আবারও একজন মুক্তমনা লেখক-প্রকাশক ও ব্লগারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে নির্মম-নৃশংসভাবে। ঘটনাস্থল মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার পূর্ব কাকালদির তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থিত একটি ওষুধের দোকানে। নিহত শাহজাহান বাচ্চু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মুন্সীগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বিশাখা প্রকাশনীর মালিক। তদুপরি তিনি ছিলেন একজন মুক্তবুদ্ধির লেখক এবং অনিয়মিত সাপ্তাহিক আমাদের বিক্রমপুরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মুক্তবুদ্ধির চর্চাসহ নিয়মিত যুক্তিসিদ্ধ লেখালেখির কারণে মৌলবাদীরা তাকে প্রতিনিয়ত নানাভাবে হত্যার হুমকি-ধমকি দিত। কিছুদিন আগে যখন মৌলবাদী জঙ্গীদের সন্ত্রাসী হামলায় একের পর এক মুক্তমনের লেখক ও ব্লগারদের হত্যা করা হচ্ছিল তখন তাদের প্রণীত হিটলিস্টে নিহত শাহজাহান বাচ্চুর নাম ছিল ১১ নম্বরে। তাই এই সন্দেহ অমূলক নয় যে, এই হত্যার পেছনেও মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠীর হাত থাকতে পারে। হত্যা মামলা ও পুলিশী তদন্তে বিষয়টি নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট হবে। অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে ইতোমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রায় তিন বছর আগে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দীপনের অপরাধ তিনি মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করেছিলেন। এরপর একে একে ব্লগার নিলাদ্রি নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গী সন্ত্রাসীরা। এর মানে দাঁড়ায় এই যে, জঙ্গী সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি অদ্যাবধি। অনেক ক্ষেত্রে এসব হত্যা মামলার চার্জশীট প্রদানে বিলম্বসহ ধীরগতির বিচারের অভিযোগ আছে।
অবশ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের জনপ্রিয় সংস্কৃতিমনস্ক অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম হত্যা মামলা দায়েরের দু’বছরের মধ্যে রায় ঘোষণা করেছেন রাজশাহী বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক। নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং দ্রুত বিচারের উদাহরণ। এই মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আরও বলতে হয় যে, এই হত্যাকান্ডের আগে-পরে দেশে আরও হত্যাকান্ড ও হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর সঙ্গে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। যেমন, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বিশিষ্ট লেখক অভিজিৎ রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আখতারুজ্জামান প্রমুখ। এসব হামলা-মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হওয়া বাঞ্ছনীয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে উদ্যোগী ও তৎপর হতে হবে।
পুলিশ-র্যাব-কাউন্টার টেররিজম-ইউনিট-সোয়াটসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিয়মিত নজরদারির পরও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, জঙ্গী তৎপরতা কমছে না দেশে। বরং জঙ্গীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে রাজধানীসহ সারাদেশে তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। পুলিশী ভাষ্যমতে জঙ্গীরা অসংগঠিত ও দুর্বল হয়ে এলেও নব্য জেএমবি নামে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা হামলা ও নাশকতার পাঁয়তারা করছে। বর্তমান সরকার ধর্মীয় উগ্রপন্থাসহ সব রকম জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্র মতবাদের কোন স্থান নেই। প্রকৃতপক্ষে জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের হাত ধরে দেশে ধর্মীয় রাজনীতি এবং জঙ্গীবাদের উদ্ভব ঘটে। যে কোন মূল্যে এদের নির্মূল করতে হবে। লেখক ও প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুর হত্যার ঘটনায় নিন্দা এবং পরিবার ও স্বজনদের জানাই সমবেদনা। পুলিশ এই নির্মম ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন করবে বলেই প্রত্যাশা।