবুক বেছে নিয়েছে বিশ্বকাপের সেরা দল। শুধু পারফর্মেন্সের নিরিখে নয়, জনপ্রিয়তার বিচারে। এতে টিমের ‘মহানায়ক’ নেইমার দ্য সিলভা জুনিয়র। কারণ একটাই, ব্রাজিল মহাতারকার জনপ্রিয়তা এই মুহূর্তে ফুটবল বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। দশ কোটিরও বেশি ভক্ত তার। এই ফুটবল শিল্পীর সেরা দল এবার নিজ দেশ। ফুটবল বোদ্ধাদের মতেও বিশ্বকাপের বিশ্বযুদ্ধে এবার সবচেয়ে এগিয়ে ব্রাজিল। তারপর অন্য সব দেশ। যদিও ব্রাজিল তারকা মনে করেন বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, জিদানের দেশ ফ্রান্স, স্পেনের বাইরে চমক দিতে পারে আর্জেন্টিনাও। আর ব্রাজিল? দেশটির প্রাণভ্রমরা নেইমার বলে দিলেন, ব্রাজিলকে এগুতে হবে এক একটা ম্যাচ ধরে। কারণ ’এন জে টেন’ ভাল করেই জানেন তার ওপর প্রত্যাশার চাপ কতখানি। দলের সামর্থ্যও তার জানা। আর এ কারণে প্রবল আত্মবিশ্বাস থেকেই ফেবারিটের তালিকায় নিজ দলকে রাখছেন নেইমার। টগবগে ব্রাজিল তরুণ মনে করছেন বিশ্বের যে কোন দলকে হারাতে সক্ষম তারা। কোচ লিওনাদ্রো তিতেও কিন্তু ইতোমধ্যে বোমা ফাটিয়ে দিয়েছেন নিজ দলকে নিয়ে। আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা ব্রাজিল কোচ সরাসরি জানিয়ে দিলেন, রাশিয়া বিশ্বকাপ জেতার জন্য তার বর্তমান ‘ব্রিগেড’ যথেষ্ট। কাপ জেতার জন্য এটাই তার সেরা দল। মোদ্দকথা যেমনি ভারি দল, তেমনি নামী ফুটবলার। আর সাম্বা ছন্দের দলে সবচেয়ে দামী তারকা নেইমার। চ্যাম্পিয়ন হলেই সেরা মেসি ॥ এদিকে চ্যাম্পিয়ন হলেই নিজেকে সেরা মানবেন মেসি। অনেকে বলছেন, তার ট্রফি ক্যাবিনেটে বিশ্বকাপ ট্রফি কোনদিন ঢুকুক বা না ঢুকুক, তিনিই এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ফুটবলার। সত্যিকারের গ্রেট। কিন্তু তিনি? লিওনেল মেসি এসব প্রশংসার কোনটাই মানতে নারাজ। ২০১৮ বিশ্বকাপে ঠিক মাঠে নামার আগে তার সরল স্বীকারোক্তি, ফুটবল বিশ্বের সেরা পুরস্কার বিশ্বকাপ যত দিন না আমি জিততে পারছি, ততদিন নিজেকে প্রকৃত গ্রেট ফুটবলার বলে মনে করি না। গত কয়েক বছরে মেসির অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য তাকে ম্যারাডোনার সঙ্গে বারবার তুলনায় এনেছে। ম্যারাডোনা ২৫ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন। রাশিয়ায় মেসি তার চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলছেন ৩১ বছর বয়সে। আর্জেন্টিনা অধিনায়কের সংযোজন, বিশ্বকাপ জেতার মতো সব ধরনের রসদ তার দলে রয়েছে। বাকিটা ভাগ্য। সাফল্যের জন্য শুধু ভাল দল বা ভাল খেলা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন ভাগ্যের সহায়তাও। ভাগ্য এবার কোথায় নিয়ে যায় সেটাও দেখার। তবে মেসি যাই মনে করুক, ইউরোপের মাটিতে এবার মরণ কামড় দিতে তৈরি দক্ষিণ আমেরিকার গর্ব আর্জেন্টিনা। দলের কোচ জর্জ সাম্পাওলির আত্মবিশ্বানটাও বেশ জোরালো। তারপরও প্রশ্ন, সুবিন্যস্ত এই দল নিয়ে মেসি কি পারবেন এবার ম্যারাডোনা হতে? দর্শক-ভক্তদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তবে ফুটবলের কাছে মেসির একটা বিশ্বকাপ পাওনা আছে। সাম্পাওলির এমন কথায় সায় আছে অনেকেরই। মেসি নিজেও অবশ্য এ কথার জবাবে বলেছেন, আশা করি ফুটবল তার দায় মেটাবে এবার। এই বিশ্লেশনের মাঝে আরেকটি প্রসঙ্গ ঘুরপাক খাচ্ছে, এটাই কী মেসির শেষ বিশ্বকাপ? হয়তো তাই। এবার বিশ্বকাপ জিততে না পারলে মেসি যে জাতীয় দল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবেন এমন ইঙ্গিত আগেই দিয়েছেন। জার্মানিও ফেবারিট ॥ এদিকে জার্মানি শুধু অংশগ্রহণ করা নয়, বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে আটবার এবং চ্যাম্পিয়ন হয়েছে চারবার। একমাত্র ব্রাজিল ছাড়া বিশ্বকাপে এত উজ্জ্বল ইতিহাস কোন দেশ রচনা করতে পারেনি। গতবার ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপরে ফাইনালে তারা মেসির আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কাপ জিতে নেয়। তবে ফাইনালে জেতার মতোই গত বিশ্বকাপে জার্মানির যে কীর্তি সবার মনে দৃষ্টান্ত হয়ে গেছে তা হলো ব্রাজিলের মাঠে ব্রাজিলের মতো দলকে ৭-১ গোলের ব্যবধানে হারানো। সঙ্গত কারণে আমরা যদি এই বিশ্বকাপের কথাই ধরি, তাহলেও দেখা যায় জার্মানিকে ফেবারিট না ভেবে উপায় নেই। দীর্ঘদিন ধরেই জার্মানির কোচের দায়িত্বে আছেন জোয়িকিম লো। অভিজ্ঞ ও তরুণ ফুটবল প্রতিভার মিশ্রণে যে দল জোয়িকিম লো তৈরি করেছেন তা এ পর্যন্ত সফল বলেই মনে হচ্ছে। তবে একটা আসর জেতার জন্য যে কৃতিত্ব লাগে, পরেরবার সেই জয়কে ধরে রেখে ফের চ্যাম্পিয়ন হতে তার চেয়েও বেশি দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তাই রাশিয়া বিশ্বকাপে জার্মানির কাজটা যে একটু বেশি কঠিন। তবে দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় ইউরোপের প্রথম সারির ক্লাবে খেলে অভ্যস্ত। ইনজুরি কাটিয়ে ফেরা মেন্যুয়েল নিইয়্যের গোলপোস্টে বেশ নির্ভরতা দিতে পারবেন। ম্যাট হামেলস, থিয়াগো সিলভার নেতৃত্বে জার্মানির ডিফেন্স যথেষ্ট মজবুত। মেসুত ওজিল, টনি ক্রুজ, সামি খেদিরা বিচিত্র স্টাইলের প্রতিপক্ষ দলের বিপক্ষে মাঝমাঠ সামলাতে যথেষ্ট পারঙ্গম। টমাস মুলার আর মারিও গোমেজ যদি নিয়মিত গোল করতে পারেন তাহলে জোয়িকিম লোকে ঠেকায় কে। সবচেয়ে বড় কথা , জার্মানি কিন্তু এখন আর ‘কিক এ্যান্ড রান’ স্টাইলের ফুটবল খেলে না। তারাও কিন্তু পাসিং ফুটবল আয়ত্ত করে ফেলেছে। তারা এখন নিজেদের মধ্যে পাস দিয়ে খেলে প্রতিপক্ষের শক্তি মাপতে। আসলে যে গ্রুপেই থুকুক, যত বিচিত্র প্রতিপক্ষ উল্টো দিকে থাক, জার্মানিকে বিশ্বকাপের সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই ধরতে হবে। ফলে এবারও জার্মানি বিশ্বকাপের উজ্জ্বল নাম হয়ে উঠতে পারে। স্পেন আত্মবিশ্বাসী ॥ এদিকে স্পেন এবার অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। দলের বেশিরভাগ ফুটবলার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ বিজয়ী রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সিলোনার লাইনআপ থেকে আনা। নিজ দেশে উচ্চ মানের একটা লীগ আছে। বেশিরভাগ খেলোয়াড় রিয়াল-বার্সিলোনায় খেলেন। আছেন বিশ্বসেরা ইংলিশ লীগের বড় ক্লাবের খেলোয়াড়ও। ক্লাবের নৈপুণ্যই তাদের জাতীয় দলে জায়গা করে দিয়েছে। কোচ জুলেন লোপেতেগুই অবশ্য বলছেন বদলে গেছে স্পেন। গত দুই বছরে স্পেনের পারফরম্যান্স ঈর্ষণীয়। গোল করা ও গোল খাওয়ার হিসাবই বলে দেবে আমাদের বর্তমান পার্থক্য। এ সময়ের মধ্যে আমরা ৬০-এরও বেশি গোল করেছি। ম্যাচ পিছু গোল ৩-এরও বেশি। এটা যে কোন দলের জন্য দারুণ ব্যাপার। এই পারফরমেন্স নিয়ে আমি দারুণ খুশি। স্পেন বসের সরল স্বীকারোক্তি, রাশিয়ায় কাপ জেতাই তার দলের একমাত্র লক্ষ্য। প্রসঙ্গত, রাশিয়া বিশ্বকাপে স্পেনের প্রথম ম্যাচ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগালের বিপক্ষে। ফলে শুরুটাই বেশ কঠিন মানছেন স্পেন কোচ। তার কথায়, রোনাল্ডো সবদিক থেকেই কিংবদন্তি। এত বড় মানের ফুটবলারের সঙ্গে লড়াই তো বটেই। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে আমাদের খেলতে হবে ইউরো চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে। তবে এটা একের বিরুদ্ধে একের লড়াই নয়। দল হিসেবে মাঠে কে কেমন খেলবে, সেটাই বড় ব্যাপার। আমাদের লক্ষ্য অটুট-বিশ্বাস আছে হ্নদয়ে। এটাই রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রধান অস্ত্র। এবার চমক দেখাবে বেলজিয়াম ॥ বিশ্বকাপ ঘিরে দুনিয়াব্যাপী ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের মনে রং ধরেছে আরও অনেক আগেই। এবারও এই রঙিন সরোবরে প্রিয় দলের সাফল্যে কেউ হাসবেন। আবার কেউ বা প্রিয় দলের ব্যর্থতায় কাঁদবেন। এ নিয়ে দিনের পর দিন রচিত হবে বিচিত্র আনন্দ-বেদনার ইতিহাস। এই ইতিহাসে এবার নতুন দিগন্তের সূচনা অপেক্ষা করছে বেলজিকদের সামনে। বিশ্বকাপের বল মাঠে গড়ানোর ঠিক আগে বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মকে আরও তাতিয়ে দিলেন অধিনায়ক ইডেন হ্যাজার্ড। আর অপেক্ষা নয়। বিশ্বকাপে কিছু করতে হলে এবারই সেরা সময়। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে এবারের দলটা ধারে-ভারে দেশের সর্বকালের শক্তিশালী দল। হ্যাজার্ড নিজে চেলসির হয়ে দারুণ খেলছেন ক্লাব ফুটবলে। সেই ধারা অব্যাহত রাখতে পাখির চোখের মতো তাকিয়ে আছেন শিরোপার দিখে। তার সঙ্গে আছেন ক্যাভিন ডি ব্রুইন ও রোমেলু লুকাকুর মতো বরেণ্য তারকা। সে কারণেই হ্যাজার্ড বলছেন, রাশিয়ায় আমাদের কিছু করে দেখাতেই হবে। দলের বেশিরভাগ ফুটবলার বিশ্বের নামী ক্লাবে সাফল্যের সঙ্গে খেলছেন। তাই যদি কিছু করতে হয় সেটা এবারই। ইংল্যান্ডও এগিয়ে ॥ ইউরোপীয় পরাশক্তির মধ্যে একবারের কাপ জয়ী ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে দুর্ভাগা দল হিসেবে পরিচিত। অথচ বিশ্বের সেরা লীগের আয়োজক ইংল্যান্ড। সেখানে খেলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিদেশী অনেক ফুটবলার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ নিয়ে থাকে। সুযোগ পায় জাতীয় দলে। কিন্তু ঘরোয়া ফুটবলের মতো বিশ্বকাপে কেন যেন নিজের খেলাটা খেলতে পারেন না ইংরেজ ফুটবলাররা। তাদের গোলা-বারুদ বিশ্বকাপের লড়াইয়ে পরিণত হয়ে যায় সামান্য পটকায়। যদিও দারুণ ফর্মে আছেন এবার তরুণ অধিনায়ক হ্যারি কেন। কোচ গ্যারেথ সাউথ গেট অবশ্য বিগত আসরগুলোর তুলনায় এবার বেশ এগিয়ে রাখছেন ইংল্যান্ডকে। তবে তারুন্যে আস্থা রেখে ইংলিশ বস সাউথ গেট রাশিয়ায় এবার কোন গেট দিয়ে বের হন সেটাই দেখার। জেতার রেকর্ড আছে উরুগুয়েরও ॥ কাপ জেতার রেকর্ড রয়েছে লাতিন আমেরিকার উরুগুয়েরও। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পরই ‘লাতিন হ্যাভিওয়েট টিম উরুগুয়ে’। গতি, স্ট্যামিনা আর খুনে মেজাজে ফ্রান্স, জিনেদিন জিদানের কাপ জয়ের ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে না পারলেও অনেক দূর এগুবে। গ্রেট দিদিয়ের দেশম দলটির কোচ। তিনিও স্বপ্ন বুনছেন ফরাসী যুদ্ধাদের নিয়ে। ইউরো রানার্সআপ ফারাসীদের রয়েছে কিলিয়ান এমবাপে, পল পোগবা, এ্যান্টনি গ্রিজম্যানের মতো বড় তারকা। ওরাও ফেল না নয় ॥ আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে মিসর, নাইজিরিয়া, মরক্কো, তিউনিশিয়া, সেনেগাল শিরোপার ধারে-কাছে যেতে না পারলেও যে কোন পরাশক্তির জন্য বড় হুমকি । ঠিক যেমনটি এশিয়ার কোরিয়া-জাপান দেখাতেও পারে। তবে আয়োজক রাশিয়াকে অবশ্য ভাগ্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে শুরু থেকে। স্বাগতিক হওয়ার সুবাদে সরাসরি মূলপর্বে খেলার সুযোগ পাওয়াকেই ভাগ্যবান ভাবতে পারেন পৃথিবীর বৃহত্তর দেশটির মানুষ। তবে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চে জায়গা করে নেয়া আইসল্যান্ড কিছুটা হলেও কাপিয়ে দিতে পারে বিশ্বকাপ। যেমনটি ইউরো লড়াইয়ে দেখিয়েছিলেন ছোট দেশটির ফুটবলাররা। উল্লেখ্য, আইসল্যান্ডের সঙ্গে এবারই প্রথম বিশ্বকাপ খেলছে আরেক ছোট দেশ পানামা। এ ছাড়াও বিশ্বকাপে বিতর্ক এড়াতে এবারই প্রথম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে ম্যাচের সময়।
×